প্যারিস অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের খেলোয়াড়েরা। ছবি: রয়টার্স।
ভালবাসার শহরে এ বারের অলিম্পিক্স। প্যারিসের স্যেন নদীর উপরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাবনা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার ভারতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে সেই অনুষ্ঠান যাঁরা দেখলেন, তাঁদের মন ভরল কি?
এত দিন অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী মানেই ছিল স্টেডিয়ামের ভিতরে জমকালো অনুষ্ঠান। সেই সঙ্গে পতাকা হাতে খেলোয়াড়দের হেঁটে আসা। আয়োজক দেশ নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরে ওই অনুষ্ঠানে। প্যারিসের ভাবনাও তেমনই ছিল। কিন্তু চমক ছিল খেলোয়াড়দের নৌকা করে নিয়ে আসায়। ৯৪টি নৌকা করে এলেন ২১১টি দেশের খেলোয়াড়েরা। ছোট, বড় নৌকা করে নিয়ে আসা হল তাঁদের। আর নদীর পাড়ে হল বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কখনও গাইলেন লেডি গাগা, কখনও পরিচয় করানো হল প্যারিসের সংস্কৃতির সঙ্গে। কিন্তু এই সব কিছু যখন ঘটছে, তখন অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজছে প্যারিস। যার প্রভাব পড়ল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উপরেও।
ভারতীয় সময় রাত ১১টা থেকে শুরু হয় প্যারিস অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ফুটবলার জিনেদিন জিদানের হাতে ছিল অলিম্পিক্সের মশাল। যা তিনি তুলে দেন তিন শিশুর হাতে। তাঁদের হাত থেকে সেই মশাল চলে যায় এক অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে। গোটা অনুষ্ঠানে জুড়ে তাঁর মুখ ছিল ঢাকা। যে সময় অনুষ্ঠান শুরু হয়, তখন ফ্রান্সে বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো রয়েছে। কিন্তু মেঘলা আকাশের কারণে রংহীন মনে হচ্ছিল ভালবাসার শহরকে। চার ঘণ্টার অনুষ্ঠানের শেষের দিকে অন্ধকার হওয়ার পর আলো জ্বালিয়ে দেয়াও হয়। তাতে এক মায়াবি ছবি তৈরি হলেও বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া খেলোয়াড়েরা তখন বেশ ক্লান্ত। বিভিন্ন দেশের অতিথিরা এসেছিলেন অলিম্পিক্সের উদ্বোধনে। তাঁদের মুখেও তখন বিরক্তির ছাপ।
গোটা অনুষ্ঠান নদীতে হওয়ার কারণে সব অনুষ্ঠান, সকলে দেখতে পাননি। প্যারিস শহরের বিভিন্ন স্থাপত্যকে তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। কিন্তু সে সব সম্প্রচারকারী সংস্থা দেখাতে পারলেও স্যেন নদীর ধারে বসে থাকা দর্শকদের ভরসা ছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। সামনে দিয়ে ভেসে চলেছে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নৌকা। কোন দিকে চোখ রাখবেন তা বোঝা ভার।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে জল দিয়ে বিশেষ পর্দা তৈরি করা হয়েছিল। সেই পর্দা ভেঙে প্রথমে এগিয়ে এল গ্রিস। পন্ট ডি’এলিনা ব্রিজের তলা দিয়ে বেরিয়ে এল তারা। তার পরে এল উদ্বাস্তুদের অলিম্পিক্স দল। এর পর আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, জার্মানি একটি বড় নৌকা করে একই সঙ্গে এল। একে একে বিভিন্ন দেশের নৌকা যখন ওই জলের পর্দা ভেদ করে এগিয়ে আসছে, সেই সময় অন্য দিকে জ্ঞান গাইছেন লেডি গাগা।
প্যারেডের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় স্যেন নদীর ধারে। একই সঙ্গে টিভিতে বা বড় পর্দায় যাঁরা দেখছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ তথ্যচিত্র দেখানো হয়। নোটরডামের সামনে পারফর্ম করল মুল্যাঁ রুজ। ১৮২০-র দশকে সৃ্ষ্টি হওয়া একটি বিশেষ নাচ ফিরিয়ে আনল তারা। ফরাসি ভাষা জানা শিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় শিল্পী আয়া নাকামুরা পারফর্ম করলেন। তাঁর সঙ্গে রিপাকলিকান গার্ডের বাদ্যযন্ত্রী এবং ফরাসি সেনার শিল্পীরা সঙ্গত করলেন।
গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে অনেক কিছুই হল। কিন্তু কোনটা ছেড়ে, কোনটা দর্শক দেখব তা বোঝা ভার। কিছু কিছু অনুষ্ঠান তো দেখাই সম্ভব নয়। কারণ মাঝ নদীতে হওয়া ফ্যাশন শো, নাচ দেখার জন্য ভরসা জায়ান্ট স্ক্রিনই। লাখ লাখ টাকা দিয়ে টিকিট কাটলেও নদীর মাঝে কী ঘটে চলেছে তা পাড় থেকে বসে দেখা সম্ভব নয়।
রাত ১২.৩০ নাগাদ ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের নৌকা এগিয়ে এল স্যেন নদী ধরে। পতাকা ধরা ছিল পিভি সিন্ধু এবং শরথের হাতে। বাকি খেলোয়াড়েরা হাতে ছোট ছোট জাতীয় পতাকা দোলালেন। প্যারিসের বৃষ্টির কারণে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই বর্ষাতি পরে ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের মহিলা খেলোয়াড়েরা পরেছিলেন সাদা রঙের শাড়ি সঙ্গে কমলা রঙের ব্লাউজ়। পুরুষেরা পরেছিলেন কুর্তা। উপরে সাদা রঙের জ্যাকেট। তাতে ভারতের জাতীয় পতাকার রংয়ের কারুকাজ।
বিভিন্ন দেশের নৌকা যখন স্যেন নদী ধরে এগিয়ে চলেছে, তখন ফ্রান্সের অন্যতম সেরা সংগ্রহশালা, প্রদর্শনী স্থল গ্রাঁ প্যালাই থেকে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন অ্যাক্সেল সাঁ-সিরেল। ফ্রান্সের ইতিহাসে ১০ জন সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলার মূর্তি উন্মোচন করা হল। সঙ্গে বর্ণনা করা হল তাঁদের কৃতিত্বের। পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই চলল বৃষ্টি। দর্শক, প্রতিযোগী, পারফর্মার সকলেই ভিজলেন।
প্যারেডের শেষ তিন দেশ হিসাবে পর পর এল অস্ট্রেলিয়া (২০৩২ অলিম্পিক্সের আয়োজক), আমেরিকা (২০২৮ অলিম্পিক্সের আয়োজক) এবং ফ্রান্স (এ বারের আয়োজক)। ফ্রান্সের নৌকাটি বাকি সকলের থেকে আলাদা।
চমক তৈরির চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি ফ্রান্স। দেশগুলির প্যারেড শেষ। এ বার একের পর এক বিশেষ নৌকা এগিয়ে আসছে। কোনওটিতে চলছে ফ্যাশন শো, কোনওটিতে নাচগান। দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি তুলে ধরা হচ্ছে সেই সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শেষবেলায় যা কিছুটা নজর কাড়ল টিভিতে চোখ রাখা দর্শকদের।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ঘোড়ায় চড়ে এক ব্যক্তি নিয়ে এলেন অলিম্পিক্সের পতাকা। আইফেল টাওয়ারের নীচে বিরাট সংখ্যক দর্শক তখন অপেক্ষা করছেন। তাঁদের সামনে উড়ল অলিম্পিক্সের পতাকা, গাওয়া হল এই প্রতিযোগিতার অ্যান্থেম। সেখানে প্যারিস অলিম্পিক্স আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্তানগুয়েত এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান থমাস বাক সকল খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানান। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ প্যারিস অলিম্পিক্সের সূচনা করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অলিম্পিক্সের মশাল হাতে নেন জিসান। তাঁর হাত থেকে সেই মশাল নেন রাফায়েল নাদাল। নৌকায় করে সেই মশাল নিয়ে স্যেন নদীর উপরে দেখা যায় নাদাল, সেরেনা উইলিয়ামস, কার্ল লুইসকে। আইফেল টাওয়ার জুড়ে আলোর খেলা দেখা যায়। ফ্রান্সের বিভিন্ন তারকাদের হাতে ঘুরল অলিম্পিক্সের মশাল। শেষে গান গাইলেন সেলিনে ডিয়ন। ১৯৯৬ সালের অ্যাটলান্টা অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy