Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মুকুট অক্ষত রেখে শ্রীনি উল্টে বললেন বিদর্ভের অনুদানের টাকা এ বার কাটো

বছরখানেক আগে ম্যাচের মুখ্য মুহূর্তে লেখা হত, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় হারের মধ্যে দাঁড়িয়ে একমাত্র সচিন তেন্ডুলকর। আপাতত তেমনই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন আর বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর পুনর্মনোনয়নের মধ্যে দাঁড়িয়ে একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট! ভারতীয় বোর্ড নিছক ভারতীয় বোর্ডের মনোনয়ন যদি মাপকাঠি হত, শ্রীনিবাসন মঙ্গলবারই প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছেন। আনন্দবাজারে গতকালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চেন্নাইয়ের বৈকালিক সভা এ দিন তাঁকে এক রকম বরমাল্য পরিয়ে দিল।

সভা শেষে শ্রীনি। ছবি: পিটিআই

সভা শেষে শ্রীনি। ছবি: পিটিআই

গৌতম ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৪ ০২:১৬
Share: Save:

বছরখানেক আগে ম্যাচের মুখ্য মুহূর্তে লেখা হত, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় হারের মধ্যে দাঁড়িয়ে একমাত্র সচিন তেন্ডুলকর।

আপাতত তেমনই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন আর বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর পুনর্মনোনয়নের মধ্যে দাঁড়িয়ে একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট!

ভারতীয় বোর্ড নিছক ভারতীয় বোর্ডের মনোনয়ন যদি মাপকাঠি হত, শ্রীনিবাসন মঙ্গলবারই প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছেন। আনন্দবাজারে গতকালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চেন্নাইয়ের বৈকালিক সভা এ দিন তাঁকে এক রকম বরমাল্য পরিয়ে দিল। হে শ্রীনি, আপনিই ক্রিকেট প্রশাসনিক মহানায়ক। ১৭ ডিসেম্বর বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় আপনিই আমাদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট হবেন।

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, শ্রীনির বোর্ডের বৈঠক চেয়ার করার কোনও অধিকার নেই। তিনি বৈঠকে এসেছিলেন আর পাঁচটা সংস্থার মতোই স্রেফ তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে। আর বরাবরের মতো আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনিই হেড টেবিলে বসে যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করলেন। প্রথমে সদস্যদের হাতে তুলে দিলেন মুদগল রিপোর্ট। যেখানে বলা হয়েছে, ম্যাচ গড়াপেটা বা বেটিং কোনও কিছুর সঙ্গেই শ্রীনিবাসন যুক্ত নন। তিনি নির্দোষ। চল্লিশ মিনিটের কাছাকাছি চলা বৈঠকে শ্রীনির নিজেকে নিয়ে সময় খরচ হয় সবচেয়ে কম। সাড়ে চার মিনিটের মতো। খবর ছিল, বিদর্ভ বা পঞ্জাবের মতো কোনও কোনও সংস্থা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করবে। বা পূর্বাঞ্চলের কোনও কোনও রাজ্য সুন্দর রামনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়বে। বাস্তবে এ সব কিছুই ঘটেনি। যেন ফেডেরার বনাম সোমদেব ম্যাচ হচ্ছে।

সেই ম্যাচে ফেডেরার যেমন খেলবেন, তেমনই একপেশে ভাবে শ্রীনি ওয়ার্কিং কমিটির সামনে কি না নির্দোষ প্রমাণ করিয়ে দিলেন আইপিএল সিইওকেও। পরম বিশ্বস্ত সুন্দর রামনকে নিয়ে তিনি সভায় ঢোকেন। আন্দাজ করা গিয়েছিল, শ্রীনিকে সভা ছাড় দিলেও সুন্দরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অথচ এমনই আনুগত্য আদায় করেন ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ প্রশাসক যে, সুন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেও কেউ সাহস পাননি। বরং সুন্দর তাঁর গত দু’বছরের কল-লিস্ট ফেলে দেন। সদস্যদের বলেন, এই দেখুন, গত দু’বছরে বিন্দু দারা সিংহকে আমি পাঁচ বার ফোন করেছি। কলগুলো কত সময়ের, সেটাও লক্ষ করুন। কোনওটা পঞ্চাশ সেকেন্ড, কোনওটা এক মিনিট। পঞ্চাশ সেকেন্ডে নিশ্চয়ই ম্যাচ গড়াপেটা বা বেটিংয়ের ছক তৈরি করা যায় না। তা ছাড়া আমি জানতামও না যে, বিন্দু একজন সন্দেহজনক চরিত্র। কল-লিস্ট দেখে সদস্যরা বলা শুরু করেন, সত্যিই তো ও নির্দোষ। সুন্দর তখন যোগ করেন, এই যে বলা হচ্ছে গোয়েন্দাদমন শাখা থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল ম্যাচ গড়াপেটা হচ্ছে এটা পুরোটা ঠিক নয়। তার পর আমি যখন ওদের কাছে প্রমাণ চাই, ওরা প্রমাণ দিতে পারেনি। ওরাই ব্যাপারটা চেপে যায়, আমি চেপে যাইনি।

শোনার পর বোর্ড সদস্যরা বলেন, সুন্দরকে বেকার মিডিয়া ব্যতিব্যস্ত করছে। ওর কোনও দোষই নেই।

পনেরো মিনিটের কাছাকাছি নিজের রক্ষণে ব্যয় করে শ্রীনি এ বার চলে যান পাল্টা আক্রমণে। সভায় প্রস্তাব পেশ হয়, দিলীপ বেঙ্গসরকরকে এ বার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দেওয়া হোক। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, গত পাঁচ-সাত বছর শ্রীনিদের মানচিত্রেই বেঙ্গসরকর ছিলেন না। বরং নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে খুব সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার পরেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে জীবনকৃতি পুরস্কার প্রাপক হিসেবে মনোনীত করার মাধ্যমে অনেকেই অভিসন্ধি খুঁজে পাচ্ছেন। তা হল, মুম্বইয়ে শরদ পওয়ারের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখা। যাকে বোর্ড মদত দেবে।

সভার আগে কোনও কোনও সদস্যকে শ্রীনি উত্তেজিত ভাবে বলেন যে, আদিত্য বর্মা লোকটা কোথা থেকে মামলার খরচ তুলছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া উচিত। সদস্যরা কেউ কেউ বলেন, পওয়ার-বিন্দ্রা-মনোহরের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিশেষত বিন্দ্রা যে ভাবে বোর্ড বিরোধী টুইট করে যাচ্ছেন, তাঁকে অবিলম্বে বহিষ্কার করা উচিত। সভার একেবারে শেষ দিকে এসে লাস্ট বলে জয়সূচক ছক্কা মারার মতো শ্রীনি বলেন, গত কয়েক বছরে আইনি খাতে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। বোর্ডের এই টাকাটা বিদর্ভকে দেওয়া অনুদান থেকে কেটে নিতে হবে! সবচেয়ে বেশি ঝামেলা ওরাই পাকিয়েছে। শুনে অনেকে স্তম্ভিত হয়ে যান। এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব, ভারতীয় ক্রিকেটের মাপেও বিরল। কিন্তু সবাই রাজি হয়ে যান। পরের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এই প্রস্তাব পাশ করাতে মনে হয় না কোনও সমস্যা হবে।

বোর্ডের দরবারে শ্রীনি তাই শুধু মুকুট অক্ষতই রাখলেন না। প্রবল আক্রমণাত্মক ভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। দুপুরের দিকে শোনা যাচ্ছিল, বিজেপি শ্রীনিকে না-ও সমর্থন করতে পারে। কারণ আমজনতায় তিনি এমন দুর্নীতির মুখ হিসেবে হাজির হয়েছেন যে, তাঁকে সমর্থন করলে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতি হতে পারে। তখন শোনা যাচ্ছিল জেটলির বিকল্প পছন্দ হতে পারেন জগমোহন ডালমিয়া। শরদ পওয়ার কিছুতেই নন। ডালমিয়াকে এই সময় কিছু সংস্থা জানিয়েও দেয় যে, তেমন হলে তারা সমর্থন করতে তৈরি। কিন্তু বৈঠকে সে দিকে এক সেন্টিমিটার সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি। এক বারও মনে হয়নি জেটলি বা তাঁর পার্টি শ্রীনির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছেন বলে।

শ্রীনিই কি তা হলে ভারতীয় ক্রিকেটের ফের ভাগ্যবিধাতা হতে যাচ্ছেন? বিরোধী শিবির একমত নয়। মঙ্গলবার চেন্নাইয়ের ম্যাচ হারকে তারা বড় করে দেখছে না। তারা মনে করে, সর্বোচ্চ আদালত এত সহজে শ্রীনিকে নিষ্কৃতি দেবে না। তাদের মতে, মুদগলের রিপোর্টের যেটুকু বেরিয়েছে সেটা নিতান্তই সামান্য। অনেক প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত, যেগুলো আদালতে ধীরে ধীরে উঠবে। মুদগল কমিটিতে যাঁর পারফরম্যান্স সবচেয়ে তারকাসুলভ সেই বি বি মিশ্রের রিপোর্ট এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তাঁদের ধারণা, মিশ্রর রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে শ্রীনি ব্যাপক অস্বস্তিতে পড়বেন তাঁর প্রিয় ক্রিকেটার ও আইপিএল সিইওকে নিয়ে। যা প্রমাণতথ্যাদি আছে, সিএসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। এদের মতে, শ্রীনিকে বোর্ড প্রধান হিসেবে বহাল রেখে নিশ্চয়ই সিএসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বোর্ড বলবে না। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখবেই। বিপক্ষের আইনজীবী হরিশ সালভে শ্রীনির স্নেহধন্য ক্রিকেট তারকাদের নিষ্কৃতি দেবেন না। আজ না হোক কাল, এঁদের নাম আদালতে বেরোবেই। তখন মিডিয়া কী বলবে? আদালত কী বলবে?

এ দিনের চেন্নাই বৈঠক নিরঙ্কুশ জিতেও তাই শ্রীনিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে সোমবারের সুপ্রিম কোর্টের দিকে। সে দিনটা যদি তিনি নির্বাচনে দাঁড়ানোর ছাড়পত্র জোগাড় করে নিতে পারেন, তা হলে খেলা এক রকম শেষ। যদি না পারেন বোর্ড সদস্যদের বরমাল্য আদালতের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় শুকিয়ে যেতে পারে!

শ্রীনি চুপ কেন, প্রশ্ন গাওস্করের

গুরুনাথ মইয়াপ্পনের কড়া সমালোচনা করে সুনীল গাওস্কর প্রশ্ন তুলে দিলেন, স্পট-ফিক্সিং নিয়ে শ্রীনিবাসন চুপ কেন? “কড়া শাস্তি পাওয়া উচিত মইয়াপ্পনের। আর এক জন প্লেয়ার দোষী জেনেও শ্রীনি কেন কিছু করেননি, তার উত্তর দেওয়া উচিত ওঁর,” এ দিন বলেন গাওস্কর।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE