Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

নীল জোয়ারে দোস্তির গান আর জয় হো

রবিবারের ওভালের দখলই যেন নিয়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা। যে দিকে চোখ যায়, শুধু নীল জার্সি আর তেরঙ্গার আধিক্য। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে তা-ও দর্শক বিভাজনের সমীকরণ ছিল ৬৫-৩৫।

ওভাল গ্যালারি যখন ভারতের দখলে। রবিবার। ছবি: টুইটার

ওভাল গ্যালারি যখন ভারতের দখলে। রবিবার। ছবি: টুইটার

সুমিত ঘোষ
লন্ডন শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৭ ০৪:২৪
Share: Save:

রবিবারের ওভালে এ বি ডিভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকা দু’টো ম্যাচ হারল।

না, না, বলা উচিত দু’টো ম্যাচেই একপেশে ভাবে হারল। একটা মাঠের লড়াই। যেখানে বিরাট কোহালির দল রীতিমতো ছেলেখেলা করল তাঁর আইপিএল সতীর্থ এবং ভীষণ প্রিয় বন্ধু ডিভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে।

অন্যটা গ্যালারির দ্বৈরথ। এবং, সেখানে আরও বেশি করে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি।

রবিবারের ওভালের দখলই যেন নিয়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা। যে দিকে চোখ যায়, শুধু নীল জার্সি আর তেরঙ্গার আধিক্য। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে তা-ও দর্শক বিভাজনের সমীকরণ ছিল ৬৫-৩৫। ভারতীয়রা ৬৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৩৫। ম্যাচ জেতার পরে শ্রীলঙ্কান সমর্থকেরা দারুণ উৎসবও করেছিলেন। ভারতীয় দর্শকেরা ফিরেছিলেন হতাশ হয়ে।

এ দিন দর্শক সমর্থনের হিসেব শতাংশের হিসেবে একেবারে ৯০-১০ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকানদের প্রায় চোখেই পড়েনি। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, লন্ডনের ওভালে কোথায়, এ তো দেশের মাঠে খেলতে নেমেছেন বিরাট কোহালি-রা। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে বা কলকাতায় ইডেনে খেলা হলে এমনই মায়াবী পরিবেশ থাকে। এমনই জনবল থাকে কোহালিদের জন্য।

আরও পড়ুন: ‘চোর চোর’ বলে ধিক্কার মাল্য পিতা-পুত্রকে

এমনিতে বিদেশের যে কোনও মাঠে এখন ভারতীয় দর্শকরা সংখ্যাধিক্য। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ এই সে দিনও ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে বলে গিয়েছেন, ‘‘ভারতীয়রা সব জায়গায় রয়েছে। বিশ্বের সমস্ত মাঠে ভারতের সমর্থকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।’’ ম্যাথিউজের কথাটা আরও এক বার সঠিক প্রমাণ করে দিল রবিবারের ওভাল।

বিশ্বের কয়েকটি মাঠ আছে, যেখানে ভারতীয় সমর্থকদের সংখ্যা অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডিলেড বা দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান। এখানে ম্যাচ হলে গ্যালারিতেও ভারতীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকেন। ইংল্যান্ডে ‘ভারতীয়দের মাঠ’ হিসেবে এতদিন বেশি করে পরিচিতি ছিল বার্মিংহামের। তার সঙ্গে বড়জোর যোগ হতে পারে ম্যাঞ্চেস্টারের নাম। বরাবর এই দু’টো শহরেই সব চেয়ে বেশি সমর্থন হাজির থেকেছে ভারতীয় দলের জন্য।

আরিয়ানা গ্রান্দের কনসার্টে সন্ত্রাসবাদী হামলা হওয়া ম্যাঞ্চেস্টারে এ বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির কোনও ম্যাচ নেই। আগে থেকেই সূচিতে জায়গা পায়নি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড।

বার্মিংহামে ভারত-পাক মহারণ হয়েছে এবং সেখানে দর্শক উপস্থিতির হিসেবে ভারতই এগিয়ে ছিল। পাক-বধের উৎসবও দারুণ ভাবে সেরেছিলেন ভারতীয় ভক্তরা। ভাংড়া নাচ আর ব্যান্ডের তালে তালে উদ্দাম সব দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ভারতের প্রথম ম্যাচে।

লন্ডনে দুরন্ত সব মাইলস্টোন রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের। কপিল দেবের দৈত্যদের প্রথম বিশ্বকাপ জয় তিরাশির লর্ডসে। ন্যাটওয়েস্ট জিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত জামা খুলে ওড়ানো। অথবা এই ওভালেই সুনীল গাওস্করের দুরন্ত ২২১। কিন্তু ভারতীয় জনতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে টিউব থেকে বাস স্টেশন এবং এক কথায় পুরো ওভাল অঞ্চলেরই দখল নিয়ে নেওয়া কখনও দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ।

মরণবাঁচন ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৯১-তে শেষ করে দেওয়ার পরে স্টেডিয়াম চক্কর দিতে গিয়ে মনে হল, দ্বিতীয় ইনিংসটাই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। জনতা ধরে নিয়েছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে কোহালিদের অকাল বিদায় ঘটছে না। প্রত্যেকটা স্ট্যান্ডের নীচে বার আর নানাবিধ খাবারের কাউন্টার রয়েছে। মাঝপথেই সেখানে পানীয়ের ফোয়ারা আর জয়ধ্বনি উঠেছে।

একটু এগিয়ে লেকার স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে দেখা গেল উদ্দাম ব্যান্ডের সঙ্গে নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে। ধোনি, কোহালিদের নামে তো বটেই এই ম্যাচে খেলছেন না, এমন এক জনের নামেও জয়ধ্বনি উঠছে ভিড়ের মধ্যে থেকে। এর পর এক জন একটা পোস্টার তুলতে স্পষ্ট হয়ে গেল, কার নামে ওই ধ্বনি। পোস্টারটিতে লেখা, ‘আমার জীবন ক্রিকেট, আমার ঈশ্বরের নাম সচিন তেন্ডুলকর’।

জ্যাক হব্‌স গেট। আলেক স্টুয়ার্ট গেট। জন এডরিচ গেট। সর্বত্র একই ছবি। নীল সমুদ্রের স্রোতে ভাসছে গোটা মাঠ। অন্তত আশি শতাংশ মানুষের পরণে ভারতীয় দলের নীল জার্সি। কী পুরুষ, কী মহিলা, কী মধ্যবয়স্ক, কী তরুণ, কী তরুণী বা শিশুরা। দেখে মনে হবে, অঘোষিত জাতীয় পোশাকই যেন ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা গায়ে চাপিয়ে নিয়েছেন ওভালে আসার আগে। আর সেটা হল কোহালিদের নীল জার্সি। সবচেয়ে বেশি করে তিন জনের নাম দেখা গেল ভক্তদের সেই জার্সির পিঠে। কোহালি, ধোনি এবং যুবরাজ সিংহ।

ইংল্যান্ডে খুবই সক্রিয় ‘ভারত আর্মি’। তাঁদের সশব্দ উপস্থিতি ওভালে গ্যালারির ম্যাচটায় আরও বেশি করে ভারতকে জিতিয়ে দিল। ভারত আর্মি অনেক ক্রিকেটারকে নিয়ে গান বেঁধেছে। যেমন কোহালিকে নিয়ে রয়েছে— ‘ওহ্ বিরাট কোহালিজ ম্যাজিক/হি ওয়্যার্স দ্য ম্যাজিক হ্যাট/হি সিজ দ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি/অ্যান্ড সেড আই ফ্যান্সি দ্যাট/হি উইল ফ্লিক ইট অন দ্য লেগ সাইড, স্ম্যাশ ইট অন দ্য অফ...’। ধোনিকে নিয়ে চলতি টুর্নামেন্টের গান হচ্ছে, ‘হি ইজ আওয়ার ধোনি/আওয়ার ফেমাস ধোনি/হি ইজ হিয়ার টু লিফ্‌ট দ্য কাপ/উই আর হিজ সেট অব ফিয়ারলেস সাপোর্টার্স’!

ভারত আর্মির হাজার হাজার সৈন্যের উপস্থিতিতে ওভালে সারা দিন ধরে ধোনি-কোহালিদের নিয়ে তৈরি গানগুলো তো শোনা গেলই। দু’টো জনপ্রিয় ভারতীয় গানও খুব জোরে জোরে বাজতে থাকল। একটা লাঞ্চের সময়— ইয়ে দোস্তি, হম নহি তোরেঙ্গে! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইতে গাইতে ভারতীয় সমর্থকদের একটি গ্রুপ বলে উঠল, ‘‘দোস্তির বন্ডিংটাও এখানে করে নিলাম আমরা। এর পর বার্মিংহাম জয় করব। তার পর আবার ওভালে ফিরব কাপ জেতার জন্য।’’ বলেই আবার তাঁরা গাইতে শুরু করে দিলেন, ‘‘ইয়ে দোস্তি, হম নহি তোড়েঙ্গে।’’ কোহালি-যুবরাজ অপরাজিত থেকে উইনিং স্ট্রোকটা নেওয়া মাত্র আবার স্টেডিয়ামে জোরে বাজিয়ে দেওয়া হল ‘জয় হো!’

কে বলবে কোহালিরা ওভালে জিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে গেলেন! এ তো মনে হচ্ছিল, ওয়াংখেড়েতে ৭২ বল বাকি থাকতে ৮ উইকেটে বিশাল জয় এল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE