গহিন: দু’পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল
ঝাড়খণ্ডের গালুডির সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। মামাবাড়ি ছিল ঝাড়গ্রামে। তাই ছোট থেকেই গালুডির রূপ দেখার সুযোগ হয়েছিল। অস্তমিত সুবর্ণরেখার বুকে গালুডি ড্যামের দামাল রূপ মনোমুগ্ধকর। ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেনের আওয়াজকেও হার মানায় সেই জল ভাঙার শব্দ। আবার জলবায়ুর গুণে শীতের দিনগুলিতে এখানে ভিড় করতেন বহু পর্যটক। তখন অনেকেই শীতকাল এখানে কাটিয়ে ফিরে যেতেন। শীতের গালুডিকে এ ভাবে পরখ করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরটির সঙ্গে যোগযোগ কমে গিয়েছিল।
ছোটবেলায় দেখা পাহাড় সুবর্ণরেখা আর শাল, মহুয়া, শিমুল, পিয়ালের জঙ্গলে মোড়া অপরূপ গালুডিকে আবার দেখার টানেই এক হালকা শীতের ভোরে উঠেছিলাম ট্রেনে। হাওড়া থেকে ঘণ্টাতিনেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। রিসর্ট বুক করা ছিল। স্টেশনের বাইরে অপেক্ষমান গাড়িতে চেপে বসতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহুরে জনপদ পিছনে সরে গেল। পথের পাশে তখন শুধুই সবুজ। মাত্র আধ ঘণ্টার সফর শেষে গাড়ি পৌঁছে দিল রিসর্টের আঙিনায়। রিসর্টেই ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনারের ব্যবস্থা। বুকিং করে আসাই ভাল। রাস্তাঘাটে খাবারের দোকান প্রায় নেই। স্ট্রিট ফুড বা রেস্তরাঁ আজও গ্রাস করেনি নির্জনতাকে। আশপাশে ঘুরতে বেরোনোর আগে টুকটাক খাবার সঙ্গে রাখলে ভাল।
নস্ট্যালজিক সফরের শুরু সুবর্ণরেখার তীরে। সুবর্ণরেখার সে কী রূপ! অদূরেই গালুডি ড্যাম। সুবর্ণরেখায় ২১টি স্লুইস গেটের বাঁধ পড়েছে। আজও গালুডি একই রকম সুন্দর। এর পর নারোয়া পাহাড়। দলমা রেঞ্জের নারোয়া পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে একটা সুন্দর জায়গা, নাম তার পাথরভাঙা। সবুজ গাছপালায় মোড়া নারোয়া পাহাড় আর তার ঠিক নীচেই বড় বড় পাথরের সারিকে পাশ কাটিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক সুন্দর নদী, যার নাম গড়া। নারোয়া পাহাড় পেরিয়ে গড়া নদী গালুডির কাছে মিশে গিয়েছে সুবর্ণরেখায়। জলের শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দই নেই গোটা জায়গায়। আমরা ছাড়া কোনও জনমানবও নেই ত্রিসীমানায়। এই নারোয়া পাহাড় উচ্চমানের ইউরেনিয়াম-সমৃদ্ধ। ইউরেনিয়াম উত্তোলনের খনিও রয়েছে। এ বারে গাড়িতে করে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের অন্য প্রান্তে। কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে রঙ্কিণীমাতার মন্দির দর্শন করে, জাদুগোড়া মোড় থেকে বাঁ দিকের (ডান দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে ঘাটশিলার দিকে) রাস্তা ধরে পৌঁছলাম গড়া নদীর উপরে নির্মিত সেতুতে। এখান থেকে গড়া নদীর সর্পিল গতিপথ বেশ অনেকটাই দেখা যায়। খানিকটা এগোলে বাঁ দিকের কাঁচা সড়ক দিয়ে যাওয়া যায় নদীর কাছের পিকনিক স্পটে। কিন্তু আঁধার নামছে। অগত্যা ফিরতেই হল।
পর দিন ঝাড়গ্রামের দিকে এগোতেই খুঁজে পেলাম শাল, মহুয়া, পলাশে ছাওয়া আর-একটি পাহাড়ি উপত্যকা ধলভূমগড়। লোকাল ট্রেন বা বাসও যায় এই পথে। এখানকার সুন্দর প্রকৃতির মাঝে নল রাজাদের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। নহবতখানা, রাসমঞ্চ, দু’টি মন্দিরও আছে। শালের আড়ালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক রানওয়েটি আজও বিস্ময়কর। এখানে অন্য রূপে পেলাম সুবর্ণরেখাকে, রেল স্টেশন থেকে মোটে এক কিলোমিটার দূরেই। সে দিন ছিল রবিবার, হাটটি ছিল বাড়তি পাওনা। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র কিনে ঘণ্টাখানেকের পথে পৌঁছে গেলাম প্রকৃতির কোলে, গোটাশিলা পাহাড়ে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটা, সঙ্গে বিভিন্ন পাখির আওয়াজ। পাথুরে রাস্তায় পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম অদ্ভুত নিঝুম পাহাড়ের ঢালে। পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা ঝোরা আর সঙ্গে জঙ্গলের মাদকতা মেশানো এক অদ্ভুত গন্ধে বিভোর হয়ে গেলাম।
ফেরার পথে আদিবাসী গ্রাম। মূলত সাঁওতালদের বাস। পর পর সাঁওতাল গ্রামই চোখে পড়বে। গ্রামবাসীদের মাটির বাড়ি, সহজ-সরল জীবনযাত্রা। বাড়িগুলির সুন্দর অলঙ্করণ বেশ চোখ টানে। ইতিউতি চোখে পড়ল, কৌতূহলী গ্রামবাসী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শহরের মানুষের দিকে। পৌষসংক্রান্তিতে এখানে ‘টুসু’ পরব উপলক্ষে উৎসব হয়। আর ফাল্গুন মাসে ‘বাহা’ পরবে মেতে ওঠেন অঞ্চলের মানুষজন। সে সময়টা এলে তো সোনায় সোহাগা!
এখান থেকে খড়্গপুরের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। সেই পথে ধরেই কলকাতা ফিরলাম একরাশ মধুর স্মৃতি সঙ্গে করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy