১৯৮৪ সালে যখন গৌরচন্দ্র সাহার রবীন্দ্র পত্রাবলী: তথ্যপঞ্জী প্রথম প্রকাশিত হল, রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসুদের কাছে সে এক অভিনব বার্তা বহন করে এনেছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের নানা জনকে লেখা চার হাজার চিঠির হদিশ দিয়েছিল সেই বই। সঙ্গে ছিল প্রাপক ও চিঠির বিষয়বস্তুর নির্দেশ। সঙ্কলক ভূমিকায় জানিয়েছিলেন, ‘‘প্রধান প্রধান পত্র- পত্রিকায় এ-যাবৎ প্রকাশিত রবীন্দ্রপত্রাবলীর একটি কালানুক্রমিক তথ্যপঞ্জীরূপে এই গ্রন্থের অবতারণা।’’ এর বাইরে যে আরও অনেক চিঠি রয়ে গেল— সে প্রসঙ্গে সঙ্কলক জানিয়েছিলেন তাঁর সংকল্প, দ্বিতীয় খণ্ডে সেগুলির পঞ্জিকরণ। দ্বিতীয় খণ্ড রূপে নয়, এই গ্রন্থের একক বৃহদায়তন সংস্করণ এ বার আমাদের হাতে পৌঁছেছে।
সর্ব মোট ৭৫১৪টি প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত (রবীন্দ্র ভবন, শান্তিনিকেতন সংগ্রহ) চিঠির সুলুক সন্ধান দিয়েছে এই গ্রন্থ। এই বিশাল গ্রন্থটি অনুসন্ধিৎসুদের কাছে প্রতিটি পত্রের প্রাপক ও বিষয়ের সন্ধান নিষ্ঠা ভরে দিয়ে চলে। সঙ্কলক চিঠির তারিখের ক্রমানুসারে অগ্রসর হয়েছেন। প্রথম সংস্করণের মতোই এই গ্রন্থের এক অমূল্য সম্পদ বিষয় নির্দেশিকাটি— যার অন্তর্গত হয়েছে ব্যক্তিনাম, গ্রন্থ ও পত্রিকা, বিবিধ।
সনিষ্ঠ গবেষক এখানেই থামতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি চিঠি নিয়ে কাজও তাঁর অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু সে কাজটি বাকি রয়ে গেল বলে আমাদের মন হায় হায় করে। এই বিচক্ষণতায় যদি তিনি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি চিঠির সঙ্কলন করতে পারতেন তা হলে তাও রবীন্দ্রচর্চার অমূল্য সম্পদ হত। খুব ভাল হয় যদি বিশ্বভারতী নিজেই রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি চিঠিগুলির পঞ্জিকরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনাথ তো শুধু বাঙালির নন। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে বহু বিদেশি রবীন্দ্র- জিজ্ঞাসু ও গবেষকের জন্যও এই পঞ্জিকরণ একান্ত আবশ্যক। এ দেশের রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসুদের জন্যও তার প্রয়োজন অল্প নয়।
রবীন্দ্রপত্রপ্রবাহ ও তথ্যপঞ্জী/ কালানুক্রমিক
গৌরচন্দ্র সাহা
১২০০.০০, আশাদীপ
মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরু এবং ভীমরাও অম্বেডকর— যাঁদের কালপর্ব রবীন্দ্রনাথের অনেক পরে শেষ হয়েছে— তাঁদের সম্পূর্ণ রচনা সম্ভার অনেক দিন ধরেই পাঠকের কাছে সুলভ। শুধু অধরা রইলেন রবীন্দ্রনাথ! স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এই বঞ্চনা কেন?
আলোচ্য গ্রন্থের প্রথমেই আছে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের একটি ভূমিকা। গভীর অভিনিবেশ ও আন্তরিকতার নিদর্শন সেটি। ভূমিকায় তিনি গ্রন্থটির সম্পূর্ণ পরিচয় দিয়েছেন এবং মূল্যায়ন করেছেন। কয়েকটি কথার উল্লেখ করি, ‘‘বিগত একশত বছরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে দেশে বিদেশে যত মূল্যবান পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা-কর্ম হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম পাঁচটি বইয়ের একটি হল এই বর্তমান গ্রন্থ। বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবনে দশ হাজারেরও অনেক বেশি চিঠি লিখেছেন। কেবল বাংলা ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রের সংখ্যা সাত সহস্রাধিক। দিনে দশ-বিশটা বড় বড় চিঠি, ছিন্নপত্রাবলীর মতো চিঠি রবীন্দ্রনাথ দিব্যি অনায়াসে লিখে ফেলতে পারতেন। কোনো দিন গল্প কবিতা না লিখলেও কাউকে না কাউকে চিঠি অবশ্যই লিখেছেন।’’ প্রাপক সংখ্যা সম্ভবত সাতশোর অধিক। কবির নিজের কথায়, ‘‘আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি। প্রত্যেকের কাছে আমার style ভিন্ন।’’
রবীন্দ্রপত্র প্রসঙ্গে চার দশক আগে অমিতাভ চৌধুরীর রবি ঠাকুরের পাগলা ফাইল (১৩৮৬ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থের মন্তব্যটিও স্মরণীয়, ‘‘বাংলা দেশের প্রতিটি জেলা, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, ইউরোপ আমেরিকার নানা শহর থেকে এমনি অসংখ্য চিঠি ভারাক্রান্ত করেছে কবির খাস দপ্তর। বিখ্যাতদের পাশাপাশি অখ্যাতদের দল— এক কৌতুককর সমাবেশ... পত্রদাতা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের বিস্ময়। এই বিপুল সৃষ্টি আর বিরাট কর্মকাণ্ডের মধ্যেও একজন মানুষের পক্ষে এত চিঠি লেখা অভাবিত। বিশ্বভারতী খণ্ডে খণ্ডে তাঁর চিঠিপত্র প্রকাশ করছেন। কিন্তু যে ঢিমেতালে এই প্রকাশনা চলছে, তাতে শুধু বাংলা চিঠি ছাপতেই কবির দ্বিশতবার্ষিকী এসে যাবে। তারপর ইংরেজি চিঠির পাহাড় তো পড়েই আছে।’’ দ্বিশতবর্ষ আর কত দূর? বিশ্বভারতী কি নড়বে?
সে কালে পত্রপ্রাপক চিঠির উত্তর দেবেন না এটা ছিল বিরল ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেটা তো একেবারেই অসম্ভব, সে চিঠি কাজের হোক, কৌতূহলের হোক, তাঁর কোনও রচনা বিষয়ক জিজ্ঞাসা বা বিতর্কমূলক হলেও উত্তর যাবেই। তিনি বন্ধু ও পরিচিতজনদের চিঠি যেমন পেয়েছেন, পেয়েছেন বিরোধীপক্ষেরও, উত্তর পৌঁছেছে যথাযথ ভাবে। অপরিচিত কোনও শিশুর চিঠিও তাঁর কাছে কোনও দিন অবহেলার সামগ্রী হয়ে থাকেনি, তাঁর রচনার দাবি থাকলেও রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই সে দাবি পূরণ করবেন। জালিয়ানওয়ালা বাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উত্তর-ইতিহাস পাঠকের মনে পড়বে, সে সময় রাজরোষে পড়ার ভয়ে দেশনেতারা শুধু মুখে নয় দুয়ারেও কুলুপ এঁটেছিলেন। অসহায় দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে দেশনেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে সঙ্গিহীন হতাশ কবি শেষ পর্যন্ত বিদেশি শাসকের বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন চিঠির মাধ্যমেই তাঁর ধিক্কার জানাতে।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কিশোরী রানু প্রথম চিঠিতে ‘প্রিয় রবিবাবু’ সম্বোধনে তাঁকে লিখেছিল, ‘‘আচ্ছা জয়পরাজয় গল্পটার শেষে শেখরের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল। না? কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল। আপনি লিখে দেবেন যে, শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হল। কেমন? সত্যিই যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে, তবে আমার বড় দুঃখ হবে।’’ উত্তরে ‘জয়পরাজয়’ গল্পের নায়ক শেখরের মৃত্যু ঘটানোর জন্য ১৯ অগস্ট গল্পলেখককে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল, ‘‘শেখরের কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করেচ। রাজকন্যার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার বিয়ে হত কিন্তু তার পূর্ব্বেই সে মরে গিয়েছিল। মরাটা তার ভুল হয়েছিল কিন্তু সে আর তার শোধরাবার উপায় নেই। যে খরচে রাজা তার বিয়ে দিত সেই খরচে খুব ধুম করে তার অন্ত্যেষ্টি সৎকার হয়েছিল।’’
ছাপার ভুল এবং সঙ্কলকের ভ্রান্তি এই দু’য়ে মিলে ত্রুটি-বিচ্যুতি যা আছে এই গ্রন্থে তার পরিমাণও খুব সামান্য নয়। এই অমূল্য গ্রন্থটি পরবর্তী সংস্করণে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নেওয়া একান্ত উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে সঙ্কলক-সম্পাদক আর আমাদের মধ্যে নেই, সুতরাং প্রকাশককেই এই সংশোধনের দায়িত্ব নিতে হবে। যত দিন চর্চায়, গবেষণায় বা আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, এ বইয়ের চাহিদা তত দিনই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy