বিতর্ক: পৃথ্বীর ডোপিং নিয়ে বোর্ডের ভূমিকায় প্রশ্ন। ফাইল চিত্র
বহু বছরের বিদ্রোহ শেষ করে অবশেষে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ডোপ-বিরোধী সংস্থা নাডার অধীনে আসতে রাজি হল। যার অর্থ, এ বার থেকে ভারতের অন্যান্য খেলার ক্রীড়াবিদদের মতো মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মাদের ডোপ পরীক্ষাও হবে জাতীয় ডোপ-বিরোধী সংস্থার তত্ত্বাবধানে।
বৃহত্তর ক্যানভাসে অবশ্য প্রশ্ন উঠছে, অন্যান্য খেলার মতো ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও এ বার জাতীয় স্পোর্টস ফেডারেশন হয়ে উঠল কি না। এর পর কতটা স্বশাসিত থাকতে পারবে তারা। আরও কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, অন্যান্য ক্রীড়া সংস্থার মতো এর পর সরকারের আরটিআই (রাইট টু ইনফর্মেশন বা তথ্য জানার অধিকার) আইনের আওতাতে কোহালিদের বোর্ডকে আনার চেষ্টা শুরু হবে কি না।
ভারতীয় বোর্ড অর্থকরী দিক থেকে স্বশাসিত সংস্থা। এখনও তারা সে রকমই থাকবে। সরকারের আরটিআই নিয়মের আওতায় ক্রিকেটকে আনার চেষ্টা হলেও বোর্ড কর্তারা এখনও প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সরকারের চাপে যে ভাবে ডোপিং নিয়ে ‘বোল্ড’ হলেন তাঁরা, তাতে অনেকের মনে হচ্ছে, আরটিআই-এর আওতায় এনে ফেলতেই বা কতক্ষণ?
ভারতীয় বোর্ড সওয়াল করে চলেছিল, নাডার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। ক্রিকেট কর্তাদের দাবি ছিল, ক্রিকেটারদের নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের দ্বারা নিযুক্ত এজেন্সির উপরে বেশি আস্থা রাখছে। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নাডা প্রতিনিধিরা নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে মারাত্মক সব ভুল করেছে বলে অভিযোগ তুলেছিল বোর্ড। তাদের সেই আপত্তিতে প্রাথমিক ভাবে কাজও হয়েছিল। এমনকি, ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি পর্যন্ত সম্মতি দিয়ে দেয়। কিন্তু সরকারের চাপে নাডার অধীনে আসতে বাধ্যই হল বোর্ড। একে তো দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এ’ এবং মহিলা দলের ভারত সফর আটকে রেখে পরোক্ষে চাপ তৈরি করতে শুরু করেছিল সরকার। দ্বিতীয়ত, পৃথ্বী শ-কে নিয়ে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক ডোপ-বিতর্ক বোর্ডকে আরও বেশি কোণঠাসা করে তুলছিল। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, পৃথ্বীর ডোপের ঘটনা নিয়ে বোর্ড যে ফিরিস্তি দিয়েছে, তা আদৌ সত্যি কি না? সন্দেহ তৈরি হয়েছে, বোর্ড কিছু চাপছে কি না। বিতর্ককে উস্কে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রক পৃথ্বী নিয়ে পত্রাঘাতও করেছিল বোর্ডকে। তখন থেকেই চাপ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত সরকারের গুগলিতে ‘বোল্ড’ হয়ে গেল কোহালিদের বোর্ড।
রাতের দিকে জানা গেল, বোর্ড কর্তারা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের চাপের সামনে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স (সিওএ) নতি স্বীকার করে নিল। কোনও লড়াই করল না। কেউ কেউ উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘বোর্ডের সাধারণ সভা না-ডেকে এ ভাবে দু’এক জনে মিলে এত বড় সিদ্ধান্ত কী ভাবে নিয়ে নেওয়া হল?’’ কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন সেই বোর্ড কর্তাদেরই অস্তিত্ব সঙ্কট চলছে লোঢা সংস্কারের চাপে। তাই তাঁদের উষ্মা প্রকাশে কতটা কী পরিস্থিতি পাল্টাবে, সন্দেহ থাকছে।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় ক্রীড়াসচিব রাধেশ্যাম ঝুলানিয়া বোর্ডের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার রাহুল জোহরি এবং জেনারেল ম্যানেজার (ক্রিকেট অপারেশনস) সাবা করিমের সঙ্গে বৈঠক করেন। ক্রীড়াসচিবের সঙ্গে ছিলেন নাডার ডিজি নবীন আগরওয়াল। তাঁদের উপস্থিতিতে নাডার অধীনে আসার ব্যাপারে চুক্তি সাক্ষর করে দেন রাহুল জোহরিরা। ক্রীড়াসচিব ঝুলানিয়া বলেন, ‘‘এখন থেকে সব ক্রিকেটারের ডোপ পরীক্ষাও করবে নাডাই।’’ আরও বলেন, ‘‘ক্রিকেট বোর্ড আমাদের সামনে তিনটি ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ডোপ পরীক্ষার সরঞ্জামের গুণগত মান, প্যাথোলজিস্টদের যোগ্যতা এবং নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে নিখুঁত প্রক্রিয়া মানা নিয়ে তাদের সংশয় ছিল। আমরা বলেছি, বোর্ড যে ধরনের প্রক্রিয়া চাইবে, সেটাই মানা হবে। তার জন্য কিছু বেশি খরচ দিতে হতে পারে। কিন্তু একই প্রক্রিয়া সকলের জন্য প্রয়োগ করা হবে।’’
ভারতীয় ক্রিকেট কর্তাদের চিন্তা বাড়িয়ে এর পর ক্রীড়াসচিব বলে দেন, ‘‘ক্রিকেট বোর্ড অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। তাদেরও দেশের আইন মেনেই চলতে হবে।’’ তাঁর আরও হুঙ্কার, ‘‘যে কোনও জায়গায় গিয়ে যে কোনও সময়ে ক্রিকেটারদের ডোপ পরীক্ষা করবে নাডা। অতীতে যে এজেন্সি ক্রিকেটারদের নমুনা সংগ্রহ করত, তারা এখন আর থাকবে না। সেই নমুনা সংগ্রহ করবে নাডা।’’
অতীতে সরকারের দিক থেকে একই রকমের চাপের সামনে জগমোহন ডালমিয়া বা এন শ্রীনিবাসনের মতো দুঁদে কর্তারা পাল্টা সওয়াল করেছেন যে, ক্রিকেট বোর্ড স্বশাসিত সংস্থা। অন্য খেলার জাতীয় সংস্থার মতো সরকারের অনুদানে তাঁদের চলতে হয় না। তাই সরকারি ফতোয়া তাঁরা মানতে বাধ্য নন। এখন সেই লঙ্কাও নেই, সেই রাবণও নেই। বোর্ড চালান কর্তারা নন, আদালত নিযুক্ত পর্যবেক্ষকেরা। বোর্ডের সিইও জোহরি এ দিন পরাজিতের মতো বলে যান, ‘‘বোর্ড দেশের আইন মেনে চলবে। আমরা কতগুলি প্রশ্ন তুলেছি। সেগুলি দেখা হবে বলে ক্রীড়াসচিব আশ্বাস দিয়েছেন।’’ সভায় ধমকের সুরে ক্রীড়াসচিব বোর্ড প্রতিনিধিদের বলেন, ‘‘মানব কী মানব না, সেই ভাবনার জায়গাই আর নেই। দেশের নিয়ম ক্রিকেটকেও মানতে হবে।’’ ওখানেই উইকেট উড়ে যায় বোর্ডের। আরটিআই-এর আওতায় আসা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে যান জোহরি। ‘‘আজকের বৈঠকে আরটিআই নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না,’’ বলেছেন তিনি।
ডোপ পরীক্ষা নাডার হাতে চলে যাওয়া মানে ভারতীয় ক্রিকেটারদের ‘হোয়্যারঅ্যাবাউটস ক্লজ’ নিয়ে আপত্তিও আর কেউ শুনবে না। এই ধারা অনুযায়ী, যখন কোনও ক্রীড়াবিদ খেলার মধ্যে থাকেন না, তখনও ডোপ পরীক্ষার জন্য নমুনা নিতে উপস্থিত হতে পারেন প্রতিনিধিরা। কেউ যদি একাধিক বার সেই তারিখ অনুযায়ী উপস্থিত না হন, বিশ্ব ডোপ-বিরোধী সংস্থা ওয়াডার নির্দেশে তিনি নির্বাসিত হতে পারেন। ঠিক এই কারণেই নির্বাসিত হয়েছিলেন আন্দ্রে রাসেল।
এত দিন লোঢার চাবুক পড়ছিল বোর্ডের গায়ে। শুক্রবার নতুন এক ‘অভিভাবক’ এসে পড়ল। কেন্দ্রীয় সরকার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy