কালিকাপুরের রাজবাড়ির ঠাকুরদালান। নিজস্ব চিত্র
আমাদের কাছেপিঠেই এমন জায়গা রয়েছে যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মেলে ইতিহাসের ছোঁয়াও। এমনই একটি জায়গা, ইছাই ঘোষের দেউল। যাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনকেন্দ্র।
যাত্রা শুরু হল গুসকরা থেকে। এই গোটা এলাকার আগে নাম ছিল গোপভূম। আউশগ্রাম, কাঁকসা-সহ বিস্তীর্ণ এই এলাকার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে বনভূমি। সেই সবুজের বুক চিরে সর্পিল কালো পিচের রাস্তা চলে গিয়েছে। নানা রঙে রাঙিয়ে রয়েছে চারিদিক। মূল রাস্তার ধার ঘেঁষে কার্পেটের মতো লাল মোরাম বিছানো পথ। মাঝেমধ্যে খোয়াই। মনে হয় যেন কোনও শিল্পী এঁকে গিয়েছেন।
আউশগ্রামের গঞ্জ পেরিয়েই শুরু হয়ে গেল জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে কোথাও আদিবাসীপল্লি। কোথাও বা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই সব গ্রামে এখনও রয়েছে রাজবাড়ি, কোথাও আবার অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার মন্দির। বাঁদিকে ফরেস্টের অফিস ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে বননবগ্রাম হাসপাতাল। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই বাঘড়াই সেতু। নীচ দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে যাচ্ছে শীর্ণস্রোতা কুনুরের জলরাশি। হাঁটুজল পেরিয়ে চলাচল করছে গরু, গাড়ি, মানুষ। চারপাশে কেউ যেন আনমনেই হলুদ আর সবুজ রং ঢেলে দিয়েছে। বর্ষায় অবশ্য এই কুনুরকে দেখলে চিনতে পারবেন না।
মোরবাঁধের মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। ডানদিকেও একটা রাস্তা রয়েছে। সে দিকে গেলে দেখা মেলে ‘পান্ডু রাজার ঢিবি’র। আমরা অবশ্য চললাম এগারো মাইলের দিকে। একটু এগোতেই জঙ্গল ঘন হয়ে এল। চারিদিকে শুধুই পাখপাখালির কলতান। গাছের গোড়ায় গোড়ায় বড় বড় উইঢিবি। রাতে এই রাস্তায় মাঝেমধ্যেই শেয়াল, খটাসের দেখা মেলে।
ইছাই ঘোষের দেউল। নিজস্ব চিত্র
পিচ রাস্তা থেকে কখনও বাঁদিক কখনও ডানদিকে নেমে গিয়েছে লাল মোরামের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে অনেকটা ভিতরে রয়েছে গ্রাম। চারপাশে শাল, পিয়াল আর মহুয়ার ফুলের মন মাতাল করা গন্ধ।
পিচ রাস্তার উত্তরে এমনই একফালি মোরাম রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে পরে কালিকাপুর গ্রাম, যেখানে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে সাতমহলা রায়বাড়ি। এই বাড়ির আকর্ষণে আজও অনেক আসেন এ গ্রামে। বিরাট এলাকা জুড়ে দিঘি। তার চারদিকে এই বাড়ি। অনেকটাই এখন ভগ্নপ্রায়। যেটুকু টিকে রয়েছে, তার মধ্যে আছে দুর্গাদালান। পাশেই রয়েছে জোড়া শিবমন্দির। অপূর্ব টেরাকোটার কাজে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি ধরা আছে। অনেক সিনেমার পটভূমি এই সাতমহলা বাড়ি, দেউড়ি, অলিন্দ, ঝুলবারান্দা, বাঁধানো দিঘির ঘাট, জোড়া শিবমন্দির, এই গ্রামের রাস্তাঘাট।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি এসে উঠল পানাগড়-মোড়গ্রাম জাতীয় সড়কের এগারো মাইল মোড়ে। সেখান থেকে বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে ফের ডানদিকের ছোটো পিচ রাস্তায় ঢুকে পড়লাম আমরা। কিছুটা এগিয়েই বনকাটি পঞ্চায়েত। এখানে অযোধ্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে এগোলেই ইছাই ঘোষের প্রতিষ্ঠিত দেউল।
কালিকাপুরের জোড়া শিবমন্দির। নিজস্ব চিত্র
ইছাই ঘোষ শুধু ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়কই ছিলেন না, একাদশ শতকের ইতিহাসে তাঁর অবদান অস্বীকার করা যায় না। বাংলায় তখন পাল রাজা মহীপালের রাজত্ব। ইছাই ঘোষ বা ঈশ্বরী ঘোষ তাঁর সময়ের এক জন স্বাধীন সামন্ত রাজা ছিলেন। তিনিই ছিলেন এই এলাকার গড়ের অধিপতি। এই গড় জঙ্গলেই নাকি তাঁর দুর্ভেদ্য ঘাটি ছিল। জনশ্রুতি, তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শিখর ধারার মন্দিরটি ‘ইছাই দেউল’ নামে পরিচিত। তাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে পর্যটনস্থল। ওই দেউলটি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা সংরক্ষিত আছে। এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও রয়েছে। এই স্থানকে ঘিরে শোনা যায় অনেক কাহিনি। কিছু দূরেই রয়েছে তাঁর আরাধ্যা দেবী শ্যামারূপার মন্দির, রক্তনালা। এই দেবীর আদেশ অমান্য করে গৌড়েশ্বরের সেনাপতি লাউসেনের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ইছাই-এর পরাজয় এবং মৃত্যুও হয়েছিল এই এলাকায়ই। জনশ্রুতি, সেই যুদ্ধে এত রক্তপাত হয়েছিল যে সেটা বয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছিল একটা নালা, যা ‘রক্তনালা’ হিসাবে পরিচিত।
গোটা এলাকা জুড়ে রয়েছে গহন জঙ্গল। পাশেই অজয় নদ। অজয়ের বাঁধ থেকে দেউলের দিকে তাকালে বোঝা যায় পুরো এলাকাটা ছোট টিলার মতো। জঙ্গলের মাথায় দেউলের চূড়াটি দেখা যায়। শোনা যায়, এক সময় এই এলাকায় বিপ্লবীদের ডেরা ছিল। এখন অবশ্য জঙ্গল পরিষ্কার করে বেশ কিছু লোকালয় গড়ে উঠেছে। অজয় পেরোলেই ও পারে রয়েছে জয়দেব ধাম, যেখানে বসে কবি জয়দেব রচনা করেছিলেন ‘গীতগোবিন্দ’। আর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেব কেন্দুলি তো অন্য চেহারায় ধরা দেয়। হয় জয়দেব-কেন্দুলির মেলা।
এখন দেউলের পার্কে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি কটেজ এবং গেস্ট হাউস রয়েছে। প্রায় ২০০ বিঘা জমির উপরে তৈরি হয়েছে পার্ক। সেখানে কী নেই? নরম ঘাসের গালিচা বিছানো উদ্যান, বাহারি ফুল, টয়ট্রেন, ছোটদের জন্য নানা খেলনা। আরও কত কী! রয়েছে নৌকোবিহারের ব্যবস্থাও। পাশেই বনবিভাগের ডিয়ার পার্ক। সেখানে হরিণ এবং ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক আশ্চর্য জাদুতে পুরো এলাকা বদলে যেতে শুরু করেছিল দু’দশক আগে থেকেই। জানা যায়, এই এলাকার ব্লুপ্রিন্ট তৈরিতে ভূমিকা ছিল খড়্গপুর আইআইটি-র। এখন পুরো পার্কের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে সমবায় সমিতির উপরে। সমবায় সমিতির সভাপতি শম্ভু রায় জানান, এই পার্ককে ঘিরে এই এলাকার মানুষের রুটিরুজি নির্ভর করে। সরাসরি প্রায় ৬০ জন মানুষ এখানে কাজ করেন। তা ছাড়া এলাকাবাসীও বিভিন্ন ভাবে এর সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এককথায়, আনন্দের সব উপকরণের ডালি সাজিয়ে দেউল পার্ক রয়েছে শুধু আপনার আসার অপেক্ষায়।
কী ভাবে যাবেন
• গুসকরা অথবা দুর্গাপুর থেকে পানাগড়-মোড়গ্রাম সড়কে এগারো মাইল মোড় হয়ে যেতে পারেন। পানাগড় স্টেশন থেকে দেউল পার্কের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। বাসে এগারো মাইল মোড়ে এসে সেখান থেকে টোটো পেয়ে যাবেন। নিজস্ব গাড়িতেও যাওয়া যায়। দেউল পার্ক কর্তৃপক্ষও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন।
কোথায় থাকবেন
• দেউলের নিজস্ব কটেজ ও গেস্ট হাউস রয়েছে। এসি, নন-এসি ঘর রয়েছে। মোট ৩৮টি ঘর রয়েছে। ভাড়া ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। ডরমিটরির ব্যবস্থাও আছে। বেড ভাড়া ৩০০ টাকা। এখানেই খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। চার জনের এক দিনে খরচ ২৫০০ টাকার মতো।
কী দেখবেন
• ইছাই ঘোষের দেউল পার্ক, গড় জঙ্গল, শ্যামারূপার মন্দির, রক্তনালা। অজয় নদ পেরিয়ে জয়দেব ধাম, লাউসেন তলা। আউশগ্রামের মধ্যে কালিকাপুরের রাজবাড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy