Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
2019 Durga Puja Special Durga Puja 2019 Ananda Utsav 2019 travel

হিমাচলের জালোরি পাস হয়ে অল্পচেনা রূপকথার সোজা গ্রামে

হিমাচল প্রদেশে যে গিরিপথ শীতকালে বরফ পড়ে সবচেয়ে পরে বন্ধ হয় ও গরমে সবার আগে খোলে সেটাই জালোরি পাস।

অরুণাভ দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:৩৮
Share: Save:

হিমাচল প্রদেশের স্কি রিসর্ট নারকান্ডা থেকে অক্টোবরের এক ঝকঝকে সকালে রওনা হলাম জালোরি পাস ছুঁয়ে সোজা (Shoja) গ্রামের উদ্দেশে। আকাশে দোয়াত ওল্টানো নীল। বর্ষার ধারাস্নান শেষে প্রকৃতির সবুজ আঙরাখা ঝলমল করছে কাছে-দূরের পাহাড়ে। শরতের চরণচিহ্ন আঁকা উৎরাই রাস্তা প্রথমে কিছুটা কিন্নরের দিকে। জাতীয় সড়ক ৩৫৫। আগেও বেশ কয়েক বার গিয়েছি কিন্নরে। কিন্তু এখন রাস্তা আরও বেশি চওড়া। এক জায়গায় দু’টি পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে অনেক দূরে উঁকি দিয়ে গেল বরফচূড়া। রোডসাইড হোটেলে গাড়ি থামিয়ে ব্রেকফাস্ট। তার পর আন্নি থেকে নতুন দুনিয়ায়।

জালোরি পাসের দিকে আগে আসা হয়নি। কুমারসেইনে পথপাশে নদীর সঙ্গে প্রথম দেখা। রাস্তা ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে এলেও অবস্থা কিন্তু বেশ ভাল। এ দিকে ধসের আধিক্য নেই বললেই চলে। প্রকৃতির রূপ ক্রমশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে টানা চড়াই পথের দু’পাশে। মনজুড়ানো সবুজের সমারোহ। নীচে দিয়ে ফিতের মতো আঁকাবাঁকা নদী বয়ে গিয়েছে। কোথাও জনবসতির কমতি নেই। একে একে পার হয়ে যাই ছবির মতো সুন্দর গ্রাম কোহিলা, কারাদ ইত্যাদি। গ্রামে গ্রামে আপেলবাগানের প্রাচুর্য। অন্যান্য ফলের বাগানও রয়েছে। মহার্ঘ গোল্ডেন আপেল গাছ বাঁচাতে ফলভারে নুয়ে পড়া ডালপালা ঢেকে রাখা হয়েছে। দূর থেকে জামা পরা গাছের সারিকে বিচিত্র দেখায়।

খানাগ গ্রামটি বেশ বড় আর সম্পন্ন। নতুন ঘরবাড়ির ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে আগেকার দিনের কাঠ ও পাথরে তৈরি ঘর, ছাতে চৌকো স্লেট পাথরের চালা। খানাগ গ্রামের প্রান্ত থেকে ক্রমশ রাস্তা আরও খাড়া। জালোরি পাস ছুঁতে আর মাত্র কয়েক কিমিতে অনেকটাই উঠতে হবে আকাশপানে। শেষ দিকে মনোরম ও নিরাপদ অরণ্য। গাছগুলি ডালপালা মেলে যেন আকাশ ছুঁতে চায়। পাল্লা দিয়ে হাওয়ার বেগ ও শীতবোধ বেড়ে চলে। কোথাও পথ ভিজিয়ে কুলকুল করে বয়ে গিয়েছে ঝোরা। ঝাঁপিয়ে পড়েছে অতল খাদে। মাথার ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সাদা জামায় সজ্জিত আপেলবাগান দেখা যাচ্ছে অনেক দূরে, পাহাড়ের ঢাল থেকে মাথা জুড়ে। কত রং চারপাশে। যেন প্রকৃতির আপন হাতে সাজানো শারদাঞ্জলি। গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলি কিছু দূর অন্তর। আলো-ছায়ার আলপনা আঁকা রাস্তাটা যেন পাকে পাকে মায়ায় জড়াতে চায়। বনের ধার ধরে আরও কয়েকটা দুরূহ বাঁক অতিক্রম করে এক দৌড়ে জালোরির অঙ্গনে। দু’পাশে কয়েকটা অস্থায়ী দোকান। সামনে বাঁকের মুখে উঁচু বেদীর ওপরে মন্দির। রাস্তার ধারে কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। পর্যটকেরা ক্যামেরা বাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখতেই বুকের ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া কনকনে হাওয়া আমাদের স্বাগত জানাল। জালোরি গিরিবর্ত্ম দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ্য। আগে দেখা রোটাং বা কুনজুম পাসের উচ্চতার সঙ্গে জালোরি কোনও ভাবে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু তার আপন সৌন্দর্য অন্য রকম, অনুপম। শীতকালে আবার বরফ পড়ে এই রূপটাই কিছু দিনের জন্য আমূল বদলে যায়।

হিমাচল প্রদেশে যে গিরিপথ শীতকালে বরফ পড়ে সবচেয়ে পরে বন্ধ হয় ও গরমে সবার আগে খোলে সেটাই জালোরি পাস। কল্পা-সাংলার সঙ্গে কুলু-মানালির যোগাযোগের দরজা। জালোরি পাসের উচ্চতা ৩৮২০ মিটার বা ১০৮০০ ফুটের কিছু বেশি। নভেম্বর থেকে মার্চ বরফে ঢাকা থাকে। পাসের ওপর বাঁকের মুখে দেবী মহাকালীর মন্দিরে সবাই একটু থেমে ঘণ্টা বাজিয়ে আরাধনা করে যান। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠলে টিনের একাধিক চালা দেওয়া মন্দির। ঘন নীল আকাশের পটভূমিতে লাল পতাকার সারি পরিবেশকে রঙিন করে তুলেছে। কয়েকটি দাঁড়কাক উড়েই চলেছে মন্দির ঘিরে। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে জালোরি পাসের পরিচিতিমূলক সরকারি বোর্ডের ওপারে দিগন্তছোঁয়া রূপকথার জগৎ। মেঘহীন দিনে আকাশের নীলে হেলান দিয়ে রূপালি পর্বতচূড়ার সারি।

দেখার ফাঁকে পাশের দোকানে চলে যাই। তারপর মুখ চলতে থাকে অবিরাম। গরমাগরম মিল্ককেক বানানো হচ্ছে আর তুলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের প্লেটে। একই সঙ্গে চোখ, মন ও মুখের মহাভোজ সহজে মেলে না। দেখতে পেলাম, মন্দিরের পাশ দিয়ে আর একটা রাস্তা বেঁকে নেমে গিয়েছে। ওই দিকে সেরেলসর লেক ও মন্দির। ৫ কিমি হাঁটা, আরণ্যক পথে। সূচনা অংশে একটি টেন্ট রিসর্ট, শীতের বরফঢাকা কয়েক মাস বাদ দিয়ে খোলাই থাকে। আবার নিজেরা তাঁবু বহন করলে লেকের পাড়ে রাত কাটানো যায়। আবার মূল সড়কে জালোরি থেকে গাড়িতে কুলুর পথে নেমে গেলে প্রথম গ্রাম সোজা। ছবির মতো সুন্দর। টানা উৎরাই পথে পর পর এসে যাবে আরও ক’টি অপূর্ব গ্রাম, তীর্থন নদীর উপত্যকায়। ঘিয়াঘি, জিভি হয়ে বানজার, উপত্যকার একমাত্র শহর ও প্রাণকেন্দ্র। তারপর গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশলাল পার্কের দরজা ছুঁয়ে গুসাইনি। অট-এ কুলু মানালির চেনা সড়ক পেয়ে যাবেন। এ পথে যত দূরেই যান, জালোরি পাসের পরমা প্রকৃতির আকাশছোঁয়া অহঙ্কার মন-প্রাণ জুড়ে থাকবে অনেককাল।

আরও পড়ুন: কাঁধে হোল্ডল, রাতের মায়াবী ট্রেনে বাঙালি যেত বেড়াতে

জালোরির ঠিক নীচে ৫ কিমি দূরে সাড়ে ন’হাজার ফুট পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজের গভীর গহনে যেন গড়িয়ে গিয়েছে ‘সোজা’ নামে গ্রামটি। বরফঢাকা পর্বতশ্রেণির ছায়ায় পুরনো ও নতুন ঘরবাড়ির আশ্চর্য সমণ্বয়। সমতল জায়গা নেই বললেই চলে। পা ফেললে হয় চড়াই, নয়তো উৎরাই। সোজা গ্রামটি ছোট, কিন্তু অবস্থানগত কারণে আকর্ষক। ভূগোলের স্বৈরাচারকে ছাপিয়ে যায় নিসর্গের ইন্দ্রজাল। বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির নতুন নতুন উন্মোচন দেখা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই সোজা গ্রামে। সারা দিন আলস্যকে উস্কে দেওয়া দরাজ আয়োজন। স্লেট পাথরের ছাদওয়ালা পাথরের বাড়িগুলি প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই। কনকনে ঠান্ডা ও হু হু হাওয়ার ভেতরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়িয়ে দিন কেটে যায়। আশপাশে অরণ্যের বাহার এক কথায় অপূর্ব। দূষণহীন সোজা-য় বুক ভরে অক্সিজেন নিতে খুব ভাল লাগে।

কখনও অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার মন হলে সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট না করে সোজা-তেই চলে যাওয়া যেতে পারে। আশপাশেও দেখার জায়গা কম নেই। একমাত্র গাড়ি চলার রাস্তা জালোরি পাসের বিপরীত দিকে সোজা পাতালের পানে নেমে গিয়েছে তীর্থন নদীর অপরূপ উপত্যকায়। পথপাশের এক একটা গ্রাম ঘিয়াঘি, জিভি, বানজার, গুসাইনির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এক কথায় অপূর্ব। হিমাচল প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পর্যটকের ঢল নামে না বলে এ সব এলাকার প্রকৃতি আজও অকৃত্রিম। একের পর এক ফলের বাগান, খরস্রোতা নদীর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যমণ্ডিত মন্দির-দেবালয় নিয়ে জালোরি পাসের দু’পার এক অন্য রকম মায়ায় বাঁধে। মাত্র ২৫ টাকা কেজি দরে সুমিষ্ট আপেল বিক্রি হচ্ছে সর্বত্র। বাগানে ঢুকে অনুমতি সাপেক্ষে গাছ থেকে আপেল পেড়ে খেতেও কোনও বাধা নেই। হিমালয়ের এই অল্পচেনা গহন কোণে সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার সফরের এক বাড়তি পাওনা। প্রকৃতির মতো সকলের মুখে ভুবনভোলানো হাসি লেগে রয়েছে সারাবেলা। তাই এক বার গেলে বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছা করে।

আরও পড়ুন: বেড়াতে যাচ্ছেন? জেনে নিন নানা জায়গার খুঁটিনাটি

কোথায় থাকবেন: জালোরি পাসের লাগোয়া বুগিয়ালে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসে টেন্ট রিসর্ট তৈরি থাকে। নাম জালোরি টপ ক্যাম্প। বুকিংয়ের জন্য সরাসরি যোগাযোগের ফোন: ৯৮১৭৩১৫১১৪, ৯৮০৫৩১৫১১৪। সোজা গ্রামে রয়েছে রাজা গেস্টহাউস সমেত মধ্যম মানের কয়েকটি অতিথিনিবাস। বুকিং, প্যাকেজ ও গাড়ি ভাড়ার জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করা যেতে পারে: ৯৮১০৮০৬০৫৯।

ছবি: লেখক

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2019 Ananda Utsav 2019 Travel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy