রুক্ষতার মাঝেও অনন্ত রঙিন রাঢ় বাংলার রূপ অতুলনীয়
না, এ সফর এক বারের নয়, বছর চারেক ধরে নানান সময়, নানান ঋতুতে দেখা এই রুখাশুখা পুরুলিয়ায় এসেছি বারে বারে। রুক্ষতার মাঝেও অনন্ত রঙিন রাঢ় বাংলার রূপ অতুলনীয়। রাত ১১টা ৫ মিনিটের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে চেপে বরাভূম কিংবা ধর্মতলা থেকে ছেড়ে যাওয়া নাইট কুইনে সওয়ারি হয়ে দুয়ারসিনির মোড়ে নেমে টেন্টবাসী হয়েছি কুকুবুরু পাহাড়ের কোলে। হোটেল বা হোমস্টে থাকলেও প্রকৃতির কোলে থাকাটা আমার মতো অনেকের পছন্দের। তবে এ বার গাছবাড়ির টঙে দুটো দিন কাটালাম। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, তবে চেনা পুরুলিয়ার অল্পচেনা কিছু গন্তব্য আর কিছু উৎসব সম্পর্কে জেনে নিই। মূলত বরাভূম ঘিরেই এ সফর।
টুসু পরব
পাতলা রংদার কাগজ আর সালমায় সাজানো ঠাকরুনের সিংহাসন। একে ঘিরেই পরব। পাহাড়ের হাতায় আদিবাসী সমাজ নতুন জামাকাপড় পরে মেতে ওঠে উৎসবে। তারপর গ্রামের মেয়ে-বউদের মাথায় সেই চৌদোলায় ভাসান যায়। প্রতিটি মেলায় খাবারদাবারের পাশাপাশি মোরগ লড়াই দেখতে পাবেন।
পাহাড় দেবতার মেলায়
শীত জুড়ে আদিবাসী সমাজ নানান উৎসবে মেতে ওঠে, পুরুলিয়ার পাহাড় বা টাঁড় (পাহাড়) হলেন দেবতা। পুজোর তাগিদে রাঢ় বাংলার মানুষ পাহাড়ে চড়েন। আদিবাসীদের মঙ্গলকামনায়, সংসারে সুখশান্তি, সাচ্ছন্দ্যের কামনায় প্রবল শীত উপেক্ষা করে পুরোহিত চড়েন পাহাড়ের শিখরে। সঙ্গে চলেন বেশ কিছু অনুগামী। হাতে সফেদ মোরগ। সেই মোরগের গলা চিরে রক্ত ছড়িয়ে দেন পাথরের থানে। তারপর একটা পতাকা উড়িয়ে দেন অযোধ্যা পাহাড়ের শীর্ষে।
অযোধ্যা ও বাঘমুন্ডির জলের আধার খয়েরাবেড়া ড্যাম
সারাটা দিন ধরে চলে বুরু ঠাকুরের পুজো। পাহাড়ের নীচে চলে মেলা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক হলেও মেলার চরিত্রের অদলবদল হয়নি। মেলা জুড়ে নানান বৈচিত্র্য চোখে পড়বে। নানান উজ্জ্বল বর্ণের জামাকাপড় পরে গ্রামের মেয়েরা ভিড় জমান। চুলের ফিতে,দস্তার অলঙ্কার, শীতের জামাকাপড়, পাথুরে বাসন, চুল্লিতে তপ্ত জিলিপি, গজা, খাজা, জিলিপি, মুখোশ থেকে কোয়াক ডাক্তারের অস্থায়ী চেম্বার, প্রেমে সফলের বটিকা, তীব্র বশীকরণ মাদুলি,মোরগ লড়াই, কাঠের ঘোড়ার ঘূর্ণিতে দুরন্ত পাক খাওয়া কচিকাচাদের চিৎকার, শালের পাতায় আলুর বড়া-মুড়ি-ঘুঘনি আর কোথাও জাদুকরের জাদু। সব মিলিয়ে এক অন্য ভুবন। এক কথায়, সে দিন সারা দিন কেউ বাড়িতে থাকেন না। সব্বাই মাঠে আর মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ান।
কোথাও ঝুমুর, কোথাও ছো
সন্ধে নামতেই মেলা ভেঙে যায়। কিন্তু, সোনকুপি, ভচুংডি, দুয়ারসিনি সমেত পুরুলিয়ার নানান গ্রামে ম্যারাপ বা বাঁশের বেড়ার ঘেরাটোপে ঝুমুর গানের আসর বসে। না, বিখ্যাত শিল্পী নয়, গ্রামের সাধারণ পুরুষ-মহিলারা এই গানে অংশগ্রহণ করেন। বহু বছর ধরে এই গানের ধারা চলে আসছে। আগে পুরুষেরা এই গানে অংশগ্রহণ করত। পুরুষেরা মহিলা সেজে অংশ নিত। পরবর্তীতে মহিলারা অংশগ্রহণ শুরু করেন। বাঘমুন্ডির ভুচুংডি গ্রামের এমনই এক মেলায় হাজির হয়েছিলাম। গ্রামের কচিকাচা থেকে বুড়োবুড়ি সব্বাই হাজির। শুরু হল গানের আসর। প্রবল শীতেও গায়কীর উত্তাপ ছড়িয়ে। এমন উদাত্ত কণ্ঠ বহুদিন শুনিনি।
আজও অনেকেই ছো নাচের প্রশিক্ষণ নেন
পাশের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে ছো-এর বাদ্যযন্ত্রীদের আওয়াজ। বাঘমুন্ডির চড়িদা হল প্রবাদপ্রতিম ছো শিল্পী গম্ভীর সিংহ মুড়ার গ্রাম। এখানকার মুখোশ গ্রামের খ্যাতি জগৎজোড়া। কথিত আছে, গম্ভীর সিংহ তখন নিতান্ত বালক। বাবা জিপা সিংহ মুড়ার কঠিন প্রশিক্ষণের মুখে পড়তে হয়েছিল। পাহাড়ের হাতায় ক্ষেপা ষাঁড়ের সামনে অন্তত কুড়িটি করে জাম্প দিতে হত। তার সেই অধ্যবসায় আর কঠিন অনুশীলন তাঁকে খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। আজও অনেকেই ছো নাচের প্রশিক্ষণ নেন। গ্রামের খোলা ময়দানে চড়া হ্যালোজেনের আলোয় সাজানো হয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী পালা’। প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট মন্ত্রমুগ্ধের মতো রামায়ণের নানান চরিত্র তাঁদের অসম্ভব শারীরিক কুশলতায় ছো নাচের মাধ্যমে প্রদর্শন করলেন। এর পর আরও এক পালা আছে, রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা। তখনও মাঠের আল ধরে আসছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দল। তীব্র কুয়াশায় হলদেটে ফগলাইটের আলোয় বাঘমুন্ডির জঙ্গল ভেদ করে চললাম, টং ক্যাম্পে।
ঝর্না আর লেকের পাড়ে
পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু ঝর্না। সাত-সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। আপার ড্যাম পেরিয়ে এক সুন্দর গন্তব্য। কোনও পাকা রাস্তা নেই। আঁকাবাঁকা, সংকীর্ণ পথ পেরিয়ে অনেকটা নীচে নামতেই দেখা মিলল এক সুন্দর ঝর্নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বামনি ঝোরা। আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ভুলিয়ে দেবে। বামনি থেকে মেরেকেটে দেড় কিমি দূরে আরও এক ঝর্না। তবে বামনি ঝোরার মতো অতটা নামতে হল না। পাথরের খাঁজ বেয়ে নেমে আসছে তুরগা ঝর্না।
চারদিকে অনুচ্চ টাঁড় আর তার মাঝ বরাবর সরু রাস্তা পেরিয়ে চলে আসতেই দেখা মিলল বিশাল পাথরের চাতাল বেয়ে বয়ে আসা আরও এক ঝর্নার, ঘাঘকোঁচা।
আঁকাবাঁকা, সংকীর্ণ পথ পেরিয়ে অনেকটা নীচে নামতেই দেখা মিলল বামনি ঝোরার
গাঁদারঙা রোদে, গায়ে হলুদ দুপুরে লালমাটির প্রকৃতি উদার-উদাস। মাটিলেপা কাঁচাঘর, বাঁশবেড়া, খাপরা ছাদ, কুসুমগাছ, পলাশবন পেরিয়ে অযোধ্যা ও বাঘমুন্ডির জলের আধার খয়েরাবেড়া ড্যাম। এখানেই তুরগা লেক। আকাশপানের অসীম নীল হ্রদের হৃদয়ে। যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ীর দল সাঁতার কাটে অবলীলায়।
লহরিয়া শিবমন্দির আর ড্যাম দেখে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। মোটা চালের ভাত, সব্জি, আর তাজা মাগুরের ঝোল। এ বার কয়েরাবেড়া ড্যামের দিকে চড়িদা থেকে ১২ কিমি গেলেই টিলায় ঘেরা মাছকেন্দা নদীর জল ঘিরেই বাঁধ দিয়ে এক সুন্দর লেক। টিলার প্রতিচ্ছবি লেকের বুকে ভেসে ওঠে। জলে বিচিত্র বর্ণের পরিযায়ীদের ভিড়। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখব। তাই হিমেল হাওয়া সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পশ্চিম আকাশ সেজেছে আবিরের রঙে। সূর্য গেল পাটে। আকাশে ঝিকিমিকি অজস্র তারার আভাস।
দিনের চুরি যাওয়া আলোকে সঙ্গী করে আবার ফিরে এলাম, নতুন টাঁড়ের টঙ ক্যাম্পে
পরিশেষে টঙে
পাহাড়ের ও পিঠ থেকে কখন যে কাঁসার চাঁদ উঠে এসেছে তা টের পেলাম না। মহুয়া ফুলের গন্ধে ম ম মানভূমের প্রকৃতি। দিনের চুরি যাওয়া আলোকে সঙ্গী করে আবার ফিরে এলাম, নতুন টাঁড়ের টঙ ক্যাম্পে। ২০টি অত্যাধুনিক তাঁবু। তিনটি গাছবাড়ি। আমার ঠিকানা গাছবাড়ি। বিশাল কুসুম গাছের কোলে বসানো হয়েছে কুঁড়েঘর।
এর পর রুক্ষ পাহাড় ভেঙে আসা যাওয়া করা মানুষদের সঙ্গে শুধুই আড্ডা। গল্পে গল্পে রাত অনেক গভীর হয়।
প্রয়োজনীয় তথ্য: কলকাতা থেকে পুরুলিয়া আসার অনেক ট্রেন আছে। সবচেয়ে ভাল ৫৮০১১ আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে বরাভূম স্টেশনে নেমে গাড়িতে। উল্লিখিত নানান স্পট দেখে নিন।
নতুন টাঁড়ের টঙ ক্যাম্পে থাকার জন্য রয়েছে ২০টি বিদেশি টেন্ট। তিনটি গাছবাড়ি। টেন্ট ভাড়া ২২০০ টাকা ও গাছবাড়িতে ৩২০০ টাকা। খাওয়া প্রতিদিন জনপ্রতি ৫৫০ টাকা। যোগাযোগ: ৯২৩১৫৮১১৭৭ / ৬২৮৯৩৮২২৭৭।
(ছবি: লেখক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy