উপলক্ষ বই প্রকাশ। সেখানেই নিখাদ আড্ডা রাহুল, সৌরভ, আর লক্ষ্মণের সঙ্গে।
অনুষ্ঠানের অ্যাঙ্কর ঠিকই বলছিলেন, অবিকল রাজশ্রী প্রোডাকশনের ছবি! চার পাশে জৌলুসের মধ্যেও খুব মানবিক। আর সবার মুখে হাসি অক্ষত রেখে হ্যাপি এন্ডিং। আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল শুধু নয়। তার পর থাকে, অ্যান্ড দেন দে লিভ্ড হ্যাপিলি এভার আফটার। তাহারা অতঃপর সুখেই কালাতিপাত করিতে লাগিল!
গত বছর ১৬ নভেম্বরের ওয়াংখেড়ে যদি সচিন তেন্ডুলকরের ট্র্যাজিক বিদায়গাথা হয়। এ বছর নভেম্বরের প্রথম বুধবার হয়ে দাঁড়াল তাঁর হাসিখুশি ভরা ফেয়ারওয়েল পার্টি। নামেই তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী প্রকাশ। গোটা অনুষ্ঠানের তাত্পর্য ছিল সুদূরপ্রসারিত। বিশেষ করে গ্রেগরি স্টিভন চ্যাপেল নামক বিদেশিকে নিয়ে গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ক্রিকেট-বিশ্ব ব্যাপী উত্তেজনার পর!
এক-এক সময় মনে হচ্ছিল বিয়ের আগে যেমন সঙ্গীত হয়, তেমনই প্রাণখোলা ডকুমেন্টারি তোলা হচ্ছে বুঝি সচিনের। পরিবারের সবাই দারুণ মেজাজে। সব বক্তাই এত হাসাচ্ছেন, যেন টেলিভিশনে লাফটার চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অঞ্জলি তেন্ডুলকর যেমন মঞ্চে উঠে স্বামী নিয়ে এই প্রথম বললেন, “সচিন আমাকে প্রায়ই ঠাট্টা করে বলে মাঠে কোনও দিন বিপক্ষের ফাস্ট বোলার আর গ্যালারিতে থাকা কালো কালো মাথার সামনে ব্যাট করেছ? আজ এখানে এত লোকের সামনে আমার ঠিক সেই অনুভূতিটাই হচ্ছে।” এর পর অঞ্জলি বলতে শুরু করলেন প্রেম হওয়ার পর তাদের প্রধান সমস্যা ছিল কোথায় দেখা করবেন? “সচিন বুদ্ধি দিল, তুমি সাংবাদিক সেজে বাড়িতে এসো। যেন আমাকে ইন্টারভিউ করতে এসেছ। সেটাই গেলাম। এমনকী আমরা যে বিয়ে করব, সেটাও ওর বাবা-মাকে বলার জন্য সচিন আমাকে ওর বাড়িতে পাঠাল। নিজে তখন নিউজিল্যান্ডে খেলছে।” সচিন পাশ থেকে বললেন, “আমার সাহসে কুলোয়নি বাড়িতে বলব। তাই ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।” শুনে প্রচণ্ড হাততালি।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও তুমুল হাসালেন। বললেন, “সেই এমআরএফ ক্যাম্প থেকে অনেক বার আমরা রুমমেট থেকেছি। রাত্তিরে উঠে হয় ও ঘুমের মধ্যে হাঁটে। নইলে শ্যাডো করে স্বপ্নের মধ্যে। রুমমেট ঘুমোবে কী করে?” সচিন বললেন, “বাজে কথা বলিস না। তুই একা ঘুমোতে ভয় পাস বলে আমাকে রুমমেট নিয়েছিলি।” এর পর সচিন জানালেন, সিডনিতে ২৪১-এর আগের দিন সারা রাত তিনি জেগে ছিলেন। রান পাচ্ছিলেন না বলে ছটফট করেছেন। শ্যাডো করেছেন প্রতিনিয়ত। “আমি ভেবেছিলাম দাদা ঘুমোচ্ছে। তার পর দেখি ও জাগা। কী আশ্চর্য!” সৌরভ পাশ থেকে বলেন, “আশ্চর্যের কিছু নেই। একটা লোক ঘরে ফুল লাইট জ্বালিয়ে রেখে আয়নার সামনে সারা রাত শ্যাডো করছে, রুমমেট ঘুমোবে কী করে? সাধ্য আছে?” সবাই আবার হেসে গড়িয়ে পড়ল।
কে বলবে যে, অনুষ্ঠানের দুটো গুরুগম্ভীর ফাঁড়া ছিল। একটা গ্রেগ চ্যাপেল জমানা নিয়ে আলোচনা। অন্যটা মুলতান ইনিংস ঘোষণা।
দুটোরই কেন্দ্রে রাহুল দ্রাবিড়। সবার চোখ ছিল এই রকম প্ররোচনামূলক পরিস্থিতি দ্রাবিড় কী করে সামলান, যেখানে বইয়ে এই দুটো পর্ব নিয়ে তাঁর পর্যাপ্ত সমালোচনা রয়েছে? স্পর্শকাতর এই বিষয়গুলো নিয়েই আজ আবার মঞ্চের ওপর খুলে-আম আলোচনা হচ্ছে। শতকরা নিরানব্বই ভাগ এই পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠান বর্জন করত। কিন্তু এই জন্যই দ্রাবিড়! শত প্ররোচনাতেও পরিস্থিতি অপ্রীতিকর দিকে গড়াতেই দিলেন না। অ্যাঙ্কর হর্ষ ভোগলে অনেক রাতের দিকে বলছিলেন, “রাহুল অনবদ্য। এই জন্যই ও লেজেন্ড।” মুলতানে ১৯৪ রানে সচিনকে ডেকে নেওয়াটা রাহুল হালকা করে দিলেন এই বলে যে, “আজ অবধি যত জন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে এই কাজটা কেন করতে গেলেন তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়া উত্তরের জন্য যদি এক টাকা করে চার্জ করতাম, তা হলে আজ আমি কোটিপতি।” টেনশনটা তখনই অনেকটা সরে গেল।
বইয়ের নাম ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’। গ্রেগ চ্যাপেলের নাম ওঠামাত্র অবশ্য ‘মাই ওয়ে’ নয়, আজকের মতো সচিনকে ডিফেন্স করতে হল। কারণ মঞ্চে রাহুলের সামনে বারবার অসুখী ড্রেসিংরুম আর ২০০৭ বিশ্বকাপ ব্যর্থতার কথা উঠছে। সচিন এই সময় রাহুলকে ‘জ্যাম’, তাঁর ডাকনামে ডাকতে শুরু করে দিলেন। যেটা হয়তো পুরনো ড্রেসিংরুমের ডাক ছিল। সৌরভও একটা কথাও গ্রেগ নিয়ে না বলে বরং রাহুলের ক্যাপ্টেন্সিতে যে ইংল্যান্ড সিরিজ বহু বছর পর জেতা গিয়েছিল তারই উল্লেখ করলেন। বোঝা গেল, বন্ধুরা চাইছেন রাহুলকে যথাসম্ভব অস্বস্তিমুক্ত রাখতে। টিম ইন্ডিয়ার সাবেকি স্পিরিটটাও যেন মঞ্চে উঠে এল।
কিন্তু গ্রেগ নিয়ে বাউন্সার আর বন্ধুদের মধ্যে তখনকার তিক্ততা এমন ডেলিভারি যে, রাহুলকে একা খেলতে হবে। আর গোটা ক্রিকেটমহল বসে এই শো দেখছে। বাংলাদেশ-সহ উপমহাদেশের অনেকে লাইভ দেখছে। অর্থাত্ যারা এখানে নেই, তারাও অবধারিত টিভির সামনে। রাহুল বললেন, “টানা ষোলো বছর আমি আর সচিন একসঙ্গে খেলেছি। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দু’জনই দেশকে জেতাতে চেষ্টা করছি এই অবস্থায় এক-আধ বার পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। আমাদেরও হয়েছে। কিন্তু পেছনে ফিরলে সুখের মুহূর্ত অনেক বেশি। আমি সেগুলো মনে রাখতে চাই। মুলতানের বিতর্ক নয়, আমি মনে রেখেছি সচিন যখন শেষ পাকিস্তান উইকেটটা নিল আর আমরা প্রথম পাকিস্তানের মাঠে টেস্ট জিতে ফিরছি, সেই সুখের মুহূর্তটা। ২০০৭-এও তেমন কিছু ভাল মুহূর্ত ছিল।” সবাই প্রচণ্ড হাততালি দিল।
তেন্ডুলকর নামক ব্র্যান্ডের এমনই মাধ্যাকর্ষণ যে, যাঁকে যাঁকে তিনি ডেকেছেন, সবাই হাজির। আটকে গিয়েছেন শুধু দুই প্রিয় শিষ্য সহবাগ আর যুবরাজ। আসতে পারেননি যাঁকে তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে গ্রেটেস্ট ম্যাচ উইনার বলেছেন, সেই অনিল কুম্বলে। কিন্তু বাকি যাঁদের যাঁদের ডেকেছেন, সবাই হাজির। বিরাট কোহলিও খুব প্রিয় সচিনের। কিন্তু তাঁর তো বৃহস্পতিবার আমদাবাদে ম্যাচ। কাজেই এসেছেন কারা দেখার চেয়ে খোঁজা সহজ কে কে আসেননি? বা কাকে কাকে ডাকাই হয়নি?
মহম্মদ আজহারউদ্দিন।
বিনোদ কাম্বলি।
সঞ্জয় মঞ্জরেকর।
কপিল দেব।
এমএস ধোনি।
এন শ্রীনিবাসন।
কপিল সম্পর্কে সচিন বইয়েই অভিযোগ করেছেন যে, তিনি ক্যাপ্টেন থাকাকালীন কোচ হিসেবে কপিল তাঁকে কোনও সাহায্যই করতে পারেননি। কপিল গুড বুকে নেই বোঝা গেল। কিন্তু এমএস ধোনি এই একটা বছরে এতটা পর হয়ে গেলেন কী করে? না কি শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে ধোনির ব্যবহার আজও ভোলেননি সচিন?
প্রায় দেড় ঘণ্টারও বেশি অনুষ্ঠান চলল। এক বারও ভারতের বর্তমান এবং সফলতম অধিনায়কের নাম উচ্চারণ হল না। সচিন এত কথা বললেন আগের বিশ্বকাপ জেতা নিয়ে অথচ ধোনি নামটাই কিনা তাঁর মুখে শোনা গেল না, যে ধোনিকে ক্যাপ্টেন করার পেছনে যুগ্ম ভাবে ছিলেন তিনি আর গ্রেগ চ্যাপেল। কোনও কোনও মহলে জল্পনা শুরু হয়ে গেল, ধোনি কি সচিনকে তাঁর পরিকল্পিত দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগেই অবসর নিতে বাধ্য করেছিলেন? না কি ওয়ান ডে থেকে তাঁর বিদায় ত্বরান্বিত করার পেছনে?
সচিন-অবসরের এক বছর বাদে খোদ মুম্বই মুলুকে এই ধাঁধাটা যেন আরও গেঁড়ে বসল। অনুষ্ঠানে দিলীপ বেঙ্গসরকরকে দেখে মনে পড়ল তিনি আর মঞ্জরেকর এক কালে সচিনের নামকরণ করেছিলেন ‘এনসি’। নন-কমিটাল। কোনও ব্যাপারেই কেউ চটতে পারে এমন মন্তব্যহীন প্রবণতার জন্য।
আত্মজীবনী প্রকাশমাত্র সচিন সেই নামটা অপ্রাসঙ্গিক করে দিলেন। মোটেও তিনি আর ‘এনসি’ নন। চ্যাপেল ভাইরা ছাড়াও বইয়ে আক্রমণ করেছেন দ্রাবিড়, কপিল, পন্টিং, গিলক্রিস্ট, মাইক প্রোক্টর, আম্পায়ার স্টিভ বাক্নর, ধোনি-সহ এত জনকে যে, শত্রু-সংখ্যা ডাবল ডিজিটে পৌঁছতে বাধ্য।
সবাই জানে ক্রিকেট থেকে রূপকথার অবসর নিয়েছেন সচিন। অথচ বুধবার এমন সুখের মেহফিলও সন্দেহ রেখে গেল, ভারতের সবচেয়ে বরেণ্য ব্যাট অবসরে চলে যেতে বাধ্য হওয়া নিয়ে আজ এক বছর পরেও তাঁর মনে একরাশ তিক্ততা অবশিষ্ট থেকে গেছে কি না?
হায়, উত্তরটা তো বইয়ে নেই!
ছবি: সাত্যকি ঘোষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy