Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
book review

‘বেংগলি শিখিয়ে দাও, ভাল করে’

তবু তেতে ওঠে ভাষা-রাজনীতি। ‘বাঙালি খেদাও’ হয়, আগুন জ্বলে, ছিন্ন হয় মাথা, শরীর, বন্ধুতা, প্রেম।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:৫৫
Share: Save:

রক্তে রেখে গেছে ভাষা: ১
সঙ্কলন ও সম্পাদনা: সুশীল সাহা
৩৫০.০০
ধানসিড়ি

বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি গল্প সঙ্কলন তৈরির প্রয়াস এই বই, শুরুতে লিখছেন সম্পাদক। উদ্দেশ্য: “ভাষার প্রতি টান ও অবহেলা, সেই সঙ্গে দ্রোহকালের একটি ভাষ্য রচনা।” দুই খণ্ডে পরিকল্পিত গল্পবইয়ের প্রথমটিতে অসম ও বাংলাদেশের ছাব্বিশটি ছোটগল্প। বাংলাদেশের লেখক তালিকায় শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নাসরীন জাহানের মতো খ্যাত লেখক-নাম, তুলনায় ‘অসম’ অংশের লেখকেরা ‘অচেনা’। কিন্তু গল্পগুলি পড়তে গিয়ে মনে হয়, অচেনা অপর কি আসলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার মধ্যেকার কেন্দ্র ও প্রান্তের দগদগে রাজনীতিটাই বেআব্রু করে দেয় না? সত্যিই তো, “একুশের শহিদ সালাম বরকত যত চেনা, উনিশের কমলা শচীনকে চেনে কতজন!” (তৃতীয় ভুবনের রূপকথা/রণবীর পুরকায়স্থ)

‘অসম’ অংশের গল্পগুলি কারুণ্য ও কাঠিন্যে পাঠককে দাঁড় করায় দুর্বিষহ প্রশ্নের সামনে। দুই প্রধান বঙ্গভূমি, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গল্পগুলি পড়লে গ্লানি ও অপরাধবোধে ভুগবেন— বরাক উপত্যকা-সহ অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাংলাভাষীদের ভাষিক সংগ্রাম ও জীবনযন্ত্রণাকে যথাযথ গুরুত্বে স্বীকার না করার গ্লানি, ভুলে যাওয়ার অপরাধবোধ। হিন্দু-মুসলমান ধর্ম ও দেশভাগ প্রসঙ্গে বাংলায় সাহিত্যকৃতি ও কীর্তির ছড়াছড়ি, কিন্তু অসমে ভাষা-সংস্কৃতি আলাদা হয়েও যে বহু কাল গলাগলি করে ছিলেন বাঙালি ও অসমিয়ারা, সে ইতিহাস মূলধারার বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই পায় কই? “চাকরিসূত্রে যখন কলকাতায় থাকতাম, তখন আমি নানা শব্দ বা বাগ্‌বিধির ব্যবহারে এমন কিছু বলে ফেলতাম, ওরা শুনে বলত, তুমি অসমিয়া মিশিয়ে কথা বলছ। আমি আপত্তি করতাম। বলতাম মোটেও না। আমি যেটা বলছি, সেটা অসমের বাংলা। সত্যিই তো। অসমের ভাষা-সংস্কৃতি কি আমার বাঙালিত্বকে একটা আলাদা মাত্রা দেয়নি?” (মুকুন্দ পাটগিরি, প্রিয়বরেষু/ মলয়কান্তি দে)

তবু তেতে ওঠে ভাষা-রাজনীতি। ‘বাঙালি খেদাও’ হয়, আগুন জ্বলে, ছিন্ন হয় মাথা, শরীর, বন্ধুতা, প্রেম। ভাষা রক্তে থেকে যায় ঠিকই, রক্ত ঝরিয়েও যায়। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বা একষট্টির উনিশে মে-তে বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনে মূলগত তফাত নেই, আছে উত্তরপ্রজন্মের প্রতিক্রিয়ায়। আছে আশা ও আশঙ্কা। “বেংগলি শিখিয়ে দাও না, খুব ভালো করে”, দাদুর কাছে নাতির আবদার (মোদের গরব মোদের আশা/ বিজয়া দেব) মিলেমিশে যায় ইংরেজি ভাষাভাষী দেশে জন্ম নেওয়া ছেলে প্রকৃতির বাংলা শিখতে কলকাতা তথা শান্তিনিকেতন আসার ইচ্ছেবিন্দুতে। ম্যান্ডারিন-বলিয়ে বান্ধবীর বাবা-মার সঙ্গে সে ভাষায় কথা বললে তাঁরা খুশি হবেন, কিন্তু তারও আগে ভাল করে বাংলা ভাষাটা শেখা চাই, কারণ ‘ভাষার শিকড় আর প্রেমের শিকড় একসঙ্গেই শক্ত ভিতের ওপর’ গড়তে হয় (ভাষা না প্রেমের শিকড়/ সাদ কামালী)। বাংলা গল্পের ভুবনে স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে, বাস্তবের ঘনঘোর ভাষিক ক্রান্তিকালেও।

‘অসম’ পর্বের গল্পগুলির টান অনুভূতির প্রাবল্যে, ‘বাংলাদেশ’ অংশের গল্পগুলি ছোটগল্পের প্রকরণের সুপ্রয়োগে উজ্জ্বল। এপ্রিলফুল গাছের জাদুবাস্তব চিত্রকল্পের হাত ধরে থাকে জিশু ও ভাষাবিদ্রোহীদের মিলিয়ে দেওয়া আশ্চর্য কলম। আর সেই চরিত্ররা— এক রাতে শহিদ মিনার গড়তে হাত লাগানো মেয়ের দল, গায়ে হলুদ ছেড়ে মিছিলে আসা বীথি, ফি-বছর ঘড়ির কাঁটা একুশে ফেব্রুয়ারি ছুঁলে শহিদ মিনারে চলে আসা জয়নাল— সবাইকে খুব আপন মনে হয়, বাংলা ভাষার মতোই। এ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের বাংলা ছোটগল্প ঠাঁই পাবে, জানা গেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy