আদিত্য বর্মা বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতকে যখন ফোনটা করেছিলেন, তখন তাঁকে বলা হয় সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সময় পকেটে হলুদ কাপড় জাতীয় কিছু নিয়ে ঢুকতে। গত সোমবার যেমন বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিবকে বলা হয়েছিল পকেটে লাল কিছু একটা যেন থাকে। আদিত্য এ দিন অনেক ভেবেছিলেন সাই বাবার প্রসাদী একটা ফুল নিয়ে যান। যার রংটা হলুদ ছিল।
নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন সকাল সাড়ে দশটায় চেন্নাইয়ের কোনও মন্দিরে গিয়েছিলেন কি না, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। শোনা গেল শুনানির সময় চেন্নাইয়ে নিজের বাসভবনেই ছিলেন। পরে সব শুনে অফিস চলে যান। আর প্রসাদী ফুলের জোরেই হোক বা হরিশ সালভে-নলিনী চিদম্বরমদের প্রখর আইনবোধ আদিত্য বর্মা বাজি প্রায় মেরে দিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার! চূড়ান্ত রায় না দিলেও বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট তো পরিষ্কার বলে দিল, মুদগল কমিশনের রিপোর্টে নাম আছে এমন কোনও ব্যক্তিকে তারা বোর্ড প্রেসিডেন্ট দেখতে চায় না। বরং দেশের সর্বোচ্চ আদালত চায়, বোর্ড নির্বচন হোক নির্ধারিত সময়ে, এবং গঠিত হোক নতুন ভারতীয় বোর্ড যেখানে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নামাঙ্কিত কেউ থাকবেন না!
সুপ্রিম কোর্টের শ্রীনির প্রতি কঠোর মনোভাব দেখেশুনে ভারতীয় ক্রিকেটমহলে যে বিভিন্ন জল্পনাগুলো ছড়াল তার একটা হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিচ্ছে না কারণ, তারা চাইছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে একটা অন্তিম সুযোগ দিতে। চাইছে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতীয় বোর্ড নিজেরা অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিক। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, আগামী সোমবার আদালতে পরবর্তী শুনানির দিন শ্রীনি একটা আবেদন পেশ করতে পারেন। তিনি নাকি বলতে পারেন যে, আমি সিএসকে ছেড়ে দেব। বাকি কিছুর সঙ্গেও কোনও সম্পর্ক রাখব না। শুধু আমাকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার অনুমতি দেওয়া হোক। শ্রীনি শিবির— যাদের মুদগল কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর উল্লসিত দেখাচ্ছিল, পরিস্থিতির অভাবনীয় পটবদলে চরম হতাশাবিদ্ধ হলেও চূড়ান্ত পরাজয় এখনও মানছে না। বরং ক্ষীণ হলেও একটা আশা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, এখনও তো রায় বেরোয়নি। অতীতে তো সুপ্রিম কোর্ট কম হেনস্থা করেনি শ্রীনিকে। কিন্তু শেষে ‘স্যর’ তো ঠিকই ফিরে এসেছেন। বিচারপতিদের মনোভাব আর রায় এক জিনিস নয়। তাতে তফাত থাকে।
এবং আদালত-কক্ষে যদি এ দিন শ্রীনি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে থাকেন, তা হলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি— তিনিও বিদ্ধ হলেন। বৃহস্পতিবারই সর্বপ্রথম ধোনি নিয়ে মুখ খুলল আদালত। বলে দিল, জাতীয় দল ও সিএসকে-তে ধোনির ‘দ্বৈত ভূমিকা’ নিয়ে আদালত প্রবল চিন্তিত। বিচারপতিরা বোর্ড আইনজীবীকেই প্রশ্ন করেন, মিস্টার মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি ভারত অধিনায়ক। আবার সিএসকে অধিনায়ক। কে তাঁকে সিএসকে ক্যাপ্টেন বাছল? কেন গত আট বছর ধরে তাঁকে নিলামে তোলা হয়নি? শুধু তাই নয়, সিএসকের মালিকানা নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র হাজির করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। নির্দেশ দিয়েছে, ইন্ডিয়া সিমেন্টস যে চারশো কোটি দিয়ে সিএসকে কিনেছে, তার অনুমোদন কে করেছে প্রকাশ্য করতে। সব শেষে বোর্ড আইনজীবীকে বিচারপতিরা প্রশ্ন করেছে, “সিএসকে নিয়ে এত স্বার্থের সংঘাত পাওয়া যাচ্ছে যেখানে, তখন সিএসকে-কে কেন আইপিএল থেকে নির্বাসনে পাঠানো হবে না বলুন? কেন বোর্ড নিজেদের আইন মেনে সিএসকে-কে বহিষ্কার করছে না?” বিচারপতি ঠাকুর আরও আক্রমণাত্মক ভাবে জিজ্ঞেস করেন, “শ্রীনিবাসনের কাছে কোনটা বেশি প্রিয়? বোর্ডের চেয়ার, নাকি টিম?”
ক্রিকেটমহলের কেউ কেউ অবাকই হয়ে গিয়েছেন আদালতের শ্রীনি নিয়ে এ দিনের কঠিন মনোভাব দেখে। আদিত্য বর্মাকে আবার দেখা গেল, প্রহর গুনছেন। শ্রীনি-পতনের প্রহর। রাতের দিকে বিভিন্ন টিভি শোয়ে যাওয়ার ফাঁকে বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, “অর্ডার যা-ই হোক, ক্রিকেটের স্বার্থ দেখে হবে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ ক্রিকেট হবে, দেখে নেবেন। আর সেটা হতে হলে কী হওয়ার দরকার, সবাই জানে।” আর তাঁর থেকে এ দিনের আদালত-কক্ষের আবহের যা নির্যাস পাওয়া গেল, তার পাশে একটাই শব্দ বসে— রক্তক্ষয়ী। বিহার সংস্থার পক্ষে যদি নলিনী চিদম্বরম, হরিশ সালভের মতো দুঁদে আইনজীবীরা নেমে থাকেন, তা হলে বোর্ডের তরফেও কম কিছু ছিল না। সেখানেও কপিল সিব্বল, জেঠমালানির মতো রাশভারী নাম ছিল। শোনা গেল, গণ্ডগোলটা নাকি করেন বোর্ড আইনজীবী। আদালতের কাছে আবেদন করা হয় যে, বোর্ডের নিজস্ব একটা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি আছে। মুদগল রিপোর্টের যাবতীয় নাম সেই কমিটিকে দেওয়া হোক। তারা ব্যবস্থা নেবে। যা শুনে নাকি রীতিমতো ফুঁসে ওঠে বিচারপতি ঠাকুর এবং খলিফুল্লাহ-র ডিভিশন বেঞ্চ। পাল্টা তাঁরা বলে ওঠেন— “সিদ্ধান্তটা কোন বোর্ডের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি নেবে? যার প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসন? আরে, আপনাদের বর্তমান প্রশাসনিক পরিকাঠামোটাই তো বেআইনি! আপনারা নির্বাচনটই এখনও করেননি। যান, আগে নির্বাচন করুন। ১৭ ডিসেম্বরই সেটা করুন। নতুন বোর্ড তৈরি করুন। তার পর নাম-টাম আপনাদের দেওয়ার প্রশ্ন। আর এটাও জেনে রাখুন, মুদগল কমিশনের রিপোর্টে যাদের নাম আছে, তাদের বাদ দিয়ে কিন্তু নির্বাচন করতে হবে!”
অর্থাত্— নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে বাদ দিয়ে নির্বাচনটা করতে হবে!
আর সেটা যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়, তা হলে দু’টো নাম পাওয়া যাচ্ছে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে। জগমোহন ডালমিয়া এবং শরদ পওয়ার। যাঁদের মধ্যে সিএবি সুপ্রিমো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এ দিন শুনানির পর থেকে প্রচুর ফোনও পেয়েছেন ডালমিয়া। আর পরিস্থিতিও যে দিকে যাচ্ছে, তাতে ডালমিয়ার দিকে পাল্লা বেশি ভারী। কোনও কোনও বোর্ডকর্তার মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীনি-পওয়ার যদি শূন্য হন, তা হলে ডালমিয়া ডাবল ফিগারে ব্যাট করছেন।
সিএবি— তারা এই অবস্থায় কী ভাবছে? তারা বলে দিচ্ছে, ডালমিয়া যদি এই ডামাডোলের মধ্যে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে যান, তার চেয়ে সুখের কিছু নেই। সিএবি-র তা হলে সবচেয়ে ভাল। সবচেয়ে বেশি লাভ। আবার শ্রীনি— অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তনে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের আকাশে ফের আবির্ভূত হন, তা হলেও সিএবি-র ক্ষতি নেই। তিনিও বাংলা ক্রিকেটকে দেখবেন।
বাংলা ক্রিকেটের তখন যে কোনও দিকেই লাভ। তা প্রেসিডেন্ট যিনিই হন, শ্রীনি কিংবা ডালমিয়া।
সুপ্রিম কোর্ট কী বলল
• যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচন করে বিসিসিআই-এর নতুন বোর্ড গঠন করা উচিত।
মুদগল কমিটির রিপোর্টে যাদের নাম আছে, তারা এই নির্বাচন থেকে দূরে সরে থাকুক।
• আর কোনও তদন্ত না করেই চেন্নাই সুপার কিংসকে আইপিএল থেকে বার করে দেওয়া উচিত।
• কেন নিয়ম মেনে সিএসকে-কে বার করেনি বোর্ড? প্রশ্ন আদালতের।
• সিএসকে-র প্রকৃত মালিক কারা? চারশো কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমতিই বা তা পেল কী করে? প্রশ্ন আদালতের।
• সিএসকে-র মালিকানা ও বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট পদের মধ্যে একটা শ্রীনিবাসনের ছেড়ে দেওয়া উচিত।
• ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক হয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবে টুর্নামেন্ট চালানো সম্ভব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy