পালাবদল: যাচ্ছেন শাস্ত্রী। নতুন কোচ হয়ে আসছেন দ্রাবিড়। ফাইল চিত্র।
সাত বছর ধরে বিরাট কোহালিদের গুরু তিনি। বিশ্বের খেলাধুলোর ইতিহাসে কোচ হিসেবে দীর্ঘতম মেয়াদ কাটানো কোচেদের এক জন। রবি সসম্মানে অস্ত যাচ্ছেন। দ্রাবিড় সভ্যতার আগমন ঘটছে। রবিশঙ্কর জয়দ্রিথ শাস্ত্রী বিদায়বেলায় স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁর উত্তরসূরিকে।
রবিবার দুবাই থেকে ফোনে ভারতীয় দলের বিদায়ী হেড কোচ আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বললেন, ‘‘আমি শুনছি, রাহুল দ্রাবিড় পরবর্তী কোচ হয়ে আসছে। রাহুলের চেয়ে ভাল পছন্দ আর কেউ হতে পারে না।’’ এক নিঃশ্বাসে যোগ করছেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেটে ওর অবদানের কথা ভাবলে শুধুই টুপি খুলে শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছা করে। কোচ হিসেবেও জুনিয়রদের নিয়ে দারুণ কাজ করেছে। আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই যে, ভারতীয় ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাহুল দ্রাবিড়ই হচ্ছে যোগ্যতম লোক।’’
সাত বছর ধরে ভারতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব সামলানোর পরে সরে যাচ্ছেন শাস্ত্রী। মাঝে এক বছর তাঁর জায়গায় কোচ হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। কিন্তু প্রাক্তন লেগস্পিনারের সঙ্গে অধিনায়ক বিরাট কোহালির বনিবনা না হওয়ায় সেই মধুচন্দ্রিমা টেকেনি। ২০১৭-তে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে হারের পরে কুম্বলে পদত্যাগ করেন। হেড কোচ হিসেবে ফিরে আসেন শাস্ত্রী।
কোচ হিসেবে এই দীর্ঘ সফরে ভারতীয় যুব ক্রিকেটের দায়িত্বে থাকা দ্রাবিড়ের সঙ্গে বেশ কয়েক বার তাঁর কথাবার্তা হয়েছে। বিশেষ করে নতুন মুখ কারা উঠে আসছেন, তা নিয়ে দ্রাবিড়ের পরামর্শের উপরে জোর দেওয়ার কথা তিনি জাতীয় নির্বাচকদেরও বলেছিলেন। ‘‘আমি নিশ্চিত দেশ-বিদেশে সর্বত্র জয় করার যে স্বপ্ন আমরা সকলে মিলে দেখে এসেছি গত সাত বছর ধরে, সেই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে রাহুল,’’ অনুজ উত্তরসূরির প্রতি অগাধ আস্থা এবং সম্মান প্রদর্শন অগ্রজের।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই কোচ হিসেবে বিদায়ী প্রতিযোগিতা শাস্ত্রীর। তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ২০১৪ সালের সেই ইংল্যান্ড সফরে, একের পর এক বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত দল। মনোবল বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। অ্যান্ডারসনের সামনে দুঃস্বপ্নের সিরিজ় যাচ্ছে কোহালির। কোচ তখন ডানকান ফ্লেচার। টিম ডিরেক্টর হিসেবে নিয়ে আসা হয় শাস্ত্রীকে। প্রথমেই তিনি দলের উদ্দেশে ‘পেপ টক’ দেন। ধোনি, কোহালিদের বলেন, ‘‘কিছুই হারাওনি তোমরা। চলো, উঠে দাঁড়াও। নিজেদের উপরে বিশ্বাস রেখে চলো।
তোমরা পারবে।’’
দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে ইংল্যান্ডে ওয়ান ডে সিরিজ় জিতে নেয় দল। এর পরে অস্ট্রেলিয়ায় ০-২ টেস্টে আগ্রাসী ক্রিকেটের আতসবাজিতে সকলকে চমকে দেয় তারা। মিচেল জনসনদের পাল্টা আক্রমণ করে চারটি সেঞ্চুরি করেন কোহালি। হেরে গেলেও ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র নয়, জেতার জন্য খেলে ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয় জিতে নেন কোহালি, রাহানেরা। শাস্ত্রী তখনই বলেছিলেন, ‘‘আজ আমরা জিততে পারলাম না ঠিকই কিন্তু এই আগুনে মানসিকতাটাই তফাত গড়ে দেবে। এই টিম খুব শীঘ্রই বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়াবে।’’
এখনও মানছেন, দেশ-বিদেশে সর্বত্র জেতার লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামার এই মানসিকতা তৈরি করতে পারাটাই কোচ হিসেবে তাঁর সেরা প্রাপ্তি। সেই সঙ্গে বোলিং কোচ বি অরুণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বুমরা, শামি, ইশান্ত, উমেশ, সিরাজদের নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস ব্যাটারি তৈরি করা। রেকর্ড লেখা হবে, মোছা হবে। কিন্তু এই যে ক্রিকেটের সব শক্তিশালী দেশ এখন সম্ভ্রম আর ভয়ের চোখে ভারতীয় দলকে দেখে, সেটাই গুরু শাস্ত্রীর সেরা অবদান। ‘‘অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে লোকে এসে আমাকে বলে গিয়েছে, ‘কী দুর্ধর্ষ মানসিকতা দলটার। আমাদের দেশে এসে আমাদের গলা চেপে ধরছে’। এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে!’’ বলেন তৃপ্ত শাস্ত্রী।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে গিয়ে শাসন করেও বিশ্বমানের আইসিসি ট্রফি জেতা হয়নি তাঁর। নিজে ক্রিকেটার হিসেবে যেখানে বিশ্বকাপ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেট জয়ী ঐতিহাসিক ভারতীয় দলের সদস্য। ‘চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স’ সেই বিখ্যাত আউডি গাড়ির মালিক নিশ্চয়ই চাইবেন, কোচ হিসেবে অন্তত একটা বিশ্বকাপ তাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে থাকুক। আমিরশাহিতেই শেষ সুযোগ।
যদিও ট্রফির চর্চা ছেড়ে দলীয় মন্ত্রের কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘‘আমরা ভাল ক্রিকেট খেলার দিকে মন দিচ্ছি। বরাবর যেমন দিয়েছি।’’ ফলের দিকে তাকিও না, প্রক্রিয়ার উপরে জোর দাও— শাস্ত্রীয় দর্শন। মনে করছেন, কোভিডের পৃথিবীতে জৈব সুরক্ষা বলয়ে আটকে থাকা ক্রিকেটারদের জীবন কঠিন করে দিয়ে যাচ্ছে। এখনই সাবধান না হলে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিশ্রাম দিয়ে খেলানোর নীতি না নিলে আগামী দিনে আরও অনেক বেন স্টোকস তৈরি হতে যাচ্ছে। নিজের উদাহরণ টেনে বললেন, ‘‘আমার মায়ের বয়স হয়েছে। কে দেখাশোনা করবে? মেয়ে বড় হচ্ছে। সময় দিতে পারি না। কোভিডের সময়ে কোচিং চালিয়ে যেতে চাইলে এখন আবার আট মাস বলয়ের মধ্যে আটকে থাকতে হবে। সিরিজ় শেষেও বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। এই বয়সে কী ভাবে সম্ভব!’’
বিদায়বেলায় কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে যেন বলে উঠলেন, ‘‘ব্যস, আর শেষ অধ্যায়টাই বাকি। প্রার্থনা, এটাই যেন ভাল ভাবে সব কিছু শেষ করতে পারি।’’ কিন্তু বরাবরের মতোই কোনও দীর্ঘশ্বাস, খেদ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নেই। ‘‘জীবন এগিয়ে যাবে,’’ কথা শেষ করেন শাস্ত্রী। বিশ্বকাপ অভিযানের মহড়া শুরু হচ্ছে। মরুদেশে প্রথম প্র্যাক্টিস সেশনে বেরোবেন দল নিয়ে। সাত বছরের দৌড়ের শেষ পাক বাকি রয়েছে যে! আর কথাতেই আছে না, শেষ ভাল যার সব ভাল তার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy