ভরতপুরের গা জড়িয়ে ঝুমঝুমিয়ে শীত নেমেছে। সকাল ৭টা। এখনও যেন শহরটার ঘুম কাটেনি। কাল সন্ধ্যায় সেই যে একরাশ এলোচুলে সূয্যিটা মুখ ঢাকল, এখনও তা সরায়নি। তার উপর আবার সকালের কুয়াশার মিহি জালি কাজের ওড়না বিছিয়ে...কখন যে তার দেখা পাব! একদল পেলিক্যান ডানার ঝামটা দিয়ে কুয়াশার বুকে প্যাস্টেল শেডে আঁকা হয়ে গেল। একটা শুকনো গাছের ডাল জুড়ে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘ইজিপসিয়ান ভালচার’-রা। কোনও এক ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে শিস দিচ্ছে বুলবুল আর সানবার্ড। বেশ একটা অন্যরকম সকালে পা রাখলাম রাজস্থানের ভরতপুরের কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানে।
এ উদ্যানের শুরু সেই ১৭২৬ থেকে ১৭৬৩-র মাঝে মহারাজ সূরযমলের সময়। পরবর্তীতে মহারাজ রামসিংহ, ১৮৯৩-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে এই জলাভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন। এই সময় থেকেই বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হয়ে ওঠে এই উদ্যান। ১৯৫৬ সালে রাজস্থান সরকারের দায়িত্বে এটি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রায় ২৯ বর্গ কিমি বিস্তৃত এই উদ্যানে ৩৭৫ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। ১৯৮৫-তে ইউনেস্কো এই উদ্যানকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়।
তত্ত্বকথা ছেড়ে এবার পা রাখি এর অন্দরমহলে। প্রথমেই বলে রাখি, এই উদ্যানের ভিতরে কোনও গাড়ি চলে না। হয় আপনাকে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে অথবা পায়ে টানা রিকশায়। আর প্রতিটি রিকশার চালকই পুরোদস্তুর আপনার গাইড। প্রথম দিন আমার গাইড অর্জন সিংহ। আশ্চর্য হয়েছিলাম তাঁর সময়জ্ঞান, পাখির ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার পক্ষে প্রয়োজনীয় ও অনুকূল আলোর জ্ঞান, কোন পাখি কোথায় দেখা যাবে...এসব তাঁর নখদর্পণে। এই উদ্যানের প্রতি পরতে পরতে চমক...! এই মুহূর্তে জলের উপর শুকনো ডালের মাথায় পাখা ছড়িয়ে বসে থাকা ডার্টারের ভিজে পালকের ওপর দিয়ে রোদ্দুরের ছলকানো...তো তার পরের ক্ষণেই ‘লেসার হুইসলিং ডাক’-এর দলের অবাক চোখে চেয়ে থাকা। কুয়াশায় মোড়া ছায়াপথ বেয়ে ‘বার হেডেড গুস’-এর জল ভেঙে উঠে আসা কিংবা ‘নর্দান শোভলার’-এর ডানা মেলে আকাশের বুকে রং ছড়িয়ে দেওয়া...। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব! ‘গ্রেট হোয়াইট পেলিক্যান’-রা জল ছাড়ল একসঙ্গে। আকাশের বুকে এক চক্কর দিয়ে নামল আরএকদিকে...সকলে মিলে নিঃশব্দে ভেসে গেল...তারপর একসঙ্গে মুখ লুকাল জলে...পিছনের দুধ সাদা পালকগুলো, সকলের, একসঙ্গে থিরথির করে কাঁপছে...জলগুলো ছোট ছোট বৃত্ত তুলে সরে সরে যাচ্ছে...আমি যেন ব্যালের এক অনবদ্য উপস্থাপনা দেখছি...। ছবি তুলব কী, শুধুই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
গ্রেট হোয়াইট পেলিক্যান
আরও পড়ুন: বেড়াতে যাচ্ছেন? জেনে নিন নানা জায়গার খুঁটিনাটি
শীতের দুপুরে ‘স্পট বিল্ড ডাক’-টা আড়মোড়া ভাঙছিল। ‘কমনকুট’ জল ছিটাল ওর গায়ে। চোখ পাকিয়ে ঘাড় ফেরাল বড় হাঁসটা..., ‘কুট’-টা উধাও। কোটর থেকে বেরিয়ে ‘স্পটেড আউলেট’, রোদ্দুরে চোখ বুজে...‘পায়েড কিংফিশার’-টা জলের ওপর এক পাক খেয়ে জলের ওপরে উঠে এক জায়গায় স্থির হয়ে ডানা নাড়ছে...। ‘পেইন্টেড স্টর্ক’-রা বাসা বেঁধেছে জলার ধার জুড়ে থাকা বড় গাছগুলোর ডালে। ওদের ডাকাডাকিতে কান পাতা দায়। ‘গ্রিন পিজিয়ন’ বড় গাছটার মাথায় বসে নীচে লোকেদের আসা-যাওয়া দেখছে। ‘মার্শ হ্যারিয়ার’-টা ঝাপটা দিল জলাজমিতে। পরের মুহূর্তে একটা ‘কুট’ ওর পায়ের নখে গাঁথা। ‘সার্পেন্ট ঈগল’ ঘাড় ঘুরিয়ে নীচে সারসটার কাণ্ডকারখানা নজরে রাখছে।
স্পটেড আউলেট
বেলা প্রায় পড়ে এল। প্যাকেট লাঞ্চ শেষ করে পা ফেলতেই নজরে এল একটা ‘কমন টীল’, ডানপাশের ডানাটা মেলে ধরেছে। যেন র্যাম্পে কোনও এক মডেল। ধীরে ক্যামেরা নিয়ে এগোই, প্রায় নিঃশব্দে। চোখ ‘ভিউ ফাইন্ডার’-এ। হঠাৎই তাতে এক হলুদ আভা, লুকিয়ে দিল পাখিটাকে। ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরাতেই দেখি আমার সামনে এক পাইথন মাথা তুলে...। রোদ পোয়ানো শেষে বেরিয়েছে। ফ্রেমবন্দি করি দু’জনকেই। ফেরার পথে ‘পার্পেল হেরন’-এর জলভাঙা, আর ‘ব্ল্যাক নেকড্ স্টর্ক’। হঠাৎই রাস্তার ধারে মাথা তুলে গোসাপ। আলো-ছায়া গাছের ক্যানোপিতে ধীর গতিতে চলতে থাকা চিতল হরিণের চকিতে ফিরে তাকানো...ক্যামেরার লেন্সে যত না দেখেছি তার থেকেও বেশি দেখেছি চোখের ৩.৫ লেন্স দিয়ে, সযতনে রেখেছি মনের মণিকোঠায়। ভরতপুর এলে পাখি দেখা ছাড়াও একটা দিন সময় করে অটো/গাড়ি ভাড়া ফতেপুর সিক্রি, লোহাগড় কেল্লা, মিউজিয়াম, সূরযমলের প্রাসাদদেখে নিতে ভুলবেন না।
স্টারলিং ব্রামহি
আরও পড়ুন: সঙ্গী ভয়শূন্য চিত্ত, বাইক বাহনে পৌঁছলাম মুক্তিনাথ
ফিরছি যখন, সূর্য অস্তাচলে। নরম হয়ে মিশছে জলার জলে, মাটিতে। সাঁঝের আকাশ তার চুল এলো করতে শুরু করেছে। সে ছায়ায় জলার বুকের মাঝে থাকা গাছগুলো, গা ছমছমে, কেমন এক অশরীরী মাত্রা পেয়েছে। ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বাড়ি ফিরে সারাদিনের গল্প শোনাতে বসেছে পাখিগুলো। ‘ব্ল্যাক উইংগড্ স্টিল্ট’-এর একটা দল ঘরে ফেরার ব্যস্ততায় দ্রুত ডানা ঝাপটাচ্ছে,‘স্টার্লিং ব্রাহ্মণী’-র ঝুঁটিটা হাওয়ায় উড়ছে,অস্তগামী সূর্যের আলোয় স্যিলুট হয়ে রইল একটা ময়ূর!
কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক
কীভাবে যাবেন
ট্রেনে বা বিমানে নয়াদিল্লি।
নয়াদিল্লির নিজামুদ্দিন থেকে ট্রেন অথবা সরাসরি গাড়ি নিয়ে ভরতপুর।
নয়াদিল্লি থেকে দূরত্ব ১৮৭ কিমি (দক্ষিণে)
আগ্রা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিমি (পশ্চিমে)
কখন যাবেন
অক্টোবর থেকে মার্চ ভাল সময়।
কোথায় থাকবেন
ভরতপুরে জাতীয় উদ্যানের আশপাশে অনেক হোটেল আছে। তবে রাজস্থান ট্যুরিজমের হোটেল সারস এবং উদ্যানের ভিতর ফরেস্ট লজ বেশ ভাল।
যোগাযোগ
১) rtdc.tourism.rajasthan.gov.in (এতে অনলাইন বুকিং করা যায়)
২) ডাইরেক্টর, কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক, ভরতপুর, রাজস্থান। ফ্যাক্স: ০৫৬৪৪-২২২৭৭৭, ই-মেল: dirkeoladeo@gmail.com
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy