আদিলের সঙ্গে সাকলিন।
চেহারাটা একটু নয়, বেশ পাল্টেছে। অতীতের সেই ছিপছিপে ছেলেটা আর নেই, শরীরে আজ বড় মেদের আধিক্য। তার উপর গালে অতিকায় দাড়ি। বয়সও কম হল না। ডিসেম্বরে চল্লিশ হবে।
সাকলিন মুস্তাককে দেখলে এখন আর চেনাই যায় না। দেখলে কে বিশ্বাস করবে, সেই চেনা সাকলিন আর ইনি, একই লোক? কে বলবে, ক্রিকেট-পৃথিবীতে ‘দুসরা’ নামক এক ভয়াবহতার জন্ম দিয়েছেন ইনিই!
সাকলিন মুস্তাকের শুধু একটা জিনিস আজও চেনা যায়। তাঁর বলটা। কব্জির হালকা মোচড়ে ছিটকে বেরনো মৃত্যুদূত তো বদলালো না। চল্লিশ বাকি সব পেরেছে পাল্টে দিতে, শুধু ওটা পারেনি।
জো রুট ভাল ঝামেলায় পড়েছিলেন। সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে অফস্পিনার হিসেবে তাঁকে টিমে ঢুকতে হয়েছিল। তার পর থেকে ইংরেজ ব্যাটিং-মহীরূহকে স্পিনারের পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরতে হয়েছে বলে বড় একটা শোনা যায় না। কিন্তু পাঁচ টেস্টের ভারত সফর তো, পিচ আলাদা, পারিপার্শ্বিকের চাহিদাও আলাদা। এবং রুটকেও স্পিনের ক্লাসে যথেষ্ট মনোযোগী ছাত্র হিসেবে ফের নাম লেখাতে হয়েছে। তবে মঙ্গলবার দুপুরে সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট গ্রাউন্ড প্র্যাকটিস নেটে ইংরেজ ব্যাটসম্যান যেটা বারবার তোলার চেষ্টা করছিলেন এবং খুঁতখুঁতে সাকলিন তাঁকে শুধরোচ্ছিলেন, তা মোটেও নিরীহ অফস্পিন নয়। গ্রিপটা দেখে যা মনে হল, এটা সারফেসে পড়ে ব্যাটসম্যানের ভেতরে ঢুকবে না। বাইরে বেরিয়ে যাবে।
দুসরা!
উপরেরটা স্রেফ একটা উদাহরণ মাত্র। ভাল করে খুঁজলে, এ রকম একটা নয়, একাধিক পাওয়া যাবে মঙ্গলবারের রাজকোটে। আদিল রশিদকে নিয়ে আলাদা সেশন, নিজে বল হাতে নেমে পড়া কোনটা নেই? আসলে বুধবার থেকে কোনও মইন আলি নন। আদিল রশিদ বা গ্যারেথ ব্যাটিও নন। ভারতের একমাত্র স্পিন-প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কেউ যদি আর্বিভূত হন, তো তা হলে ইনি— সাকলিন মুস্তাক। যাঁকে ভারত সফরের জন্য দিন পনেরোর ক্র্যাশ কোর্সে আমদানি করেছে ইসিবি। আমদানি করেছে রবিচন্দ্রন অশ্বিন নামের এক অমোঘ ভারতীয় স্পিন-অস্ত্রকে ঘায়েল করতে।
তা, যুদ্ধটা কেমন হবে? সমানে-সমানে?
প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড ছেড়ে বেরনোর পথে প্রশ্নটা শুনে সাকলিন হেসে ফেললেন। “আরে, অশ্বিনের সঙ্গে আমি আবার লড়ব কী ভাবে? দেখছেন তো কত মোটা হয়ে গিয়েছি!” হাঁটতে হাঁটতে বলে দেন প্রাক্তন পাকিস্তান অফস্পিনার। কিন্তু লোকে তো বলছে। লোকে তো বলছে যে, সাকলিন মাঠে নামুন চাই না নামুন, অশ্বিনের সঙ্গে যুদ্ধটা তাঁরই হবে। শুনে এ বার যেন মৃদু বিব্রত হয়ে যান ইংল্যান্ডের স্পিনিং কোচ। দ্রুত বলে ওঠেন, “না, না। প্রথমেই বলি যে, অশ্বিন দুর্দান্ত স্পিনার। ওয়ার্ল্ড ক্লাস। ও ভাবে ধরে নিলেই তো হল না। যে কোনও পিচে ও ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবে। আর আমি বনাম অশ্বিন জিজ্ঞেস করলে বলব, আমি তো মাঠের বাইরে থাকছি। তা হলে আর যুদ্ধ কীসের?”
কিন্তু ভারতীয় পিচে অশ্বিন সামলানোর টোটকা সেটা দেবেন তো? জো রুট, জনি বেয়ারস্টোদের বলবেন না প্রেসক্রিপশনটা কী হবে? “সেটা কেউ ভাঙবে? অশ্বিন-জাডেজা খেলার টোটকা কেউ বলবে না। আর এই প্রশ্নটা বোধহয় আমাকে জিজ্ঞেস না করে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের কাছেই জানতে চাওয়া সবচেয়ে ভাল ছিল। যাই হোক, ভারত ভারতের মতো স্ট্র্যাটেজি করবে। আমরা আমাদের মতো করেছি। দেখা যাক এ বার,” বলে দেন সাকলিন। একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, “আর একটা কথা। বাংলাদেশ সফরে ইংল্যান্ডের হেরে যাওয়া নিয়ে এত কথা হচ্ছে। কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে, এটাও শেখার একটা প্রসেস। একটা হারা টেস্ট ম্যাচ থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। তাই ওই একটা টেস্টে ইংল্যান্ড হেরেছে বলে সব শেষ, বলা যাবে না।”
সাকলিন বলছেন। কিন্তু মুশকিল হল, ভারত সফররত বিলেতের মিডিয়াকুল তাঁর আমদানিতে যে বিশেষ প্রভাবিত, কথা শুনলে মনে হবে না। এঁদের মতবাদে, স্পিন খেলাটা শিখতে হয় একেবারে ছোটবেলা থেকে। দিন পনেরোর জন্য কোনও এক সাকলিন মুস্তাক এনে বিরাট ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। গত ভারত সফর এঁদের মনে করিয়ে দিলে চটজলদি জবাব আসে, সেটা জিতিয়েছিলেন অ্যালিস্টার কুক আর কেভিন পিটারসেন। কেপি আর নেই। আর কুক? খেলবেন কী, তিনি তো ক্যাপ্টেন্সি নিয়েই তীব্র বিতর্কে ডুবে!
ঘটনা। এ দিনই ইংল্যান্ডের এক কাগজ ক্যাপ্টেন কুকের এক সাক্ষাত্কার চালিয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন যে, ভারত সফরই শেষ। তার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন। যা নিয়ে প্রায় তোলপাড় পড়ে যায় মঙ্গলবারের রাজকোটে। ইংল্যান্ড অধিনায়ককে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে জবাবদিহিও করতে হয়। কুককে বলতে হয়, “কেউ যদি আপনাকে প্রশ্ন করে কত দিন আর ক্যাপ্টেন থাকবেন, নিশ্চিত করে কি সেটা বলা যায়? আমি তো উপরমহলকে বলেছি যে, সিরিজ ধরে ধরে বিচার করা হোক। সেটা দু’মাস হতে পারে, ছ’মাস হতে পারে, এক বছরও হতে পারে। আপাতত এই সিরিজে মন দিচ্ছি।”
কোথাও নিঃশর্ত মেনে নেওয়া নেই। আবার পত্রপাঠ উড়িয়ে দেওয়া, তা-ও নেই। কপাল চলছে বটে কুকের। বাংলাদেশ-বিপর্যয়ের পর একে তো দেশের মিডিয়া বলাবলি করছে যে, হার আসবে জানা কথা, কিন্তু তা অন্তত সম্মানজনক হোক। তার মধ্যে অশ্বিন নিয়ে ক্রমাগত খোঁচাখুঁচি, কুকের নিজেকে নিয়ে বিতর্কের বাতাবরণ। গ্যারি ব্যালান্স— যাঁকে নিয়ে এত ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের লেখালেখি, তাঁর পরিবর্ত নিয়েও প্রচুর খুঁটিনাটির উত্তর দিতে হল ইংল্যান্ড অধিনায়ককে। বলতে হল, যিনি আসছেন, তাঁর স্পিন খেলার টেকনিক খুব ভাল। স্টুয়ার্ট ব্রড গত ইংলিশ সামারে তাঁকে বল করে নাকি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, সোজা ফোন করে বসেন কুককে! রান করা নাকি ধর্ম এ ছেলের, তা অভিষেককারীর বয়স যতই উনিশ হোক না কেন!
ঠিকই পড়লেন। নাম, হাসিব হামিদ। বয়স, উনিশ। ভারতীয় বংশভূত। এবং বুধবার থেকে সাকলিনের চেয়েও সম্ভবত ইংল্যান্ডের অধিক ভরসার ‘দুসরা’!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy