বাটলা গ্রামের বিশ্বকাপজয়ী তিন সতীর্থের সঙ্গে অধিনায়ক হরজিৎ (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
জলন্ধরের সংসারপুরকে বলা হয় হকি অলিম্পিয়ানদের গ্রাম। সেখানকার প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে পাওয়া যায় অলিম্পিক্স পদক!
এই গ্রাম থেকেই উধম সিংহ, দর্শন সিংহ, অজিত পাল সিংহ, বলবীর সিংহের (সিনিয়র) মতো বহু তারকা উঠে এসে নেমেছেন অলিম্পিক্স হকিতে।
পঞ্জাবের আরও একটি গ্রাম হঠাৎ-ই ভারতীয় হকির মানচিত্রে সোনার আলো ঝরিয়ে ঢুকে পড়েছে। পনেরো বছর বাদে জুনিয়র হকির বিশ্বকাপ জেতার পর যে গ্রামকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। গুরুদাসপুর মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের অন্তর্গত সেই গ্রামের নাম বাটলা।
যে গ্রামের নাকি ঘুম ভাঙে হকি স্টিকের সঙ্গে বলের ঠকাঠক আওয়াজে! ‘এ-বি-সি-ডি’ শেখার মতো বাচ্চারা নাড়াচাড়া করেন হকি স্টিক। বাবা-কাকা-দাদাদের থেকে নিয়ে।
সদ্য জুনিয়র বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের বেশ কয়েকজন সদস্য এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন। গত রবিবারই লখনউয়ে যুব বিশ্বকাপ ফাইনালের দুই গোলদাতা গুরজন্ত সিংহ এবং সিমরনজিৎ সিংহ-ও বাটলার ছেলে। হকি বিশ্বকাপের গ্রাম থেকে কলকাতায় বেটন কাপ খেলতে এসে গুরজন্ত এ দিন বললেন, ‘‘আমাদের গ্রামে এমন অবস্থা যে জন্মের কয়েকের বছরের মধ্যেই সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় ছোট্ট হকি স্টিক। দেওয়া হয় হকি বল।’’ সঙ্গে আরও যোগ করলেন, ‘‘গ্রামের সবাই হকি ছাড়া অন্য খেলা কিছু ভাবতেই পারে না। আমাদের গ্রামে ক্রিকেট-ফুটবল নেই। ঘরে ঘরে হকি প্লেয়ার।’’
ভারতের ইতিহাসে বাটলার আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। দেশ ভাগের সময় প্রথমে বাটলা পাকিস্তানে পড়েছিল। পরে রাজনৈতিক কারণে বাটলা ভারতের মানচিত্রে চলে আসে। তবে অতীত ইতিহাস নয়, বাটলায় নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন সিমরনজিৎরা। হকি বিশ্বকাপারদের গ্রামের কথাটা প্রথম শোনা গেল তাঁর মুখ থেকেই। সল্টলেক সাইতে বেটনের হতশ্রী দশার মধ্যেও যা উজ্জ্বল করছিল পঞ্জাবী টিনএজারের মুখ। বলছিলেন, ‘‘আমার পরিবারের সবাইকে ছোট থেকে হকি খেলতে দেখেছি। বাবা-দাদা কেউই বাদ ছিল না। তাই আমিও হকি খেলাটা কী, সেটা বুঝে ওঠার আগেই স্টিক নিয়ে বল মারতে শুরু করেছিলাম।’’ গুরজন্তের পরিবারেরও একই অবস্থা। সবাই হকি পাগল। হাসতে হাসতে ঝকঝকে তরুণ গুরজন্ত বলছিলেন, ‘‘হকি নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই আমাদের গ্রামে। হকি না খেলাটাই মনে হয়ে ওখানে অপরাধ।’’
বিশ্বকাপজয়ী দলের আর এক সদস্য বিক্রমজিৎ সিংহ কৃষক পরিবারের ছেলে। বাটলাবাসী পরিবারের কারও সঙ্গে হকির কোনও যোগ নেই। কিন্তু যে গ্রামের বাতাসে প্রতি মুহূর্তে হকির গন্ধ ভেসে বেড়ায় সেখানকার ছেলে কী করে হকি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন! স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির হলে কী হবে, গ্রামের প্রসঙ্গ উঠতেই উচ্ছ্বাস তাঁর গলায়। সাইয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে বিক্রম বলে দিলেন, ‘‘ছোট থেকেই হকির প্রতি টান অনুভব করতাম। চারপাশের সবাইকে হকি খেলতে দেখে আরও উৎসাহ পেতাম। শেষ পর্যন্ত একদিন নিজেও হকি স্টিক নিয়ে মাঠে নেমে পড়লাম। আর এখন তো আমি বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের খেলোয়াড়।’’
সিমরনজিতদের এক সুতোয় বেঁধেছিলেন হরেন্দ্র সিংহ। যাঁর কোচিংয়ে বিশ্বজয় জয় করেছে জুনিয়র ভারতীয় হকি টিম। কিন্তু এই লড়াইটা হরজিৎ-গুরজন্তদের কাছে সহজ ছিল না। কঠিন অনুশীলন করতে হয়েছে সবাইকে। সকাল সাড়ে ছ’টায় ঘুম ভাঙা থেকে রাত আটটায় শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি— এই দিনলিপির বাইরে অন্য কিছু ভাবার সুযোগই ছিল না হরজিৎদের। বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক হরজিৎ এ দিন বললেন, ‘‘খুব কষ্ট হত তখন। জানেন, প্রায় তিন মাস মিষ্টি খাইনি। কোচেরা এখন যে কেন মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে দেন! তবে বিশ্বজয় করার পর বুঝেছি, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। আর ফলটাও হাতেনাতে পাওয়া যায়।’’
কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে দেড় যুগ পর জুনিয়র বিশ্বকাপ জয়ের রসায়ন। মানসিক ভাবে প্লেয়াররা কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন বলে কোচ হরেন্দ্র তাঁদের মনোবল বাড়াতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন। কখনও সমুদ্র থেকে সাড়ে সাত হাজার ফিট উঁচুতে, যেখানে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কম। সেই শিলারুতে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে দেশের সবচেয়ে উঁচু হকির অ্যাস্ট্রো টার্ফ রয়েছে। আবার পাহাড় থেকে নেমেই দিল্লির অসম্ভব গরমে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে হরজিৎদের। কখনও বেঙ্গালুরুতে। হকি দলের মনোবিদ মৃণাল চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘আমাদের কোচই প্রথম হকি টিমে একজন মনোবিদের প্রয়োজন আছে, দাবি জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন উপায়ে প্লেয়ারদের মনোবল বাড়ানোই আমার আসল কাজ ছিল।’’
আসন্ন হকি ইন্ডিয়া লিগের সব থেকে দামী প্লেয়ার গুরবাজ সিংহও জুনিয়রদের পারফরম্যান্সে উচ্ছ্বসিত। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্স খেলা গুরবাজ বলছিলেন, ‘‘এই টিমটার মনের জোর সাংঘাতিক। এ ভাবেই যদি পারফরম্যান্স করে ওরা, তা হলে আরও বড় সাফল্য পাবে।’’
গুরজন্ত-সিমরনজিৎদের মনোবল এখন এতটাই বেশি যে তাঁরা বিনা দ্বিধায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ভয় পাচ্ছেন না। যেমন এ দিন দু’জনই বলে দিলেন, ‘‘আমরা যদি টোকিও অলিম্পিক্সে খেলার সুযোগ পাই তবে ভারতকে পদক এনে দেবই।’’ গুরজন্তরা সত্যি যদি অলিম্পিক্সের মঞ্চ থেকে পদক নিয়ে ফিরতে পারেন, তবে তাঁদের বাটলা গ্রামের নামও সংসারপুরের মতোই হকি অলিম্পিয়ানদের গ্রাম হয়ে যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy