Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Syndrela Das

টপ স্পিনের মোকাবিলায় আগ্রাসী স্ট্রোক, চার বছর পরে অলিম্পিক্সে নামাই লক্ষ্য কলকাতার সিন্ড্রেলার

রাজ্য ও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে এখন সিন্ড্রেলা দাস বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড়ে। সুইডেনে যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে লড়ছে সে। সেখান থেকে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা হল সিন্ড্রেলার।

sports

সিন্ড্রেলা দাস। বিশ্ব টেবল টেনিসে নেমেছে ১৫ বছরের বাঙালি কন্যা। ছবি: সংগৃহীত।

দেবার্ক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৯
Share: Save:

ইয়াও রুইজ়ুয়ানের বিরুদ্ধে খেলার সময় একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয় তাকে। চিনের টেবল টেনিস খেলোয়াড়ের টপ স্পিন সামলানোর জন্য আগে থেকেই কোচের সঙ্গে পরিকল্পনা ছকা থাকে। তার পরেও টেবিলে রুইজ়ুয়ানের টপ স্পিনের মোকাবিলা করা মোটেই সহজ নয়। কলকাতার সিন্ড্রেলা দাস তাই কাজে লাগায় নিজের শক্তি। আক্রমণাত্মক শট। সার্ভিস ও তার পরের শটেই পয়েন্ট জিতে নেওয়া। বড় র‌্যালির দিকে তাকিয়ে না থেকে দ্রুত পয়েন্ট জেতার চেষ্টা করে সে।

টপ স্পিন সামলাতে সিন্ড্রেলা কাজে লাগায় তার ফোরহ্যান্ড পিমপলস ব্যাট। এই ধরনের ব্যাটের রবারের উপরের দিকটা একটু উঁচু থাকে। ফলে প্রতিপক্ষের টপ স্পিন সামলানো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। তবে কোনও রকমের ট্রিক ব্যাট কোনও দিন ব্যবহার করেনি সিন্ড্রেলা। বরাবর একই ব্যাট নিয়ে খেলেছে কলকাতার ১৫ বছরের মেয়ে।

sports

খেলো ইন্ডিয়ায় জেতার পর ট্রফির সঙ্গে সিন্ড্রেলা। ছবি: সংগৃহীত।

এই ব্যাট ব্যবহার করেই একের পর এক সাফল্য পেয়েছে সিন্ড্রেলা। অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ডব্লিউটিটি ইয়ুথ কন্টেন্ডারে স্লোভেনিয়ায় অনূর্ধ্ব-১৩ সোনা, ইটালিতে অনূর্ধ্ব-১৩ সোনা, আলজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পেরুতে অনূর্ধ্ব-১৫ সোনা জিতেছে সে। দোহায় যুব প্রতিযোগিতায় সোনা জিতে ফিরে গোয়ায় অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কলকাতার মেয়ে। এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে সুইডেনে খেলতে নেমেছে সিন্ড্রেলা। এ সবই হয়েছে মাত্র চার বছরে। ১১ বছর বয়সে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিল সিন্ড্রেলা। পরের চার বছরে একের পর এক প্রতিযোগিতা জিতে নজর কেড়েছে সে।

সিন্ড্রেলার টেবল টেনিসে আসার গল্পটা একটু অন্য রকম। মেয়ে খেলাধুলোর মধ্যে থাকুক, চেয়েছিলেন মা সুস্মিতা ও বাবা সুপ্রিয়। আলাদা করে কোনও খেলা তাঁদের মনে ছিল না। তাই তিন বছরের ছোট্ট সিন্ড্রেলা নাচ, গান, আঁকার পাশাপাশি সাঁতার কাটত। বাঘাযতীনে পাড়ারই একটি ক্লাবে টেবল টেনিস খেলা হত। সেখানেই প্রথম বোর্ডে হাতেখড়ি তার। পরের ১২ বছরে অনেকটা এগিয়েছে সিন্ড্রেলা। রাজ্য চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে এখন সে বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড়ে। সুইডেনে যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে লড়ছে সিন্ড্রেলা। সেখানে যাওয়ার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা হল বাংলার টেবল টেনিসের উঠতি তারকার। কথা হল সিন্ড্রেলার এই বেড়ে ওঠার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কান্ডারি তার মা সুস্মিতা দাসের সঙ্গেও।

sports

মা সুস্মিতা ও বাবা সুপ্রিয়ের মাঝে সিন্ড্রেলা। ছবি: সংগৃহীত।

বাঘাযতীনের যে ক্লাবে সিন্ড্রেলা খেলত, সেখানে দু’জন দাদা তাদের শেখাতেন। মূলত বড়দের শেখানো হত। ছোটরা তাদের দেখেই শেখার চেষ্টা করত। সেই সময় গার্ডেনরিচের একটি প্রতিযোগিতা জীবনটাই বদলে দিয়েছে সিন্ড্রেলার। ক্লাব থেকে সেখানে খেলতে গিয়েছিল সে। সিন্ড্রেলা বলল, “ওখানে ছেলে-মেয়ে সকলে একসঙ্গে খেলছিল। ছেলেদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তার পর থেকেই টেবল টেনিসকে আরও ভালবেসে ফেললাম।”

মেয়ে যে এতটা উন্নতি করেছে তা বুঝতে পারেননি সুস্মিতা। সেই প্রতিযোগিতা তাঁকে অবাক করেছিল। তার পরেই তিনি ভাবেন, মেয়েকে এ বার ভাল হাতে দিতে হবে। তিনি বললেন, “আমি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করি, ও যে সব শট খেলল সেগুলো কোথায় শিখেছে? ও বলল, ক্লাবে দাদাদের দেখে শিখে নিয়েছে। তখনই বুঝলাম, ওকে ভাল জায়গায় ভর্তি করলে অনেকটা যেতে পারবে। আমি ওকে নিয়ে গেলাম ধুনসেরি ধানুকা সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমিতে। সৌম্যদীপ স্যর অত ছোট মেয়েদের শেখান না। কিন্তু সিন্ড্রেলার খেলা দেখে উনি রাজি হয়ে যান। তার পর থেকে ও ওখানেই আছে।”

অনূর্ধ্ব-১৫ স্তরে এখন ভারতে যে কয়েক জন মেয়ে টেবল টেনিস খেলোয়াড় রয়েছে তাদের মধ্যে সিন্ড্রেলা অন্যতম। মহারাষ্ট্রের দিব্যাংশি ভৌমিকের সঙ্গে দেশের প্রায় সব প্রতিযোগিতার ফাইনালেই লড়াই হয় তার। গোয়ায় দিব্যাংশিকে হারিয়েই সোনা জিতেছে সিন্ড্রেলা। পিছিয়ে পড়ে ফিরেছে সে। একই ঘটনা ঘটেছে ডব্লিইটিটি ইয়ুথ কন্টেন্ডারেও। বার বার পিছিয়ে পড়ে ফেরার মন্ত্র কী? সিন্ড্রেলার কথায়, “আমি বেশি চাপ নিই না। পিছিয়ে পড়লেও ভাবি কী ভাবে ফিরব। আমি আক্রমণাত্মক খেলতে ভালবাসি। আমার সার্ভিস ভাল। চেষ্টা করি প্রথম কয়েকটা শটের মধ্যেই পয়েন্ট জিতে নিতে। এক বার ছন্দ পেয়ে গেলে সেটা বজায় রাখার চেষ্টা করি।” সিঙ্গলস খেলতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে সিন্ড্রেলা। তার পরে ভালবাসে ডাবলস। সেখানে তাঁর জুটি সেই দিব্যাংশি। যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তার সঙ্গেই জুটি বেঁধে খেলতে ভালবাসে কলকাতার মেয়ে।

একটানা ম্যাচ খেলার ধকল অনেক সময় শরীর নিতে পারে না। দোহায় খেলার সময় হাতে একটা চোট পেয়েছিল সিন্ড্রেলা। কিন্তু সেই চোটও থামিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। ব্যথা নিয়েই খেলেছে। মেয়ের এই লড়াকু মনোভাব ছোট বেলাতেই দেখেছিলেন সুস্মিতা। তিনি বললেন, “ছোট বেলায় এক বার ওর হাত ভেঙে গিয়েছিল। তাই সে বার ও রাজ্য প্রতিযোগিতায় নামতে পারেনি। দেখেছিলাম, ও কাঁদছে। হাতের ব্যথায় নয়। খেলতে না পারার জন্য। তখনই বুঝেছিলাম এই খেলাটা ও কতটা ভালবেসে ফেলেছে।”

প্রত্যেক খেলোয়াড়েই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। সিন্ড্রেলারও রয়েছে। নিজের দুর্বলতা জানে সে। তাই সেটা উন্নত করার একটি পদ্ধতি বার করে ফেলেছে সে। সিন্ড্রেলা বলল, “যে দিন যে শটটা খারাপ হয় সেটা ডায়েরিতে লিখে রাখি। পরে কোচের সঙ্গে সেই শট নিয়ে আলোচনা করি। সেটা কী ভাবে ভাল খেলব তার চেষ্টা করি।” মেয়ের মাথায় চাপ দিতে চান না সুস্মিতা। তিনি চান, সিন্ড্রেলা খেলাটা ভালবেসে খেলুক। জয়ের পাশাপাশি হারও মেনে নিতে শিখুক। তিনি বললেন, “ও জিতলে আমরা যে ভাবে উল্লাস করি, হারলেও সে ভাবেই আনন্দ করি। কারণ, খেলায় জেতার পাশাপাশি হারকেও মেনে নিতে হয়। ও এখনও বাচ্চা। আমরা চাই ও খেলাটা উপভোগ করুক। ও কত দূর এগোতে পারবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। এটুকু বলতে পারি সিন্ড্রেলা খুব স্পোর্টিং। হেরে গেলে ওকে কোনও দিন কাঁদতে দেখিনি।”

অনুশীলনে কোনও রকম খামতি রাখতে চায় না সিন্ড্রেলা। কলকাতায় থাকলে গোটা সপ্তাহ জুড়ে অনুশীলন করে সে। অ্যাকাডেমিতে টানা পাঁচটি করে সেশনের পর একটি করে ছুটি থাকে। সোমবার সকাল, বিকাল, মঙ্গলবার সকাল, বিকাল আর বুধবার সকালে অনুশীলন হয়। সে দিন বিকালে ছুটি থাকে। আবার বৃহস্পতিবার সকাল, বিকাল, শুক্রবার সকাল, বিকাল আর শনিবার সকালে অনুশীলন করে সিন্ড্রেলা। শনিবার বিকাল ও রবিবার ছুটি থাকে।

sports

অ্যাকাডেমিতে কোচ সৌম্যদীপ ও পৌলমীর মাঝে সিন্ড্রেলা। ছবি: সংগৃহীত।

তার সাফল্যের নেপথ্যে অ্যাকাডেমির কতটা ভূমিকা রয়েছে সেটাও জানিয়েছে সিন্ড্রেলা। সৌম্যদীপ তার প্রথম কোচ। এখনও ছাত্রীর দিকে একই রকম নজর তার। সিন্ড্রেলার কথায়, “স্যরই আমাকে হাতে ধরে সব কিছু শিখিয়েছেন। পৌলমী ম্যামও অনেক সাহায্য করেন। বিদেশে আমরা খেলতে গেলে স্যর অনেক সময় যান। ওঁর সঙ্গে সব সময় কথা হয়। ধানুকা স্যর (ধুনসেরি ধানুকা, সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমির কর্ণধার চন্দ্রকুমার ধানুকা) আমাদের বিদেশে অনুশীলন করতে পাঠান। ওঁরা না থাকলে এতটা এগোতে পারতাম না।”

একই অ্যাকাডেমিতে রয়েছেন বাংলার টেবল টেনিসের এখনকার দুই বড় তারকা ঐহিকা ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা সিন্ড্রেলার দিদির চেয়েও বেশি বন্ধু। নিউটাউনের অ্যাকাডেমির হোস্টেলে তাঁরা একই ঘরে থাকেন। একসঙ্গে অনুশীলন করেন। সেখানে দুই সিনিয়রকে দেখে শেখে সিন্ড্রেলা। সে বলল, “ওরা অনুশীলনের সময় অনেক পরামর্শ দেয়। দেখেছি যে ওরা কী ভাবে সারা দিন কাটায়। বাড়িতে থাকলে যা করে হস্টেলেও তা-ই করে। ঐহিকাদি তো নিয়ম করে ধ্যান করে। এটা আমার খুব ভাল লাগে।”

গত এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রথম মহিলা জুটি হিসাবে পদক জিতেছেন ঐহিকা ও সুতীর্থা। প্যারিস অলিম্পিক্সেও আশা জাগিয়েছে ভারত। জিততে না পারলেও নক আউটে খেলেছেন মণিকা বাত্রা, শ্রীজা আকুলারা। সিন্ড্রেলারও লক্ষ্য অলিম্পিক্স। ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে দেশের হয়ে খেলতে চায় সে। তার আগে ২০২৬ সালের কমনওয়েলথ খেলতে চায় বাংলার ১৫ বছরের মেয়ে। সেই লক্ষ্যেই নিজের প্রস্তুতি শুরু করেছে সৌম্যদীপ রায়, পৌলমী ঘটক, মৌমা দাস, শরথ কমলদের আদর্শ মানা সিন্ড্রেলা।

sports

খেলায় মগ্ন সিন্ড্রেলা। ছবি: সংগৃহীত।

খেলার জন্য স্কুল বদলাতে হয়েছে সিন্ড্রেলাকে। আইসিএসই থেকে বারাসতের একটি সিবিএসই স্কুলে স্পোর্টস কোটায় ভর্তি হয়েছে সে। ফলে এখন হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ি নেই। খালি পরীক্ষা দিলেই হয়। অবশ্য খেলার জন্য লেখাপড়ার ক্ষতি হোক, চায় না সিন্ড্রেলা। তাই অবসর সময়ে পড়ে ফেলে সে। একটা নির্দিষ্ট ডায়েটের মধ্যে থাকতে হয় তাকে। কী রকম খাবার খেতে হয় সিন্ড্রেলাকে? জবাবে সে বলল, “সেদ্ধ সব্জি খাই। সকালে উঠে রাগি খাই। অনুশীলনের মাঝে ড্রাই ফ্রুট, কলা, ডিম খাই। মাছ খেতে খুব একটা ভাল লাগে না। তবে টুনা মাছ খাই। ফুচকার পর আমার প্রিয় হল মুরগির মাংস। স্ট্যু করে খাই। আবার ঝোলও খাই।” খেলতে গেলে রান্নার ব্যবস্থা থাকে। ১৫ বছরের মেয়ে দরকার পড়লে নিজেও রান্না করে নিতে পারে।

খেলার জন্য আগের মতো আর বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরানো হয় না। জামাকাপড় কিনলেও পুজোয় পরা হয় না। তাই খেলতে গেলে সঙ্গে করে নতুন জামাকাপড় নিয়ে যায় সিন্ড্রেলা। বিরিয়ানি খুব একটা ভালবাসে না সে। চকোলেট খাওয়াও নির্ভর করে ইচ্ছার উপর। তবে ফুচকা খেতে খুব ভালবাসে সিন্ড্রেলা। ওর কথায়, “কলকাতার মতো ফুচকা কোথাও পাওয়া যায় না। তাই বাড়িতে থাকলে পেট ফরে ফুচকা খাই।”

বছরভর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের বাইরে থাকায় বাড়িতে খুব একটা থাকা হয় না সিন্ড্রেলার। কিন্তু এখন আর ও বাড়িকে মিস্‌ করে না। কারণ, সিন্ড্রেলা জানে ওর আসল লক্ষ্য কী। তার জন্য যে ত্যাগ ওকে করতে হবে তার জন্য তৈরি ছোট্ট মেয়ে। আপাতত ব্যাট আর টেবল টেনিস বোর্ডই ওর ধ্যান-জ্ঞান। একটার পর একটা প্রতিযোগিতায় খেলছে সিন্ড্রেলা। লক্ষ্য অলিম্পিক্স। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে কলকাতার বাঘাযতীনের মেয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

Syndrela Das Table Tennis Indian Table Tennis Team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy