১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। বিশ্বকাপ হাতে সতীর্থদের সঙ্গে যশপাল শর্মা। ফাইল চিত্র
ওঁদের বন্ধু প্রিয় যশ আর নেই! ভাবতেই পারছে না ‘কপিলস ডেভিলস’। যশপাল শর্মার প্রয়াণে ওঁরা সবাই শোকস্তব্ধ। ৬৬ বছরেও ফিটনেস ধরে রাখা যায়, সেটা সতীর্থদের দেখিয়েছিলেন ওঁদের যশ। তাই এহেন মানুষটার থেমে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না ১৯৮৩ সালের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্যরা।
সকালের দিকে ওঁদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে খারাপ খবরটা কপিল দেব দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বকাপে কপিল যে ভাবে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এ দিনও ঠিক তেমন মেজাজেই তাঁকে দেখা গিয়েছে। খবরটা পেয়েই প্রয়াত বন্ধুর নয়াদিল্লির লোধী রোডের বাড়িতে পৌঁছে যান সবার ‘ক্যাপস’। এ বারও অধিনায়কের মতোই সামনে থেকে সবকিছু দেখভাল করেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মোহিন্দর অমরনাথ, কীর্তি আজাদ, মদন লাল। এমনকি সে বার একটাও ম্যাচ না খেলা সুনীল ওয়ালসন। সুনীল গাওস্কর, দিলীপ বেঙ্গসরকর, সন্দীপ পাটিল, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, রজার বিনি, বলবিন্দর সিংহ সান্ধু, সৈয়দ কিরমানিরা প্রতিনিয়ত বন্ধুর শেষ যাত্রার খবর নিয়েছেন।
কপিল বলছিলেন, “সবাই এখনও ওর সেমিফাইনালে ১১৫ বলে করা ৬১ রান নিয়ে আলোচনা করে। এটা ঠিক যে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ও রুখে না দাঁড়ালে আমরা ইতিহাস তৈরি করতে পারতাম না। তবে আমার কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১২০ বলে ৮৯ রান আরও স্পেশাল। কারণ সেই ম্যাচ জিতেই আমরা স্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিলাম। আমার দেখা অন্যতম সাহসী ক্রিকেটার।”
Sad to hear the demise of my former team mate and friend #YashpalSharma! He was one of the main heroes who helped us lifting the 1983 world cup! May his soul rest in peace 🙏!
— Kris Srikkanth (@KrisSrikkanth) July 13, 2021
গত বছর কপিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই তিনি বন্ধু বিয়োগের যন্ত্রণা আরও বেশি টের পাচ্ছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “গত কয়েক বছর ধরে আমি পরিমিত খাওয়া দাওয়া করি। তবে স্বাস্থ্যের দিক থেকে যশ আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এহেন মানুষের এমন পরিণতি হতে পারে, ভাবতেই পারছি না!”
সে বারের সহ-অধিনায়ক মোহিন্দর অমরনাথও ভেঙে পড়েছেন। বলছিলেন, “সবাই বলে শ্রীকান্ত দারুণ মজা করতে পারে। তবে আমার কাছে যশ সেরা। ওর সঙ্গে থাকলে সময় কীভাবে কেটে যাবে, বুঝতেই পারা যায় না। আমরা একসঙ্গে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরাঞ্চল ও জাতীয় দলে খেলেছি। কত স্মৃতি আজ ভিড় করে আসছে। ও চলে যাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আমরা সবাই যেন ‘স্লগ ওভার’-এ ব্যাট করছি। যে কোনও দিন আমাদের ডাক আসতে পারে।”
অনেক চেষ্টা করে কিরমানির ছেলে সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। ছেলের মোবাইল থেকে এই প্রাক্তন উইকেট রক্ষক বললেন, “সকালে খবর পাওয়ার পরেই ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। যশ আমাদের মধ্যে নেই, এটা শোনার পর থেকেই অসুস্থ বোধ করছিলাম। এখনও কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি।”
WATCH: #YashpalSharma’s brilliant batting in the semi-final of 1983 World Cup against England. pic.twitter.com/uZr7k0FpPx
— Madhav Sharma (@HashTagCricket) July 13, 2021
সদ্য প্রয়াত যশপালের আর এক সতীর্থ মদল লালও বাকরুদ্ধ। তিনি বলছিলেন, “সোমবার পর্যন্ত একটি বেসরকারি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করেছে। রাতের দিকেও একবার যশের সঙ্গে কথা বললাম। আর সকাল হতেই এমন খবর! বিশ্বাস করতে পারছি না।” প্রাক্তন এই জোরে বোলার আবার যশপালের প্রতিবাদী রূপ তুলে ধরলেন। জানালেন, “২০০৫ সালে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জাতীয় দল থেকে বাদ যাওয়ার পর শুধু যশপাল প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই সময় ও জাতীয় নির্বাচক থাকলেও বিসিসিআই কর্তাদের ভয় পায়নি। সৌরভের হয়ে সওয়াল করার জন্য ওকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। তবে নিজের প্রতিবাদী সত্তা থেকে যশ কিন্তু সরে আসেনি।”
বন্ধু প্রয়াণে টুইটারে শোক বার্তা জানিয়েছেন শ্রীকান্ত, রবি শাস্ত্রী। যশের সঙ্গে কাটানো অনেক স্মৃতি ভাগ করে নিয়েছেন তাঁর আরও কয়েক জন সতীর্থ। বেঙ্গসরকর বলছিলেন, “আমাদের বিশ্বকাপ জয় নিয়ে কয়েক মাস আগে গুরগাঁওতে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেটাই যে ওর সঙ্গে শেষ দেখা হবে, জানতাম না। ৬৬ বছরেও দারুণ ফিট ছিল। মদ্যপান, ধূমপান থেকে দূরে থাকত। বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য শাক-সব্জি ছাড়া অন্য কিছু খেত না। সুপ খেয়ে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমোতে যেত। এমন মানুষ হঠাৎ চলে যাবে, বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
উঠল ১৯৭৯ সালের সেই ঐতিহাসিক দিল্লি টেস্টের কথা। ফিরোজ শাহ কোটলায় সে বার ১৪৬ রানে অপরাজিত থাকা ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কর্নেল’-এর স্মৃতি রোমন্থন, “সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আমার সঙ্গে যশের ১২২ রানের জুটির জন্য ম্যাচ প্রায় জিতেই যাচ্ছিলাম। দিল্লির সেই কনকনে ঠাণ্ডায় সিকন্দর বখত যেন বাইশ গজে আগুন ঝরিয়েছিল। ৬৯ রানে ৮ উইকেট নেওয়ার জন্য আমাদের প্রথম ইনিংস মাত্র ১২৬ রানে গুটিয়ে যায়। তবে হাল ছাড়িনি। ৩৯০ রান তাড়া করতে নেমে চতুর্থ উইকেটে আমরা পাল্টা লড়াই করেছিলাম। কিন্তু যশ ৬০ রানে ফিরতেই আমাদের জয়ের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। তবে হারিনি। ও সঙ্গ দিয়েছিল বলেই সেই টেস্ট ড্র হয়।”
Really saddened and shocked at losing a colleague of World Cup fame so early in life. Condolences to the family and God bless his soul 🙏🏻 #YashpalSharma pic.twitter.com/jVkHEyRWfP
— Ravi Shastri (@RaviShastriOfc) July 13, 2021
রজার বিনি ওঁদের সবার থেকে একটু আলাদা। গম্ভীর এই মানুষটার গলা এ দিন শুকিয়ে আসছিল। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বললেন, “ভেবেছিলাম শুধু বিয়ার খেয়ে বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করব। সেই মতো কপিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাজঘরে গিয়ে বিয়ারের পেটি তুলে নিয়ে আসে। তবে আমার হাতে বিয়ার দেখতেই যশ একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বলেছিল, ‘ভাংড়া নাচতে পারলে তবেই বিয়ার গলায় ঢালতে পারব।’ ওর আবদারে সে দিন লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাংড়া নেচে বিয়ার খেয়েছিলাম। আজ সব স্মৃতি। এগুলো নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।”
পরিচালক কবির খানের ’৮৩-র কাজ শেষ। শুধু করোনা পরিস্থিতির জন্য সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে আসছে না। সেই সিনেমায় রণবীর সিংহদের ক্রিকেটের পাঠ দিয়েছেন প্রাক্তন ডানহাতি জোরে বোলার বলবিন্দর সিংহ সান্ধু। তিনি সদ্য প্রয়াতকে ‘রোমি’ বলে ডাকতেন। তাঁর বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়কের স্ত্রীর নামও যে রোমি। সেটার জন্য ঝামেলা হয়নি? বলবিন্দরের স্মৃতিচারণ, “বিশ্বকাপ অভিযানের সময় যশ ও আমি একই ঘরে থাকতাম। আমি ওকে মজা করে ‘রোমি’ বলে ডাকতাম। সেটা নিয়ে যশ খুব লজ্জা পেত।” কিছুক্ষণ থেমে ফের যোগ করলেন, “গত সপ্তাহে ’৮৩ নিয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিল। যশের সঙ্গে সেখানেই শেষ আড্ডা দিয়েছিলাম। আমার বাড়তি ওজন, ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়ার জন্য কত বকাবকি করল। সেই মানুষটাই আজ আমাদের মধ্যে নেই! অবিশ্বাস্য!”
প্রথম বিশ্বকাপ জয় বলে কথা। এর আগে ২৫ জুন এলেই ওঁরা একে অন্যকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতেন। তবে হোয়াটসঅ্যাপ আসার পর থেকে ব্যাপারটা বদলে যায়। কয়েক বছর আগে সুনীল গাওস্কর এই হোয়াটসঅ্যাপটা গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘চ্যাম্পিয়নস ফর এভার’। তবে কালের নিয়মে সেই গ্রুপের একজন মঙ্গলবার থেকে ‘মিউট’ হয়ে গেলেন। রয়ে গেলেন বাকি ১৪ জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy