অপরূপা রিয়াং নদী। পাথরে বাধা পেয়ে ঝর্নার রূপ নিয়েছে।
সেখানে সারাদিন রিমঝিম, নদীর নীলে ও উপত্যকার সবুজে চোখের শান্তি, মনের আরাম। পাহাড়ের ঘেরাটোপে প্রিয়জনের সঙ্গে শখ করে অজ্ঞাতবাস, আহা, এমন দিন জীবনে খুব বেশি আসে না। নদীর নাম রিয়াংখোলা, জায়গার নাম যোগীঘাট। এ পারে লাবদা ও মংপু, ও পারে তুরুক খাসমহল, দার্জিলিং জেলায় যথাক্রমে সিঙ্কোনা ও কমলালেবুর দেশ। নীচ থেকে ঘাড় উঁচু করে পাহাড় দেখার এক অন্য রকম মজা পাওয়া গেল যোগীঘাটে পৌঁছে। তখন বিকেল, আকাশজুড়ে এক আশ্চর্য সুন্দর রঙের খেলা। পাহাড়ের নীচের দিকেও সেই রংবাহার ছড়িয়ে পড়ে অসাধারণ সব দৃশ্য তৈরি করছে। একসময় ঝাড়ু ও শরবনের আড়ালে সূর্যাস্ত হল। সে দৃশ্য অনেক দিন মনে থাকবে। সন্ধে নামতেই চারদিক অতি শুনশান, কান জুড়ে শুধু নদীর গান।
রিয়াং নদীর নাম প্রথম পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘তখনও রিয়াংখোলা থেকে’ কবিতায়। যেন হাত ধরে উপলাকীর্ণ স্রোতধারার ধারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। যোগীঘাটের নাম কিন্তু আগে শোনা ছিল না! প্রথম এসে নিজের চোখে রিয়াংয়ের ব্যতিক্রমী চলন ও দু’পারের চোখজুড়নো প্রকৃতি দেখে প্রেমে পড়ে গেলাম। শীতের শেষে ধাপে ধাপে রিয়াংয়ের বেডে নেমে যাওয়া নিসর্গের বিস্তৃত ক্যানভাসে রং কিছু কম পড়েনি। সকাল থেকে বিকেল সেই রঙের অদলবদল যোগীঘাটের প্রকৃতিকে আরও বৈচিত্রময় ও উপভোগ্য করে তোলে। এই সব নিয়ে কয়েক দিন সত্যিই যেন অজ্ঞাতবাসে কেটে যায় অবলীলায়।
বছরের যে কোনও সময়ে ছোট ছুটি সম্বল করে রিয়াং নদীর গান শোনার জন্য যাওয়া যেতে পারে যোগীঘাট। উচ্চতা সাড়ে তিন হাজার ফুটের কাছাকাছি হওয়ায় শীত-গ্রীষ্ম, কোনওটারই তীব্রতা সে রকম পীড়াদায়ক নয়। সেরা মানের কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত সিটংয়ের নিম্নবর্তী অংশে সব দিক থেকে (সিটং-২ খাসমহল) ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার যোগীঘাট। এটি মূলত একটি সঙ্কীর্ণ উপত্যকা। কার্শিয়াংয়ের পাহাড় ও মংপুর পাহাড়কে যুক্ত করেছে নদীর ওপরে নবনির্মিত একটি সেতু। সিটংয়ের দিকের পাহাড়ে মনোরম ধাপচাষের জমি, আর একটু ওপর দিকে কমলালেবু ও ফুলের বাগান। আবার লাবদা হয়ে মংপুর পাহাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সিঙ্কোনা গাছের চাষ ব্রিটিশ আমল থেকে আরম্ভ হয়েছে।
রিয়াংখোলা নদী
পথের পাশে জঙ্গলের শোভাও এককথায় অসাধারণ। আলো-ছায়ার আল্পনা আঁকা পার্বত্যভূমি। মধ্যিখানে যোগীঘাট অনেকটা নীচে, নদীর সমতলে। ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে দুই মানুষ সমান ঝাড়ু ও শরগাছের বন। বর্ষায় ঘন সবুজ, শীতে সোনা হলুদ রঙের বন্যা। তার এক ধাপ নীচ দিয়ে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে খরস্রোতে বয়ে গিয়েছে অপরূপা রিয়াং নদী। কোথাও কোথাও পাথরে বাধা পেয়ে ঝর্নার রূপ নিয়েছে। কোথাও আবার বোল্ডারের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সুইমিং পুল। স্নান করার মজাই আলাদা।
লোহার সেতু
নতুন লোহার সেতুর পাশে কাঠের পুরনো দোলনা সেতু আজ পরিত্যক্ত, কিন্তু ছবি তোলার বিষয় হিসেবে আকর্ষক। শীতের দিনগুলিতে জলের ধারে পিকনিকের আসর বসে, বাকি সময়ে শুনশান। হাতির পিঠের মতো বড়ো বোল্ডারগুলি যেন অবসরের আরামকেদারা। সারা দিন রাত নদীর কলকলানিতে মুখর হয়ে থাকে যোগীঘাট। সেই গান কানে নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া, আবার একই ভাবে জেগে ওঠা। তার সঙ্গে পাখির কলকাকলি মিশে যায়।
রিয়াংখোলা নদীর তীরে বসতি
এখানে বসতি বলতে কয়েকটি বাড়ি ও দোকান সেতুর পাশে। তার মধ্যে একটি হোমস্টে। একটু দূরে চলে গেলে নিরালা নিসর্গের রাজপাট জমজমাট। ধাপে ধাপে চাষের জমি। কয়েকটা কাঠের বাড়ি, নানা রঙে রাঙানো। পাশ দিয়ে সর্পিল রাস্তা ওপরে উঠে গিয়েছে। এই পথে গাড়ি নিয়ে নানা আকর্ষণের কেন্দ্র তুরুক খাসমহল ঘুরে আসা যাবে। অনেক কাল আগে ইংরেজ আমলে তুরুক খাসমহল ছিল আরণ্যক এলাকা। এখন হাজার পাঁচেক ফুট পাহাড়ের ওপরে বিরাট বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নানা রকম চাষের আয়োজন, জৈবসার ব্যবহার করে।
ধাপে ধাপে চাষের জমি
অনেক দেখার জায়গা তুরুকের আস্তিনের নীচে। কৃষিনির্ভর গ্রামের একাংশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। অন্য দিক থেকে সিটংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা, আপার সিটংয়ের অন্যতম উঁচু পাহাড় থামদাঁড়া। মাঝখানে ঘন সবুজের সাম্রাজ্য। ঝাড়ু থেকে কমলাবাগান। থামদাঁড়ায় চোখজুড়নো চা বাগানের আড়ালে লুকিয়ে আছে পবিত্র পাঁচটি প্রাকৃতিক জলাশয়, একত্রে পাঁচপোখরি নামে পরিচিত। পথপাশে সিটং-মামরিং ঝর্না একটি পরিবারের নিজস্ব সম্পত্তি। আরও বড় ঝর্নাও আছে, যোগীঘাট থেকে কিছুটা পথ গাড়িতে আর বাকিটা সামান্য ট্রেক করে দেখে আসা যাবে।
আরও পড়ুন: পাহাড়, চা বাগান, ঝর্না আর সমুদ্র... হাতছানি দেয় শ্রীলঙ্কা
তুরুকের পাশের গ্রাম মামরিং লেপচা উপজাতি অধ্যুষিত। ফুলবাগানের একধারে কাঠের তৈরি তাদের ট্র্যাডিশনাল বাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে পর্যটকদের দেখার জন্য। তুরুক গ্রামের অন্য প্রান্তে চোর্তেন ও মনাস্ট্রিও পারিবারিক সম্পত্তি। কিন্তু প্রবেশ অবাধ। যেমন আকর্ষক বাইরের অংশ, তেমনই নজর কাড়ে ভেতরের মূর্তিকলা ও রঙিন শিল্পকর্ম। গাড়িতে আর সামান্য গেলেই মহলদিরামে মনোরম চায়ের দেশ ও কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউপয়েন্ট। ফটোগ্রাফারদের প্রিয় স্থান। লুপ্তপ্রায় প্রাণী হিমালয়ান নেউট বা স্যালামান্ডারের বাসভূমি নামথিং পোখরি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। বস্তুত, কমলার দেশ সিটং ও সিঙ্কোনার দেশ লাটপাঞ্চারের সব দর্শনীয় স্থান একই দিনে গাড়িতে ঘোরা সম্ভব যোগীঘাটকে কেন্দ্র করে। বাগোড়া, চিমনি হয়ে ওল্ড মিলিটারি রোডের অনবদ্য বন্য সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে কার্শিয়ং ঘুরে আসতে পারবেন কয়েক ঘণ্টায়। অন্য দিকে, মংপুতে রবীন্দ্রতীর্থ যাওয়া বা আসার পথে ঘোরা হয়ে যাবে। তার মানে, যোগীঘাট নামটা আনকোরা হলেও জায়গাটি উত্তরবঙ্গের চেনা মানচিত্রের বাইরে নয়।
আরও পড়ুন: সিকিমের নাথাং ভ্যালির পরনে যেন মেঘের পাগড়ি
কী ভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে দু’টি রাস্তায় যোগীঘাট যাওয়া যায়। ১) রোহিনী রোড, কার্শিয়াং, দিলারাম হয়ে, ২) সেবক রোড, রম্ভি, মংপু, লাবদা হয়ে। দুই রাস্তাতেই দূরত্ব শিলিগুড়ি থেকে ৭০-৭৫ কিমি। কার্শিয়াং ৩০-৩২ কিমি।
আরও পড়ুন: পাহাড়-জঙ্গলের বুকে হারিয়ে যাওয়ার অনুপম ঠিকানা কাফের
কোথায় থাকবেন: রিয়াং নদীর সেতুতে ওঠার মুখেই মুখিয়া হোম স্টে যোগীঘাটে থাকার একমাত্র জায়গা। জনপ্রতি দিনপ্রতি থাকা ও খাওয়ার খরচ ১২০০-১৫০০ টাকা। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ: ৯৭৩৩২৮৩৯৮৪ এবং ৯৬৪৭৪৬৭১৩২
ইমেল: mukhiahomestay89@gmail.com
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy