বলজিতদের টপকে পেদ্রোর শট গোলে। শুক্রবার কোচিতে। ছবি: আইএসএল
কেরল ব্লাস্টার্স- ২ (হিউম, পেদ্রো)
আটলেটিকো দে কলকাতা- ১ (ফিকরু)
ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে কেরল ব্লাস্টার্সের টিমবাস স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় দেখা গেল, সামনের সিটেই গোলকিপার ডেভিড জেমস। হাঁটু মুড়ে কোনওক্রমে ড্রাইভারের সিটের পাশেই বসে। চোখে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টি!
ম্যাচ শেষের দশ মিনিট পরেও কেরল ব্লাস্টার্সের গোলের সামনে দেখলাম, ও রকম ভাবেই হাঁটু মুড়ে এক জন বসে। থমথমে মুখ, মাথা নিচু। কলকাতার আটলেটিকোর স্কোরার ফিকরু তেফেরা।
কোচি স্টেডিয়াম হলুদ রংয়ে ভাসছে। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে স্রোতের মতো টিমমেটরা এসে কোলে তুলে নিচ্ছে এক-এক জন কেরল ফুটবলারকে। মাটিতে শুয়ে আটলেটিকো অধিনায়ক হোসেমি। তাঁর পাশ দিয়েই কেরল ব্লাস্টার্সের পতাকা নিয়ে ছুটে গেলেন রোমি। পিছনে সৌমিক দে।
ম্যাচের শুরু এবং শেষের পাঁচ মিনিটের কেরল-ঝড় এ রকম বিপরীত দৃশ্য তৈরি করে দিল কোচিতে। ষাট হাজারের গ্যালারিকে সাক্ষী রেখে।
ফিকরু শুরুতেই একটা ওয়ান-টু-ওয়ান পরিস্থিতিতে বাইরে মারলেন। হাফটাইমের পর সেটা পুষিয়ে দিলেন ঠিকই। তবে আইএসএলে অবশেষে ফিকরুর গোলে ফেরার পিছনে বেশি অবদান কেরল ক্যাপ্টেন হেংবার্টের। আসলে গোল না করে-করে ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকারের আত্মবিশ্বাস এমন তলানিতে যে, আজ গোল পাওয়ার পরেও অবিশ্বাস্য মিইয়ে থাকলেন! তবু আটলেটিকোর শনিবাসরীয় হারে ফিকরুর নাম লেখা থাকবে না। থাকবে কোচ হাবাসের নাম! তাঁর চেয়েও হয়তো বেশি থাকবে উজবেক রেফারি রবশান ইর্মাতভের নাম!
প্রথম জনের গোয়ার্তুমির মাশুল গুনল কলকাতা। পরের জনের চোখের ভুলের খেসারত দিল।
হাবাসের কোনও স্ট্র্যাটেজি-ই আজ কাজে দেয়নি। বলজিত্ সিংহের মতো এক জন প্রকৃত স্ট্রাইকারকে জেদ করে সেই রাইট ব্যাক খেলালেন। দু’টো গোল হজম করলেন তাঁর পাশ দিয়েই। যখন বলজিত্তে বসালেন, ততক্ষণে আটলেটিকোর যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে! মাস্টার ব্লাস্টার তেন্ডুলকরের কেরল ব্লাস্টার্সকে হারাতে শেষ মুহূর্তে গার্সিয়াকে বেঞ্চে রাখার ভুল সিদ্ধান্ত আটলেটিকোকে আরও বিপদে ফেলল। যিনি কিনা আগের ম্যাচেই গোল করে জয়ের সরণিতে ফিরিয়েছিলেন কলকাতাকে!
সূত্রের খবর, হাবাস নাকি বিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার ছক কষেছিলেন। নিটফল? ব্যাকফায়ার! যে জাল বিছিয়েছিলেন, তাতে নিজেই আটকে গেলেন কলকাতার দলের স্প্যানিশ কোচ। গার্সিয়া না থাকায় জোড়া লাভ হল কেরলের। বিপক্ষের মার্কি ফুটবলারের জন্য নিজেদের দু’জন ফুটবলার ব্যস্ত থাকতেন। সেটা তো হল-ই না, উল্টে বেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেললেন পিয়েরসনরা। ম্যাচের পর ডেভিড জেমস বলছিলেন, “গার্সিয়াকে প্রথম টিমে না দেখে অবাক হয়েছিলাম। তবে আমাদের জন্য ভাল-ই হয়েছে।” হাবাস যে ভুল ছিলেন, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ— দ্বিতীয়ার্ধে গার্সিয়া নামতেই ১-২ করেছিল কলকাতা।
হাবাসের অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সত্ত্বেও কোচি থেকে অন্তত এক পয়েন্ট নিয়ে ফিরতেই পারত কলকাতা। কিন্তু রেফারির সৌজন্যে সেটাও হল না। একেবারে ইনজুরি টাইমে গার্সিয়ার শট জেমসের হাত ফস্কে পরিষ্কার গোললাইন পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেফারির চোখে পড়েনি। প্রতিবাদে আটলেটিকো কোচ থেকে শুরু করে ফুটবলার— সবাই সাংবাদিক সম্মেলন বয়কট করেন। শুধু তাই নয়, ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল, কোচিতে এ দিন একটা বড় অঘটনও ঘটে যেতে পারত। ম্যাচ শেষে মাঠের মধ্যে একটা সময় দেখা যায় গার্সিয়া-হোফ্রেদের জোর করে ড্রেসিংরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন কলকাতা কোচ।
যদিও আইএসএলের পক্ষ থেকে অনেক বোঝানোয় টিমের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর সহর্ষ পারেখ সাংবাদিক সম্মেলনে করেন। যেখানে তিনি দাবি তোলেন, “গোললাইন প্রযুক্তি আইএসএলেও চালু করা দরকার। না হলে বারবার এ ভাবে বঞ্চিত হতে থাকলে ফুটবলারদের মনোবল ভেঙে যাবে।” গোলের কথা না মানলেও, আইএসএলে গোললাইন প্রযুক্তির দাবিকে সমর্থন করলেন কলকাতার বিপক্ষ কেরল ব্লাস্টার্স ফুটবলাররাও।
কিন্তু রেফারির ভুলের যেমন শাস্তি নেই, তেমন হাবাসের অহেতুক জেদের ক্ষমা নেই। আর ট্রেভর মর্গ্যান সেই জোড়া ভুলের ফায়দা তুলতে ভুল করেননি। দু’দিকের উইং ধরে বিপজ্জনক দৌড়। তার পরেই বক্সের ভেতর নিখুঁত সেন্টার পাঠানো। মাঝেমধ্যে চমত্কার লং পাসে খেলাটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মর্গ্যানের সেই লাল-হলুদ স্টাইলের আইএসএলেও পরিবর্তন নেই। ডেভিড জেমস যাঁকে ম্যাচের সেরা দাবি করলেন, সেই পেদ্রো কোচের স্টাইল বজায় রাখার পিছনে বড় ভূমিকা নিলেন। দুই স্টপারের সামনে পেন্ডুলামের মতো দুলে কেরলের আক্রমণে মসৃণতা তৈরি করলেন। আটলেটিকোর গোলকিপার শুভাশিস রায় চৌধুরি তিনটে নিশ্চিত গোল সেভ না করলে কেরল আরও বড় ব্যবধানে জিতত। পেদ্রো ম্যাচ শেষে বললেন, “ডান পা, বাঁ পা, বুক, মাথা যা কিছু দিয়ে শুধু গোল করতে চাই।” কেরলের দু’টো গোলেই যে লেগে ব্রাজিলিয়ান পদস্পর্শ।
জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের বাইরেই এক বহুতলের চুড়োয় বিরাট করে লেখা ‘রান কোচি রান’। কলকাতার আটলেটিকোর কারও লেখাটায় চোখ পড়েছে কি না জানা যাচ্ছে না। তবে গার্সিয়াদের মোবাইল-আইফোনে অবিলম্বে একটা মোটিভেশনাল লাইন উচিত লেভ করে ফেলা। ‘চেন্নাইয়ান আরও আগে... রান আটলেটিকো রান’।
আটলেটিকো দে কলকাতা: শুভাশিস, মোহনরাজ, অর্ণব, বলজিত্ (সঞ্জু), হোসেমি, নাতো, বোরহা, হোফ্রে, লেস্টার (কিংশুক), ফিকরু, আর্নাল (গার্সিয়া)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy