Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

হার না মানা এক নিত্যযাত্রী তারকা

ওয়ান ডে টিমের যোগ্য বলে তিনি বিবেচিত হন না। পূজারা শুধুই টেস্ট খেলেন। তাই চার মাস পরে যখন পাহাড়ি ধর্মশালা থেকে সমুদ্রে ঘেরা গলে টেস্ট ক্রিকেট ফিরল, পূজারাও আবার উদয় হলেন।

প্রত্যয়ী: নীরবে আরও এক টেস্ট সে়ঞ্চুরি পূজারার। ছবি: টুইটার

প্রত্যয়ী: নীরবে আরও এক টেস্ট সে়ঞ্চুরি পূজারার। ছবি: টুইটার

সুমিত ঘোষ
গল শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৭ ০৪:১০
Share: Save:

চেতেশ্বর পূজারাকে শেষ দেখা গিয়েছিল মার্চে। দেশের মাঠে উত্তপ্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজের শেষ টেস্টে ধর্মশালায়।

তার পর আইপিএল হয়েছে। পূজারাকে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনেই না, তো দেখার সুযোগ কোথায়? আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়ে গেল ইংল্যান্ডে। পূজারা সেই সময় ইংল্যান্ডে ছিলেন, কিন্তু কোহালির দলে ছিলেন না। কাউন্টি খেলছিলেন।

ওয়ান ডে টিমের যোগ্য বলে তিনি বিবেচিত হন না। পূজারা শুধুই টেস্ট খেলেন। তাই চার মাস পরে যখন পাহাড়ি ধর্মশালা থেকে সমুদ্রে ঘেরা গলে টেস্ট ক্রিকেট ফিরল, পূজারাও আবার উদয় হলেন।

ওহ্, বলা হয়নি। পূজারাকে কেউ বিজ্ঞাপনেও ডাকে না। গাড়ি, মোবাইল, ঘড়ি, পারফিউম, সাবান, টুথপেস্ট— কোনও কিছুতেই নয়। এমনকী, ভারতের কোনও অঞ্চল বা শহরে রাস্তার মোড়ের হোর্ডিংয়েও মুখ দেখানোর যোগ্য মনে করে না কোনও সংস্থা।

পূজারাকে যদি একান্তই দেখার ইচ্ছা হয়, অপেক্ষা করতে হবে— কবে টেস্ট ম্যাচ আসবে! তা-ও খুব বেশি মানুষ তাঁর এই টেস্ট ম্যাচ ব্যাটিং দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। গলেই যেমন তাঁর ১৫৩ রান এল ২৬৫ বলে। স্ট্রাইক রেট ৫৭.৭৩। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা ক্রিজে কাটিয়ে, বারো নম্বর টেস্ট সেঞ্চুরির পথে মারলেন মাত্র ১৩টি বাউন্ডারি। শিখর ধবনের ১৯০-এর ইনিংসে ছিল ৩১টি বাউন্ডারি। পরে হার্দিক পাণ্ড্য এসে ৪৯ বলে ৫০ করে গেলেন। পাঁচটা চার, তিনটি ছক্কা। ভরপুর টি-টোয়েন্টি জমানায় এ সব মারকাটারি খেলা দেখতেই দর্শকেরা মাঠে আসেন।

আরও পড়ুন: অবিনাশ-ইস্টবেঙ্গল কাজিয়া এ বার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে

গলের মাঠে পুরনো ক্রিকেট রোম্যান্টিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কংক্রিটের গ্যালারি নেই এখানে। সমুদ্রের দিকটায় গ্রাস ব্যাঙ্কে হাত-পা ছড়িয়ে বসে খেলা দেখা যায়। দু’দিক থেকে সমুদ্রের হাওয়া খেলছে। চমৎকার আবহ। সি বিচে ঘুরতে আসা পর্যটকদের বাস পার্ক করা রয়েছে সমুদ্রের ধারে। ট্যুরিস্টরা বসেও পড়ছেন গ্রাস ব্যাঙ্কে ক্রিকেট দেখতে। কিন্তু পূজারার কোনও স্ট্রোক দেখে এঁদের কাউকে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়নি।

বরং জনতার হৃদয় জেতা দুই ক্রিকেটার হলেন শিখর এবং হার্দিক। ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে তাঁরা পূজারার চেয়ে তো আলাদা বটেই। অনেক বেশি আক্রমণাত্মক, আকর্ষণীয়, বিনোদনমূলক। পাশাপাশি হাবভাব, অলঙ্কারেও বিস্তর তফাত। শিখর, হার্দিকদের মতো ট্যাটু বা কানে দুল নেই পূজারার। তাঁর পৃথিবীটাই হচ্ছে আটপৌরে তারকার পৃথিবী। মাঠের মতো মাঠের বাইরেও জৌলুস কম, শৃঙ্খলা আর কৃচ্ছ্রসাধনের ছাপ বেশি।

বিজ্ঞাপনের জন্য তাঁকে কখনও দরকার হবে না ভারতীয় ক্রিকেটের। দরকার হবে গল ফোর্টের মতো দুর্গ হয়ে সমুদ্রের এলোপাথারি ঢেউ থেকে দলকে রক্ষা করার জন্য। কোনও এক রাহুল দ্রাবিড় যেমন দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে বহু ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচাতেন। কাকতালীয়— কেরিয়ারের খুব কঠিন সময়ে পূজারাকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা ব্যক্তির নামও রাহুল দ্রাবিড়! গত দু’তিন বছরে বেশ কয়েক বার প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েছেন পূজারা। মন্থর ব্যাটিং বাদ পড়ার প্রধান কারণ। ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে খেলতে গিয়ে বিভ্রান্ত পূজারা ছোটেন কোচ দ্রাবিড়ের কাছে। নেটে ব্যাটিং দেখার পর দ্রাবিড় বলে দেন, টেকনিকে কোনও গণ্ডগোল নেই। ‘মিস্টার টেকনিক’ বলায় আশ্বস্ত হন পূজারা।

এই শ্রীলঙ্কাতেই ২০১৫-র সফরে এসে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন তিনি। তখন কোহালির দল বেশি আস্থা রেখেছিল স্ট্রোকপ্লেয়ার রোহিত শর্মার ওপর। দলে ফেরার জন্য ওপেন করতে হয় পূজারাকে। টিম ম্যানেজমেন্টের ছুড়ে দেওয়া সেই চ্যালেঞ্জের জবাব তিনি দেন সেঞ্চুরি করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ফের বাদ পড়েন। এর পরেও কি পাকাপাকি ভাবে উড়ে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে জল্পনা? টিমের একাংশের মধ্যে এই বিশ্বাস এখনও রয়েছে যে, রোহিত একা ম্যাচের রং পাল্টে দিতে পারেন।

যদিও পূজারার কাছে লড়াই বা চ্যালেঞ্জ নতুন কোনও শব্দ নয়। তাঁকে ক্রিকেটার করার স্বপ্ন নিয়ে কিশোর বয়সে রাজকোট থেকে মুম্বইয়ের ট্রেনে চেপেছিলেন বাবা অরবিন্দ পূজারা। মুম্বইয়ে খুব কম টাকায় ঘর ভাড়া করে থেকে রোজ লোকাল ট্রেন ধরে চলত বাবা-ছেলের ক্রিকেট অভিযান। মুম্বইয়ে অরবিন্দ চিনতেন শুধু কারসন ঘাউড়িকে। তাঁকেই প্রথম নেটে ডেকে ছেলেকে দেখান। জিজ্ঞেস করেন, আমার ছেলের ক্রিকেট হবে কি না, বলে দাও। ঘাউড়ি দু’তিন দিন দেখেই অরবিন্দকে বলেন, ছেলের মধ্যে দম আছে। ওকে ক্রিকেট খেলিয়ে যাও।

অরবিন্দ মনে করেন, মুম্বইয়ের সেই ট্রেনযাত্রা, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে ঠাসাঠাসি করে পড়ে থাকা— সেই জীবনটাই তাঁর ছেলেকে এমন নাছোড় ব্যাটসম্যান বানিয়েছে। ‘‘তিন বছর বয়সে একটা ব্যাট উপহার দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু ওই ব্যাট হাতে নিয়ে একটা স্ট্রোক নেওয়ার ছবি দেখে আমার প্রথম মনে হয়েছিল, ব্যাট ধরার ধরনটা ঠিক শিশুসুলভ নয়,’’ মনে পড়ে অরবিন্দের। মুম্বইয়ের কৃচ্ছ্রসাধন নিয়ে জিজ্ঞেস করলে যোগ করেন, ‘‘আমরা দু’জনেই জানতাম, এই লড়াইটা জিততেই হবে। যদি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে আসতাম, সমস্ত স্বপ্ন ওখানেই শেষ হয়ে যেত।’’ ভারতীয় ক্রিকেটের উড়ান ধরে ফেললেও মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনের সেই নিত্যযাত্রীর শৃঙ্খলা আর নম্রতা এখনও ছেড়ে যায়নি পূজারাদের।

মাঠের মধ্যে পূজারার কোনও আগুনে বহিঃপ্রকাশ নেই। গলে সেঞ্চুরি বা দেড়শো পূরণ করার পরেও কখনও বিশেষ ভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেল না তাঁকে। বরাবরই তিনি এ রকম। তার মানে এই নয় যে, ভিতরে কোনও আগুন নেই। শ্রীলঙ্কায় গত সফরে সেঞ্চুরি করে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের পর তখনকার টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী ড্রেসিংরুমে সকলের সামনে বলেন, ‘‘পূজারার ভিতরের আগুনটা তোমরা সবাই দ্যাখো। ওকে কখনও আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে দেখা যায় না। কিন্তু পূজির (এই নামেই তাঁকে দলের সকলে ডাকেন) নীরব প্রতিজ্ঞাটা আমাদের সকলের জন্যই উদাহরণ।’’

ট্যাটুহীন, দুলহীন, জৌলুসহীন পূজারাকে এর পরেও হয়তো আইপিএলে কেউ কিনবে না। কোনও সংস্থা ডাকবে না তাদের বিজ্ঞাপনে। না ডাকলে থাক গে যাক। পূজারাকে চিনব তাঁর এই প্রতিজ্ঞা দিয়ে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE