শিল্পসুষমা: ঢাকাই জামদানিতে সাঁওতাল উৎসবের রূপায়ণ
দি ইন্ডিয়া ওয়ে: স্ট্র্যাটেজিজ় ফর অ্যান আনসার্টেন ওয়ার্ল্ড
সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর
৬৯৯.০০
হার্পারকলিন্স
দু’বছর আগে, জয়শঙ্কর যখন বিদেশসচিব পদ থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন, তখনও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি তাঁর পদের তুলনায় বেশি পরিচিত ছিলেন পারিবারিক সম্পর্কের জন্য। তাঁর ভ্রাতা সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলিস-এ অধ্যাপক। তাঁর পিতা কে সুব্রহ্মণ্যমকে বলা হয় ভারতের ‘পারমাণবিক রণনীতির স্থপতি’। স্ট্র্যাটেজিক বিজ্ঞানের এই পণ্ডিতটির নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ব্যতিরেকে, ১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পক্ষে এক নড়বড়ে জোট সরকার নিয়ে, বড় বিশ্বশক্তিদের হাড়ে চটিয়ে ‘পোখরান-২’ পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করা সম্ভব হত না, হিন্দুত্ববাদী দলের বীরত্ব প্রদর্শনে তাঁর যতই আগ্রহ থাকুক না কেন।
অবতরণিকাটি ঈষৎ দীর্ঘ হলেও প্রয়োজন ছিল। সুব্রহ্মণ্যম পরিবারে আছে ব্রাহ্মণ্য পাণ্ডিত্য ও ক্ষাত্র যুদ্ধবৃত্তির এক মিশ্রণ। পোখরান-২’এর সমর্থনে পিতা সুব্রহ্মণ্যম দেশে-বিদেশে বিতর্কের আসর মাত করে দিয়েছিলেন। পারমাণবিক অসি প্রদর্শন যাঁদের মতে মানবিকতার বিরোধী, তাঁরা পাত্তা পাননি সুব্রহ্মণ্যমের বিস্ফোরক যুক্তির সামনে। পুত্র জয়শঙ্কর রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন আরও সরাসরি। বিদেশসচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে বছর না ঘুরতেই তিনি বিজেপি-তে যোগদান করেন, এবং তৎক্ষণাৎ গুজরাত থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়ে একেবারে বিদেশমন্ত্রী। তিনি বিদেশসচিব হয়েছিলেন ২০১৫ সালে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ অনুমোদনে; অবসর গ্রহণের দু’দিন আগে তাঁর পূর্বসূরিকে বিদায়ের চিঠি ধরিয়ে তাঁকে সেই আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। যিনি বড়কর্তার হুকুমে এত কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, সেই প্রয়াত সুষমা স্বরাজের আসন এখন অধিকার করেছেন জয়শঙ্কর। আজ পাঁচ বছর তিনি ভারতের বিদেশ নীতির স্তম্ভ।
তবে সত্যই কী তিনি নীতিপ্রণেতা, না কি আর সব নেতার মতোই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ, এই দুই বটবৃক্ষের ছায়ায় শুধু এক বাহারি লতামাত্র? এই বইটিতে যাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি না পিতার মতো খোলাখুলি রণং দেহি বুদ্ধিজীবী, না ভ্রাতা সঞ্জয়ের মতো অবিমিশ্র পণ্ডিত। তাঁর ‘ইন্ডিয়া ওয়ে’-তে অবশ্য বর্ণচ্ছটা বিদ্যমান শৌখিন লতার মতোই। আছে পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত থেকে অজস্র ব্যাখ্যান, যা যুগপৎ চিন ও পাকিস্তানের চাপে ভারতের সঙ্কটময় পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করুক বা না করুক, নিশ্চয়ই তৃপ্ত করবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদী নেতাদের। আরও যা তাঁদের তৃপ্ত করবে, তা আগের আমলের বিদেশনীতির সঙ্গে হাল আমলের একপেশে তুলনা। “১৯৯৮ সালের পরমাণু পরীক্ষায় শেষ হল তার আগের দু’দশকের সিদ্ধান্তহীনতা। ২৬/১১ হামলার পর প্রত্যুত্তরের যে অভাব ছিল, উরি বা বালাকোটের হামলার পরের জবাবের সঙ্গে তার পার্থক্য স্পষ্ট।”
জয়শঙ্কর সোজাসুজি বলেননি যে, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ে আতঙ্কবাদী হানার পর কী হওয়া উচিত ছিল ভারতের সঙ্গত জবাব। কিন্তু তৎকালীন বিদেশসচিব শিবশঙ্কর মেনন বলে আসছেন, ওই সময়ে সামরিক জবাব দিলে তার পরিণাম ক্ষতিকর হত। কারণ, রাষ্ট্রপুঞ্জ তখন ঘটনাটিকে পাকিস্তান-চালিত সন্ত্রাসবাদের হামলা এবং তার ভারতীয় প্রতিক্রিয়া হিসেবে না দেখে বরং আর এক ভারত-পাক ‘ঝামেলা’ বলেই নথিভুক্ত করত। তা ছাড়া, ২০০৮ সালে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থায় লাগামছাড়া বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক বড় আকারের যুদ্ধের খরচ বহনের সামর্থ্য যে তখন ভারতের ছিল না, সে কথা মেনন অকপটেই ব্যক্ত করেছেন। তখন বিদেশ মন্ত্রকে উচ্চপদে আসীন জয়শঙ্কর সে কথা জানতেন না, তা নয়। সম্ভবত, তিনি এখন তাঁর সদ্যগৃহীত রাজনৈতিক চশমা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন ঘটনাবলি।
তবে, জয়শঙ্করের এক স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে সময়ের সুদীর্ঘ প্রবাহকে ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে সাজিয়ে তোলার। ১৯৫০ সালে চিনের তিব্বত দখল, সেই সময়েই চিন সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুকে সতর্ক করে সর্দার বল্লভভাই পটেলের কড়া বার্তা, দলাই লামার ভারত আগমন, ১৯৬২ সালে ভারতে চিনা আক্রমণ, প্রায় তখন থেকেই সূত্রপাত চিন-পাকিস্তান সখ্যের। তার পর ১৯৭০-এর দশকের সূচনায় এক দিকে যেমন পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডীকরণ, অন্য দিকে পাকিস্তানকে সেতু হিসেবে ব্যবহার করে মার্কিন বিদেশসচিব হেনরি কিসিঞ্জরের গোপন দৌত্যের ফলে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চিন গমন, মাও জে দং-এর সঙ্গে তাঁর আলোচনা, এবং তারই ফলস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এ সম্পূর্ণ নতুন মোড়। সবই পরিচিত তথ্য, কিন্তু লেখক তা ব্যবহার করেছেন নানা ক্ষেত্রে, এমনকি মহভারত-এর কাহিনির রূপক নির্বাচনের মধ্যেও। উপস্থিত করেছেন ত্রিগর্ত অধিপতি সুসরমাকে। এমন কিছু পরাক্রমশালী বীর না হয়েও পাণ্ডবদের প্রতি অন্ধ ক্রোধবশত তিনি বড় ক্ষতিসাধন করেন তাঁদের। অর্জুনকে তিনি দ্বৈরথে আহ্বান করে সরিয়ে নিয়ে যান মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তা-ও এমন সময়ে, যখন অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু প্রবেশ করেছে কৌরব চক্রব্যূহের মধ্যে। তার থেকে পরিত্রাণ সম্ভব শুধু তৃতীয় পাণ্ডব ও পিতা অর্জুনের গাণ্ডীব জাদুতেই, কারণ কৌরব পক্ষে যুদ্ধরত সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের ‘কৃপা’য় সেই চক্রব্যূহ ভেদ করা অর্জুন ব্যতীত অন্য পাণ্ডব ভ্রাতাদের অসাধ্য। অথচ, অর্জুন তখন সুসরমার ছলে অনুপস্থিত। তারই ফল অভিমন্যুর মৃত্যু। জয়শঙ্করের মতে, এই মাইনর ভিলেনের বর্তমান রূপ হল পাকিস্তান। যতই সুদূরপ্রসারী হোক ভারতের কল্পনা ও দৃষ্টি, তাকে ওই একমুখী শত্রু কোনও না কোনও ভাবে বিপদে ফেলার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে সর্বদা।
জয়শঙ্কর কিন্তু বিদেশনীতি নিয়ে সরকারের ভাবনার বিন্দুমাত্র আভাস দেননি এই বইয়ে। ভারত, চিন, আমেরিকা এবং পাকিস্তান— রূপকের মোহিনী আড়াল পরিত্যাগ করে এই চতুষ্টয়ের সম্পর্কের কঠোর বাস্তবিকতাটি তিনি জানিয়েছেন। হাবেভাবে বুঝিয়েছেন, একা চিনের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়, তার জন্য চাই একটি শক্তি বলয়ের মধ্যে ভারতের উপস্থিতি। সেই শক্তি বলয় হবে ‘ইন্ডো-প্যাসিফিক’, যার ভরকেন্দ্র অবশ্যই হবে আমেরিকা। কিন্তু সেই বলয়ের মধ্যে থাকা চাই জাপানেরও, যা এশিয়ার আর এক বলশালী অক্ষ। ঠিক কী চাইছেন জয়শঙ্কর? আমেরিকা-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়াসহ চিনবিরোধী ‘কোয়াড’-এর দ্রুত সামরিকীকরণ, যা ভারতের বিদেশমন্ত্রী হওয়ার দরুণ তিনি অন্য দেশে, বিশেষ করে চিনে, প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে মুখ ফুটে বলতে পারছেন না?
জয়শঙ্করকে নিয়ে সমস্যা সেইখানেই। তিনি আরএসএস-এর আদর্শ অনুযায়ী বিদেশনীতিতে ক্ষাত্রধর্মের অনুগামী, অথচ তার উপযুক্ত ক্ষাত্রশক্তিতে ভারতে খামতি আছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, গত দুই দশকে চিনের উত্থান হয়েছে ভারতের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি, এবং চিন ভারতে যত রফতানি করে, তার মূল্য ভারত থেকে চিনের রফতানির চার গুণ বেশি। শক্তির অসাম্য ও চিনের পেশি প্রদর্শন— এই দুই কারণেই উঠছিল কোয়াডের কথা। এবং তাতে মৌখিক (কাজে নয়) মদত দিচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু নভেম্বর নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় এবং চিন সম্পর্কে নিরপেক্ষ বলে কথিত জো বাইডেনের হোয়াইট হাউসে আগমনের পর কী হবে ওই চারমুখী জোটের? এ দিকে, এশিয়ায় এক চিনকেন্দ্রিক নতুন বাণিজ্য জোট হয়েছে, যেখানে কিন্তু জাপান সদস্যপদ গ্রহণ করেছে হাসিমুখে, অথচ চিনের সঙ্গে প্রকৃত সীমান্তরেখা বরাবর সাত মাসব্যাপী সামরিক উত্তেজনা বহাল রয়েছে বলে ভারতের পক্ষে সেই জোটে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। এর ফলে ভারতের আপেক্ষিক গুরুত্ব শুধু এশিয়া নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও পিছিয়ে পড়বে। সত্য হল, ভারত তার নিজ অঞ্চলে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে জয়শঙ্করের দলের ক্ষমতায় আগমনের পর থেকে। মানুষটি পুরাণ ও সংস্কৃতি নিয়ে সচেতন, কিন্তু ড্রাগনের থাবা থেকে কেমন করে নিস্তার পাবেন, সেই সম্পর্কে তিনি নিশ্চুপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy