পর্বতের মূষিকপ্রসব।
আইসিসির দাঁত-নখ যে নেই, আবার প্রমাণ হল!
জেমস অ্যান্ডারসন-২
ভারত-০।
ইংরেজ পেসার বনাম ভারতীয় অলরাউন্ডারের বাইশ গজের বাইরের যুদ্ধের রায়-উত্তর কয়েক ঘণ্টা। ক্রিকেটবিশ্ব ততক্ষণে জেনে গিয়েছে, অ্যান্ডারসন নির্দোষ। জাডেজাও। কেউ অপরাধ করেননি। কারও শাস্তি হচ্ছে না। উপরের মন্তব্যগুলো ছড়িয়ে পড়তেও বিশেষ সময় লাগল না। বক্তা কোথাও প্রাক্তন আইসিসি ম্যাচ রেফারি। কোথাও বা লন্ডনের কাগজ। বা কোথাও ক্রিকেট-সাংবাদিক থেকে ক্রিকেট-উৎসাহী।
শুক্রবার রাতের দিকে ম্যাঞ্চেস্টারে ভারতীয় টিমের ম্যানেজারকে ফোনে ধরা হলে তিনি ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকতে চাইলেন না। সুনীল দেব শুধু বললেন, ‘‘যে যা দেখাচ্ছে, দেখাক। যে যা বলছে, বলুক। আমি এটা নিয়ে কিছু বলার জায়গায় নেই। বলারও কিছু নেই।” বক্তব্যে কোনও নাম উল্লেখ না থাকলেও গলায় হতাশা বোঝা গেল।
ইংল্যান্ড স্বভাবতই খুশি। ইয়ান বেল বলছেন, “এই সিদ্ধান্তটা টিমকে প্রচণ্ড উদ্বুদ্ধ করবে। সাউদাম্পটনে অ্যান্ডারসন সেরা ফর্মে ছিল। ও আমাদের বোলিং আক্রমণের নেতা। আশা করছি, এই ফর্মটা ও নিজের হোম টেস্টেও নিয়ে যাবে।” প্রাক্তন আইসিসি ম্যাচ রেফারি রাজু মুখোপাধ্যায় ততক্ষণে ক্ষোভের লাভাস্রোত বইয়ে দিচ্ছেন। “গত বছর অ্যাসেজের ওভাল টেস্টে ইংরেজরা পিচের উপর প্রস্রাব করে পার পেয়ে গেল। আইসিসি কিছু বলল না। উইকেটে প্রস্রাব করা যদি কোনও ব্যাপার না হয়, তা হলে এটা আর কী! কোনও কিছুই তো তা হলে কোনও ব্যাপার নয়।”
রাজুর মনে হচ্ছে, আইসিসির উচিত ফিফাকে দেখে শেখা। যারা মারাদোনার মতো প্রবাদপ্রতিমকেও রেহাই দেয়নি। তাঁর মনে হচ্ছে, আইসিসি যে কতটা নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আবার দিয়ে গেল এই মামলার রায়। টুইটারেও বিস্ফোরণ। কেউ কেউ লিখে দিয়েছেন, পুরো ব্যাপারটাই নাটক। প্রহসন। কেউ লিখেছেন, ‘জাডেজা অ্যান্ডারসনকে কিছু করেনি। অ্যান্ডারসন জাডেজাকে কিছু করেনি। তা হলে মামলাটা কোথা থেকে এল?’ কারও কারও আবার সুপরামর্শ— ওল্ড ট্রাফোর্ডে নামার আগে ম্যাচ রেফারির হাতে দু’টো টিমই তালিকা করে দিয়ে দিক ম্যাচে ওরা কোন কোন গালাগাল ব্যবহার করবে। কী ভাষায় স্লেজিং হবে!
ব্রিটিশ কাগজগুলো ইতিমধ্যেই বলে দিচ্ছে, সাউদাম্পটনের পর আরও এক বার জেমস অ্যান্ডারসনের কাছে হেরে গেল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত। আসলে ক্রিকেটমহল ধরেই নিয়েছিল, অ্যান্ডারসনের কমপক্ষে দু’টো টেস্ট নির্বাসন হতে চলেছে। তেমন হলে চারটে। কেউ দূরতম স্বপ্নেও ভাবেনি অ্যান্ডারসন সম্পূর্ণ রেহাই পেয়ে যাবেন। বিশেষ করে শুনানি ঘিরে চতুর্দিকে যেমন ঢাক বাজানো চলছিল। একেবারে আদালতের কায়দায় নাকি শুনানি হবে। সাক্ষী থাকবে। আইনি নথিপত্র জমা দিতে হবে। ক্রস এগজামিনেশন হবে। ভারতীয় টিম জানিয়েও দেয়, অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ তাদের আছে। দরকারে তারা ভিডিও ফুটেজ পেশ করে দেবে।
ঘুরেফিরে মহানাটকের নির্যাস যা দাঁড়িয়েছিল, তা এ রকম:
বিচারের স্থান— সাউদাম্পটনে ভারতীয় টিম হোটেল।
বিচারপতি— গর্ডন লুইস। যিনি হাজির থাকবেন স্কাইপে। কারণ তিনি অস্ট্রেলিয়ায়।
দুই মুখ্য চরিত্র— অ্যান্ডারসন, জাডেজা এবং তাঁদের ভিন্ন আইনজীবী ও সাক্ষ্যকুল।
শনিবার সকালের দিকে মহানাটকীয় পরিস্থিতি তৈরিও হয়ে যায়। প্রথমে ঠিক ছিল, জাডেজার সঙ্গে ভারত অধিনায়ক আর কোচ থাকবেন সাক্ষ্য দিতে। আদতে দেখা গেল, ধোনি-ফ্লেচারের সঙ্গে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত গৌতম গম্ভীরও। গোটা টিম এ দিন ম্যাঞ্চেস্টার রওনা হয়ে গেলেও এঁরা যাননি সাক্ষ্য দেবেন বলে। কারণ জাডেজার অভিযোগ অনুযায়ী, ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে লাঞ্চের সময় ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথে যখন জাডেজাকে ধাক্কা মারেন অ্যান্ডারসন, তখন তাঁর পাশে ছিলেন ধোনি। গম্ভীর, অশ্বিনরা ছিলেন বাউন্ডারির ধারে। ইংল্যান্ড আবার উপস্থিত করে স্টুয়ার্ট ব্রড এবং নটিংহ্যাম টেস্টের উইকেটকিপার ম্যাট প্রায়রকে। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে সাক্ষীদের বয়ান পেশ চলে। ইংল্যান্ডের দুপুর একটা নাগাদ বেরিয়ে আসতে দেখা যায় প্রায়র আর ব্রডকে। সঙ্গে অ্যান্ডারসন। ঘণ্টাখানেক বাদে ফ্লেচারও বেরিয়ে আসেন গম্ভীরের সঙ্গে। তার পর দু’জন দু’টো আলাদা গাড়িতে বেরিয়ে যান। তারও ঘণ্টাদুয়েক পর বেরিয়ে আসেন ধোনি-জাডেজা এবং ফিজিও ইভান। শোনা যাচ্ছে, শুনানির সময় ভারত তাদের ভিডিও রেকর্ডের টেক্কাও উপুড় করে দিয়েছিল।
কিন্তু তাতে লাভ হল কী?
শুনানি শেষের পর বলা হচ্ছিল, রায় দিতে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় পাবেন বিচারপতি গর্ডন। আদতে দেখা গেল, দু’দিন দূরের ব্যাপার। দু’ঘণ্টাও লাগল না রায় দিতে। যা চরমতম আশ্চর্য কারণ তাতে বলা, জাডেজা-অ্যান্ডারসন কেউ কোনও দোষ করেননি। যাঁদের কিনা লেভেল থ্রি এবং লেভেল টু অপরাধে গণ্য করা হয়েছিল। অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে ধাক্কা মারার ও গালাগালের অভিযোগ আনলে, জাডেজার বিরুদ্ধে লেভেল টু অপরাধ এনে পাল্টা দেয় ইংল্যান্ড। জাডেজার পঞ্চাশ শতাংশ ম্যাচ ফিও জরিমানা হয়। যা নিয়ে পাল্টা আবেদন করে বোর্ড। এ দিনের শুনানিতে জাডেজাও ছাড় পেয়ে গেলেন। এক বিবৃতিতে আইসিসি বলে, “ছ’ঘণ্টা শুনানির পর বিচারপতি গর্ডন লুইস সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জাডেজা বা অ্যান্ডারসন কেউই অপরাধ করেননি। আর সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে।”
যার পর আইসিসিকে লক্ষ্য করে ক্রিকেট-বিশ্বের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। তবে তাতে আর কী এসে যায়? মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের যা ধাক্কা লাগার তো লেগেই গেল।
ইশান্ত শর্মা ওল্ড ট্রাফোর্ডে নেই। ভুবনেশ্বর কুমারও অনিশ্চিত। জিমি অ্যান্ডারসন না নামতে পারলে দু’টো টিমের পেস বিভাগের শক্তির পার্থক্য কিছুটা হয়তো কমত। এখন পরিস্থিতি যা, ভারতীয় পেস ব্যাটারি হয়তো নামবে সিকি-শক্তি নিয়ে, আর তিনি জিমি অ্যান্ডারসন নামবেন পূর্ণ শক্তিতে, ঘরের মাঠে, সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত হয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy