চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টারে ওঠার পর ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস। ভুটানের থিম্পুতে। ছবি: সমাজমাধ্যম।
এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে গ্রুপ পর্বে ইস্টবেঙ্গল অপরাজিত থাকবে এবং কোয়ার্টার ফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করবে, দিন দশেক আগেও ভাবা যায়নি। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত, পর্যুদস্ত একটা দল খেলতে গিয়েছিল এশীয় স্তরের প্রতিযোগিতায়। আক্ষেপ ছিল, এএফসি-তে এই সময়ই খেলাটা পড়ল! তবে সব আশঙ্কা, ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল।
২২ অক্টোবর আইএসএলে ওড়িশার কাছে হেরে ভুটানে খেলতে গিয়েছিল লাল-হলুদ। ২৬ অক্টোবর পারো এফসি-র সঙ্গে ড্র করা ম্যাচে বদলে যাওয়া ইস্টবেঙ্গলকে চোখে পড়েছিল। কী ভাবে চার দিনে বদলে গেল তারা?
সব ভুলভ্রান্তি যে রাতারাতি শোধরানো গিয়েছে এমন নয়। তবে কিছু একটা বদল যে এসেছে সেটা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইস্টবেঙ্গল কিছুটা হলেও ইস্টবেঙ্গলে ফিরে গিয়েছে, যারা লড়াই করতে জানে, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে ৯০ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যায়। ধীরে ধীরে ইস্টবেঙ্গল যে ঠিক দিকে এগোচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে খেলায়।
নতুন কোচ ব্রুজ়োর মস্তিষ্ক
লম্বা বিমানযাত্রা সেরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিশ্রাম নিয়ে কেউ যে কলকাতা ডার্বির মতো ম্যাচে কোচিং করাতে নেমে পড়তে পারেন তা অস্কার ব্রুজ়োকে না দেখলে বোঝাই যেত না। কোচ এবং ফুটবলারদের পেশাদারিত্ব এখন অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। ভারতীয় ফুটবলও ক্রমশ তার সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে। ব্রুজ়োর পেশাদারিত্ব তারই উদাহরণ। ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই তিনি ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলেন। কোথায় খামতি, কোথায় দুর্বলতা, কোথায় উন্নতি দরকার তা বুঝে গিয়েছিলেন। না হলে ডার্বি হারের পর গড়গড় করে এক নিশ্বাসে দলের দুর্বলতা তুলে ধরতে পারেন!
ব্রুজ়ো এক বারও বলেননি রাতারাতি তিনি সব পাল্টে দেবেন। আবার কার্লেস কুয়াদ্রাতের মতো প্রতি ম্যাচের পর ঘ্যানঘ্যান করেননি যে, তাঁকে আরও সময় দিতে হবে। আধুনিক ফুটবলে দ্রুত সাফল্য সব দলই চায়। কেউ দিনের পর দিন হারলেও কোচ বা ফুটবলারদের অগাধ আস্থা রাখে না। ব্রুজ়ো এসেই সারসত্য বুঝে গিয়েছিলেন। তাই আগে যেটা বদলানোর দরকার সেটা বদলেছেন। তিনি জানতেন, এই দলের কোনও ফুটবলারই তাঁর বাছাই করা নয়। দুম করে বদলানোও যাবে না। তাই হাতে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের নিয়েই কাজ করেছেন। ব্রুজ়োর মস্তিষ্ক কতটা সচল সেটা ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখে বোঝা গিয়েছে। একই কথা বলছেন প্রাক্তন ফুটবলার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে, “যে কোনও কোচের কাজই হচ্ছে ফুটবলারদের থেকে সেরাটা বার করে আনা। ব্রুজ়ো সেটাই করছেন। তবু কিছু কিছু কোচের মধ্যে একটা ব্যাপার থাকে যা তাদের বাকিদের থেকে আলাদা করে দেয়। যেমন ছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রুজ়োও বুঝে বুঝে আসল জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করছেন।”
ফুটবলারদের মানসিকতায় বদল
রবি ফাউলার কড়া কোচ ছিলেন। স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন তার থেকেও এক কদম এগিয়ে ছিলেন। কুয়াদ্রাত হাসিখুশি হলেও কোথাও একটা দলের খামতি বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। সে দিক থেকে ব্রুজ়ো বেশ অন্য রকম। ইস্টবেঙ্গলের অনুশীলন দেখলেই বোঝা যাবে, ব্রুজ়ো অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। শুধু ফুটবলার নয়, ইতিমধ্যেই সাপোর্ট স্টাফদের সবার সঙ্গেও সুসম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছেন। কেউ ভুল করলে তাঁকে নিজের হাতে সেটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এক বারে না হলে দু’বার, না হলে তিন বার। কোচ যেখানে এত সক্রিয় সেখানে ফুটবলারেরা কী করে ঢিলেঢালা থাকতে পারেন! তাঁরাও নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। সকলের মধ্যে একটা জেতার মানসিকতা চলে এসেছে। ইস্টবেঙ্গলের ব্যর্থতার সময় প্রাক্তন ফুটবলার সমরেশ চৌধুরি তলানিতে থাকা মানসিকতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনিই এখন বলছেন, “নতুন কোচ এসে ফুটবলারদের মধ্যে জেতার মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফুটবলারেরা বুঝতে পারছে এখন ওদের ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। কোনও দল একটানা হারলে হয় অতলে তলিয়ে যায়, অথবা সর্বশক্তি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ইস্টবেঙ্গল সেটাই করছে।” হয়তো সেটাই। কারণ যে দিমিত্রিয়স দিয়ামানতাকোস গোলই পাচ্ছিলেন না, তিনিই এএফসি-তে প্রতিটি ম্যাচে গোল করেছেন। মাদিহ তালাল অত গোল না করলেও প্রায় প্রতিটি গোলের পিছনে অবদান রাখছেন। কেউই খারাপ ফুটবলার নন। শুধু দরকার ছিল মানসিকতায় বদল। ভাস্করের মতে, “একটা দল হারতে হারতে যখন শেষ সীমায় পৌঁছে যায় তখন তাদের সামনে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরাও বুঝতে পেরেছে যে এটাই ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা সময়।”
ফিটনেসের উন্নতি
ভাল ফুটবলার হতে গেলে এবং ভাল ফুটবল খেলতে গেলে ফিটনেসের শীর্ষে থাকতেই হয়। এই কারণে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিয়োনেল মেসিরা চল্লিশের দোরগোড়ায় গিয়েও সাবলীল ভাবে খেলে চলেছেন। জিয়ানলুইজি বুফন চল্লিশ পেরিয়েও পেশাদার ফুটবল খেলেছেন। ডার্বি হারের পর ইস্টবেঙ্গলের ‘রোগ’ ধরতে গিয়ে সবার আগে খারাপ ফিটনেসের উল্লেখ করেছিলেন ব্রুজ়ো। ব্রুজ়ো আসার পরেই ইস্টবেঙ্গলের আগের ফিটনেস কোচকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ফিটনেস কোচ জেভিয়ার স্যাঞ্চেস ছোটখাটো চেহারার। মুখে সব সময় হাসি। তিনিই ফুটবলারদের এমন কিছু অনুশীলন করিয়েছেন যা ফিটনেস বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। সমরেশ বললেন, “ফুটবলারদের মধ্যে একটা ছটফটে ভাব দেখতে পাচ্ছি। আগের খেলাগুলোয় তা লক্ষ করিনি। আশা করছি ওরা গোটা মরসুম এটা ধরে রাখতে পারবে।” এটা ঠিক যে, সবাই চূড়ান্ত ফিট নন। রাতারাতি সেটা সম্ভবও নয়। এখনও ৭০-৭৫ মিনিটের পর কিছু কিছু খেলোয়াড়ের খেলায় মন্থরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যাঁরা সত্যিই নিজেদের বদলাতে চেয়েছেন তাঁরা বদলে ফেলেছেন। যাঁরা নিজেদের বদলাতে এখনও গড়িমসি করছেন তাঁদের হয়তো আগামী দিনে ক্লাবই বদলে ফেলবে।
ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের কারণ পর্যালোচনা করার পরেও বলতেই হচ্ছে, নতুন মরসুমের সবে দু’মাস কেটেছে। লাল-হলুদ এএফসি-তে সাফল্য পেয়েছে মানেই যে আইএসএলেও পাবে তা নয়। এএফসি-র দলগুলির থেকে আইএসএলের অনেক দল ভাল ফুটবল খেলে। তাঁদের বিরুদ্ধে জেতাও দরকার। সে কারণেই ভাস্কর বলেছেন, “আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল জয়ের ধারা বজায় রাখতে পারলে তবেই বুঝব সব ঠিকঠাক হচ্ছে।”
তবে যে লাল-হলুদের এত দিন মাঠে নামা মানেই হার অবধারিত ছিল, সেই দলকে নিয়ে এখন আশাবাদী হওয়াই যায়। এটুকু বিশ্বাস রাখা যায়, অন্তত লড়াইটা করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy