Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপ্লবের পিছনে আসল মাথা কিংবদন্তি সুকেরই!

রাশিয়ার মাটিতে ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল বিপ্লবের যে রাত বিশ্ববাসী বুধবার  দেখল, তাঁর পিছনে আসল মাথা তিনিই— দাভর সুকের।

ফেডারেশনের দায়িত্ব নিয়ে সফল সুকের।

ফেডারেশনের দায়িত্ব নিয়ে সফল সুকের।

রতন চক্রবর্তী
মস্কো শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০৪:২৭
Share: Save:

লুকা মদ্রিচরা বিশ্বকাপে নতুন ইতিহাস তৈরির পর কোচকে মাটিতে ফেলে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল ক্রোট গ্যালারির দিকে দৌড়ে গিয়ে সমর্থকদের গান আর হাততালির সঙ্গে রাকিতিচ, পেরিসিচরা নিজেদের শামিল করলেন। পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নাচলেন। ছেলেমেয়েদের কোলে তুলে আনন্দ করলেন।

দেশের লাল-সাদা পতাকা নিয়ে পাগলের মতো দৌড়োচ্ছিলেন অতিরিক্ত সময়ে গোল করে ম্যাচ জেতানোর নায়ক মারিয়ো মাঞ্জুকিচ।

এ সব দৃশ্য দেখে গ্যালারিতে হাসছিলেন তিনি। ক্রোয়েশিয়ার অন্য ভিআইপিদের পাশে দাঁডিয়ে মাঝে মধ্যে হাত নাড়ছিলেন ফুটবলারদের দিকে। তৃপ্তির বলিরেখা সারা মুখে ঝকঝক করছে। লুঝনিকি স্টেডিয়ামের ক্যামেরা যখন তাঁকে লেন্সে ধরল, মনে হল তিনি কাঁদছেন। আসলে এই দিনটার অপেক্ষাতেই গত ছয় বছর ধরে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। নীরবে। সবার চোখের আড়ালে।

রাশিয়ার মাটিতে ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল বিপ্লবের যে রাত বিশ্ববাসী বুধবার দেখল, তাঁর পিছনে আসল মাথা তিনিই— দাভর সুকের। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে সোনার বুট জেতা ক্রোয়েশিয়ার প্রাক্তন স্ট্রাইকার। সুকেরই এখন ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের সর্বময় কর্তা। দেশের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। কুড়ি বছর আগে ফ্রান্সে তিনি করেছিলেন সাত ম্যাচে ছয় গোল। তাঁর দল ক্রোয়েশিয়া সে বার বিশ্বকাপ শেষ করেছিল তৃতীয় হয়ে। সেটাই ছিল এত দিন বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার সেরা সাফল্য।

আরও পড়ুন: ইউরো ফাইনাল থেকেই বড় শিক্ষা পোগবার

ক্রোয়েশিয়ার সাংবাদিকদের অনুরোধে মিডিয়া সেন্টারে এসেছিলেন সুকের। আগের চেয়ে মোটা হয়ে গিয়েছেন অনেক। বলছিলেন, ‘‘আমি কুড়ি বছর আগে যেটা করতে পারিনি, সেটা করে দেখিয়েছে লুকা (মদ্রিচ)। দশ বছর ধরে মেসি, রোনাল্ডোরা ব্যালন ডি’ওর নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ বার লুকার ওটা পাওয়া উচিত। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে কত ট্রফি জিতেছে ছেলেটা। ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে তোলার পিছনে ও। তাতিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে পুরো দলকে।’’

অগ্রজের কথা শুনে অনুজ কী বলছেন? মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে লুকা মদ্রিচ বলছিলেন, ‘‘ফুটবল পণ্ডিতরা আমাদের অবজ্ঞা করেছিলেন। বিশেষ করে ইংরেজরা। গুরুত্বই দিচ্ছিলেন না। প্রতিদিন আমরা সেটা নিয়ম করে পড়তাম। সেটাই আমাদের তাতিয়েছিল। আর একজনের কথা বলব— মিস্টার সুকের। এই সাফল্যের পিছনে আসল লোক উনিই।’’

ফেডারেশনের দায়িত্ব নিয়ে কী করেছেন সুকের? শুনে আশ্চর্যই হয়ে যেতে হয়। ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কর্তারা যা ভাবতেই পারবেন না। ৪৩ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দেশটায় ৫০টা ফুটবল অ্যাকাডেমি করেছেন তিনি। বিশ্ব ফুটবলে ক্রোয়েশিয়ার একটা পরম্পরা ছিল। সুকেরের পরিকল্পনায় তা আরও মজবুত হয়েছে এখন। একান্তে কথা বলার সময় উচ্ছ্বসিত সুকের বলছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে ফুটবলই একমাত্র সবাইকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারে। শুনলাম, খেলা চলার সময় জাগ্রেবে কোনও বাড়িতে টিভিতে কেউ অন্য অনুষ্ঠান দেখেনি।’’

ক্রোয়েশিয়ার এই ঐতিহাসিক সাফল্যের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে উরুগুয়ের ১৯৩০-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনাকে। কিন্তু পুরো পরিসংখ্যান দেখলে লুকা, পেরিসিচদের নম্বর আরও বাড়বে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ক্রোয়েশিয়াই একমাত্র দল যাঁরা নক-আউট পর্বে পরপর তিনটে ম্যাচ ১২০ মিনিট খেলে জিতেছে। এখানেই থামা যাচ্ছে না। তিনটি ম্যাচেই প্রথমে গোল খেয়ে পরে শোধ করেছে জ্লাটকো দালিচের দল। শান্ত স্বভাবের ক্রোয়েশিয়া কোচকে দেখছিলাম ম্যাচের পর ফুটবলারদের গিয়ে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরছেন। ফুটবলাররা উৎসবের জোয়ারে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিচ্ছেন, তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই। যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচ খেলার ঠিক আগে ডালিচকে কোচ করে আনেন সুকের। পুরো দলটাকে পিছন থেকে চালনা করেছেন সুকেরই। দল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর মস্তিস্ক। দালিচ বলছিলেন, ‘‘আমি ছেলেদের ম্যাচের আগে ডেকে বলেছিলাম, আর তোমাদের কী শেখাব? আমরা সেমিফাইনালে উঠেছি এটাই বিরাট ব্যাপার। এর পরে যেটুকু পাব সবই বোনাস। খোলা মনে আনন্দে খেলো।’’

চোখের তলায় কালি। দেখে মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ডের সামনে পড়ে রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই ঠিক উল্টো। দালিচ তো চব্বিশ ঘণ্টা আগে হুমকি দিয়েছিলেন, ‘‘মেসিকে রুখেছি, হ্যারি কেন-ও কিছু করতে পারবে না।’’ শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড অধিনায়ককে এমন বোকা বানিয়েছে ক্রোয়েশিয়া, যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে মজাদার সব মন্তব্য। এ বারের ক্রোয়েশিয়া দলটা আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা বেলজিয়ামের মতো তারকাসমৃদ্ধ শক্তিধর নয়। মদ্রিচদের ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি কেউ। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যে সমৃদ্ধ একটা দল এ বারের ক্রোয়েশিয়া। যাদের জেদ আর দলগত সংহতি চোখে পড়ার মতো। যে ভিদার পাস থেকে পেরিসিচ প্রথম গোলটা করলেন, তাঁর পা থেকে কুড়িটা মিস পাস বেরিয়েছে। সতীর্থরা কেউ তাকে ধমকাননি। মানসিক একাত্মতা থাকলেও মাঠের সংগঠনে ক্রোয়েশিয়া পিছিয়ে। ম্যাচের সময় দেখা যাচ্ছিল কখনও কখনও কুড়ি-তিরিশ গজের ফারাক হয়ে যাচ্ছিল মাঝমাঠের সঙ্গে ফরোয়ার্ডদের। বোঝাপড়ার অভাব চোখে পড়ছিল। কিন্তু জয়ের গন্ধ পেতেই জেগে উঠে তারা ছারখার করে দিল বিপক্ষকে। সেটাই হয়েছে ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে। শুরুতেই ক্রোয়েশিয়া গোল হজম করার পর লুকা মদ্রিচকে দেখা গেল সবাইকে ডেকে ডেকে কিছু বলছেন। মনে হয় বলছিলেন, এ বার ওঠো। জাগো।

সত্যিই জেগে উঠল ক্রোয়েশিয়া!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy