তামসাং
সৌরিণী চা-বাগান
মিরিক থেকে মাত্র ৬ কিমি। এ পথে চোখে পড়বে নানান চা-বাগানের। চলে আসুন সৌরিণী। নীল আকাশের নীচে সুউচ্চ টিলার মাঝে সবুজ মখমলি চা-বাগানের ঢেউ। সৌরিণী মোড় থেকে বাঁ দিকে ঢুকে পড়লাম। রাস্তাটা গোল চক্কর কেটে অনেকটা নীচে নেমে গিয়েছে। ডাইনে উঁচু টিলায় চা-বাগান। বামে গোলাকৃতি ঢালে মাথা চাড়া দিয়েছে দু’টি পাতা, একটি কুঁড়ির এক সাজানো ভ্যালি। কাচ্চি সড়কের শেষে সুন্দর এক হোমস্টে।
সৌরিণী চা-বাগান দেখে নিন। হোমস্টে লাগোয়া দু’একর জমিতে নানান রাসায়ানিক সারমুক্ত ফসল। আলু, শিম, বাঁধাকপি, স্কোয়াশ, টোম্যাটো সমেত হরেক মরসুমি ফল। শীতে কমলালেবুতে ভরে যায় বাগান। ইচ্ছে হলেই বাগান থেকে নিজেদের পছন্দমতো সব্জিও তুলতে পারেন অতিথিরা। অরগানিক ফার্ম, তাই প্রচুর পাখিও আসে। বার্ডওয়াচারদের স্বর্গ বললেও ভুল হবে না।
দিনের শেষে টিপাই সেরে ফিরে আসছে গ্রামের মেয়েরা। রাতে নেপালি আদিবাসী নৃত্যর আয়োজন। পর দিন ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে হাল্কা ট্রেকে, জঙ্গল পাহাড়ের মাঝে এক মনোরম খোলার ধারে এসে পৌঁছলাম। খোলার নাম বুংকুলুং।
সৌরিণী চা-বাগান
কোথায় থাকবেন:
সৌরিণীতে থাকার জন্য রয়েছে রাজ্যেশ্বরী হোমস্টে (মোবাইল ০৯৯৩২৩১৭২৯৯), ভাড়া জনপ্রতি ১২০০ টাকা, থাকা-খাওয়া সমেত। ৬টি ডাবল বেডরুম রয়েছে।
এরা নিরামিষভোজী, তাই অতিথিদের জন্য নিরামিষ আয়োজন। তবে যাঁরা আমিষ খান, তাঁদের নিরাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে আলাদা জায়গা রয়েছে। আদিবাসী নৃত্যর খরচ আলাদা।
তামসাং
ছুটি কাটানোর ঠিকানা যদি হেরিটেজ বাংলো আর সঙ্গে অনুপম চায়ের বাগান হয়ে থাকে তা হলে কেমন হয়? সোজা চলে আসুন দার্জিলিংয়ের পথে। ঘুম স্টেশন থেকে ডাইনে ঘুরেই ঘুমভঞ্জন। পাহাড়, জনপদ, পাইনের বন পেরিয়ে বিজনবাড়ি রোড থেকে আঁকাবাঁকা পথে ঢুকতেই চলে জড়িয়ে ধরবে পাইনের ঘন বন।
পাহাড়ের ডাইনে বাঁয়ে যে দিকেই চোখ যায়, শুধু চায়ের বাগান। মেরিবং গোম্বা মোড় থেকে রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটি চলে গিয়েছে মেরিবং চা-বাগানের দিকে। অন্যটি তামসাং চা-বাগানের দিকে। এখান থেকে মাত্র ২ কিমি গেলেই তামসাং চা-বাগানের হেরিটেজ বাংলো।
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্র বুংকুলুং-তুরুক-সেলফু
দূরে, অনেক নীচে বেসামাল সবুজের মাঝে তামসাং টি গার্ডেন ফ্যাক্টারি। তারই পাশে সুন্দর ছবির মতো এক বাংলো। দু’পাশের ঘন সবুজ চা-বাগান ভেদ করেছে কাঁচা-পাকা আঁকাবাঁকা পথ। চা বাগান সংলগ্ন ফ্যাক্টরি পেরিয়ে, পাথুরে পথ পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল তামসাং ট্রি রিট্রিটে। ৪০০৩ মিটার উচ্চতায়। ১৬৪ বছরের প্রাচীন বাংলো নির্মাণ করেন জার্মান সাহেব বার্ণিকে মিশনারি কাজকর্ম নিয়ে দার্জিলিং এলাকায় আসেন। তখন চা শিল্পের প্রসারে ১৮৬৭ সালে তিনি এই বাংলো তৈরি করেন। অতঃপর ইংরেজরা, অনেক পরে হাতবদল হয়ে ভারতীয়রা এই চা বাগানের মালিক হন। আর এখন এখানেই ইচ্ছে হলেই রাত কাটাতে পারেন।
তামসাং টি বাংলো
বাংলোর সামনে বিশাল লনে নরম সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সামনের উন্মুক্ত আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসিমুখ দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যাবে তা টের পাবেন না। বাংলোর দুই প্রান্তে দু’টি বিশাল ক্যামেলিয়া গাছ। শীতে মরসুমি ফুলের বাহারে ভরে ওঠে বাগানের চারপাশ। একতলায় একটি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তিনটি বিশাল ঘর। মোট চারটি ঘর।
এখান থেকে চলে আসুন এক পবিত্র গুহামন্দিরে। পাথর চুঁইয়ে জল পড়ে পিচ্ছিল পাথর সাবধানে পেরিয়ে তামসা মাতার দর্শন সেরে নিন। জনশ্রুতি বলছে, এই পাহাড় ও চা-বাগানকে রক্ষা করেন তামসা দেবী। জাগ্রত এই দেবীকে ভক্তি সহকারে পুজোও দেন স্থানীয় মানুষ। তারই নামে উপত্যকার নাম তামসাং।
তামসাং-এর দু’কিমি দূরে ছোট রঙ্গিত নদী। হাল্কা ট্রেকে চলে আসতে পারেন। মাঝে পড়বে লামিধুরা। দু’পাশে চা-বাগানকে সঙ্গী করে আরও এক কিমি গেলে শনশনে হাওয়ার শব্দ ভেদ করে কানে আসবে নদীর কুলু কুলু শব্দ। চা-বাগানের পাহাড়, মাঝে সুন্দর উপত্যকা ভেদ করে বয়ে আসছে পাহাড়িয়া নদী ছোটা রঙ্গিত। অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় সেখানে। তামসাং চা-বাগান হেরিটেজ চা-পর্যটনের এক নয়া ঠিকানা।
কোথায় থাকবেন:
তামসাং-এ থাকার ঠিকানা তামসাং টি রিট্রিট। হেরিটেজ বাংলোর চারটি ঘর। ভাড়া দু’জনের জন্য ৯,০০০ টাকা। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার-সহ। কর আলাদা। নদীপাড়ের পিকনিক, পিক-আপ ড্রপের খরচ আলাদা। যোগাযোগ chamongchiabari.com
লামাগাঁও
পাহাড়ের এক অচিন গ্রাম। চার দিকে সবুজের রাজপাট। বিজনবাড়ি থেকে আরও উপরের দিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের পাকদণ্ডী। সে পথের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই দেখা মিলবে রঙ্গিত নদীর। কোথাও ধাপচাষ, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সাঁটা ছোট ছোট গ্রামের বাড়ি, লাল-নীল ইউনিফর্ম পরা স্কুলছুট শিশুদের বাড়ি ফেরার হুটোপাটি, আবার কোথাও অরগানিক ফসলের বাহার। বিজনবাড়ি থেকে ১২ কিমি ছবি আঁকা পথ। মাঝে মাঝে মেঘ এসে পথ, ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়ে। মরসুমে হলদে কমলালেবুর বাহারে সবুজের মিশ্রণ অসাধারণ লাগে। এক দিকে পাহাড়, মাঝে মিশকালো পিচরাস্তা। পথের ধারে এক অল্পচেনা গ্রামের নাম লামাগাঁও।
হিমেল হাওয়া, আপাত নির্জন গ্রামে একমাত্র থাকার ঠিকানা লামাগাঁও হোমস্টে। পিচ রাস্তার একপাশে হোমস্টে আর এক দিকে ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে গভীর খাদ। সেই ধাপে নানান অরগানিক ফসলের চাষ। খাদের ও পাশে মেঘের সমুদ্র। আর তারই ও পারে পাহাড়ের ঘেরাটোপ। দার্জিলিং পাহাড়ের প্রায় ৭টি চা-বাগান আর ম্যাল সমেত বেশ কিছু অংশকে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে থাকার জন্য রয়েছে একটি মাত্র হোমস্টে। মেঘ, রোদ্দুর আর কুয়াশার আবহে মোড়া লামাগাঁও থেকে দিনের নানা সময়ে দূরের দার্জিলিংকে নানা ভাবে আবিষ্কার করুন। প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ি গ্রাম, দিনের চেয়েও রাতে অনেক বেশি রোম্যান্টিক। তারা ভরা কালচে আকাশের নীচের লামাগাঁও আর দূরের দার্জিলিংকে অসাধারণ লাগে। পর দিন ভোরে লামাগাঁও-এর নির্জন পথে বেরিয়ে পড়ুন। খাদের ধারের উন্মুক্ত আকাশের নীচে কাঞ্চনজঙ্ঘার চিরনতুন দৃশ্য শুধুই রংবদলের বিস্ময়। গাছে গাছে পাখিদের মেলা। অর্কিড আর নানা পাহাড়ি ফুল দেখতে দেখতে কোথা থেকে সময় পেরিয়ে যাবে তা টের পাবেন না।
আরও পড়ুন: বেড়াতে যাচ্ছেন? জেনে নিন নানা জায়গার খুঁটিনাটি
কী ভাবে যাবেন:
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়িতে রোহিণী, কার্শিয়াং হয়ে ঘুম ৬২ কিমি। ঘুম থেকে বিজনবাড়ি ২৬ কিমি। এখান থেকে লামাগাঁও ১৩ কিমি। এনজেপি থেকে ভাড়া গাড়িতে চলে আসাই ভাল।
কোথায় থাকবেন:
এখানে থাকার জন্য রয়েছে লামাগাঁও হোমস্টে। ৭টি ঘর। যোগাযোগ: ৯৮৩২৬৬৭৫৭০। ভাড়া জনপ্রতি ২১০০ টাকা খাওয়া সমেত।
মাগুরমারি
পাহাড় থেকে এ বার চলে আসা যাক তরাই। উত্তরবঙ্গের গাজলডোবায় অনেকেই গিয়েছেন। খুব কাছেই, চলে আসুন গ্রাম পর্যটনের এক নতুন ঠিকানায়। দু’পাশে গহিন অরণ্য। আর তারই মাঝে বুক চিরেছে ঝাঁ চকচকে মিশকালো পিচরাস্তা। ঢুকে গিয়েছে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট ডিভিশনের আপালচাঁদ অরণ্যের মাঝে কাঠামবাড়ির জঙ্গল মোড়। ডান দিকে মখমলি কৈলাশপুর চা-বাগান, আর বাঁ দিকে ঘন জঙ্গলমহল। কাঠামবাড়ি অরণ্যর গা ঘেঁষে মেঠো পথের ধারে দেখা মিলবে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত। তারই মাঝে ওঁরাওদের গ্রাম মাগুরমারি। বাঁ দিকের গভীর শালের জঙ্গলে তারের ফেন্সিং। হাতি মাঝেমধ্যে হানা দেয়। ফসল নষ্ট করে।
মেরেকেটে ৩৮টি ওঁরাও পরিবার এই গ্রামে বসবাস করেন। আর এখানেই গড়ে উঠেছে চারটি কটেজ। সবুজে মেশা একেবারে গ্রাম্য পরিবেশ। বেশ কয়েকটি পুকুরে প্রচুর মাগুর মাছ, তাই গ্রামের নাম মাগুরমারি। গ্রামে ঢুকতেই ওঁরাওদের ট্র্যাডিশনাল পোশাকে, ধামসা-মাদল বাজিয়ে, ফুল ছড়িয়ে অতিথিবরণের প্রথা তাক লাগিয়ে দেবে। জঙ্গলের মাঝে শহরের কোলাহল থেকে নির্জন গ্রাম্য পরিবেশে। ওঁরাওদের প্রথা অনুসারে, অতিথিদের হাত ধুইয়ে দেন আদিবাসী মা-বোনেরা। খাবারের ডিশেও চমক।
সন্ধ্যে নামলেই কালচে নীলাভ আকাশ জুড়ে হাজার তারার ভিড়। বন থেকে মাঝে মাঝেই ভেসে আসে বনচরদের নানান গুরুগম্ভীর শব্দ। সেই রোমাঞ্চের মাঝে, ইচ্ছে হলেই আপনি মেতে উঠতে পারেন ওঁরাওদের সঙ্গে নাচে গানে। এদের নিজস্ব ভাষা কুরুক। এঁরা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন যত্নে।
শীতে মাগুরমারির ঝিলে প্রচুর পরিযায়ীর আনাগোনা। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা নৌকায় চেপে কাঠামবাড়ি জঙ্গলের অন্দরমহলে গাইড-সহ ঢুকতে পারেন। আদিম অরণ্যের গন্ধমাখা রোমাঞ্চকর পরিবেশে প্রায় ১২০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। বার্ডওয়াচারদের এক নতুন ঠিকানা হতে পারে মাগুরমারির কাঠামবাড়ির জঙ্গল। এখানে প্রচুর পুকুর রয়েছে। ইচ্ছে হলেই ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’। ট্র্যাডিশনাল নাচে মেতে উঠতে পারেন। এ জন্য অবশ্য ২,৫০০ টাকা আলাদা চার্জ লাগে। দু’-এক দিনের ছুটিতে মাগুরমারি ও তার জঙ্গলমহল নিঃসন্দেহে মন কেড়ে নেবে।
মাগুরমারি
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে দূরত্ব ৪৭ কিমি। মাগুরমারির নিকটবর্তী রেলস্টেশন ওদলাবাড়ি। এনজেপি থেকে ট্রেনে দূরত্ব ২১ কিমি। লাটাগুড়ি থেকে ২০ কিমি। গাড়িতেও চলে আসতে পারেন।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে মাগুরমারি ইকো ট্রাভেলার্স ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চারটি সুন্দর কটেজ রয়েছে। যোগাযোগ: ৯৮৩২৬৬৭৫৭০/ +91-353-2540-809, ভাড়া ১,৫০০ টাকা। খাওয়াদাওয়া ৪৫০ টাকা জনপ্রতি।
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy