Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
টেস্টের প্রথম দিনই ব্যাকফুটে শ্রীলঙ্কা

দুই নীরব যোদ্ধার দাপটে শাসক ভারত

দিনের পর দিন নীরব লড়াই করে সাফল্য পেয়েও যিনি পূজিত হন না, তাঁর নাম চেতেশ্বর পূজারা। এত দিন ধরে চলতে থাকা সেই প্রথাই যেন পাল্টানোর লক্ষণ দেখা গেল বৃহস্পতিবার।

জুটি: কলম্বোয় বৃহস্পতিবার ভারতের দুই সেঞ্চুরিয়ান চেতেশ্বর পূজারা এবং অজিঙ্ক রাহানে। ছবি: এএফপি, এপি

জুটি: কলম্বোয় বৃহস্পতিবার ভারতের দুই সেঞ্চুরিয়ান চেতেশ্বর পূজারা এবং অজিঙ্ক রাহানে। ছবি: এএফপি, এপি

সুমিত ঘোষ
কলম্বো শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ০৪:২৩
Share: Save:

চেতেশ্বর পূজারার কাছে খুব বেশি সেলফি তোলার অনুরোধ আসে বলে কখনও চোখে পড়েনি। বৃহস্পতিবারের কলম্বো সে দিক দিয়ে ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে পারে।

সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের মাঠ যখন ছাড়ছে ভারতীয় দল, দু’জনকে নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেল। এক জন রান করেন বা না করেন, মনে হয় না তাঁকে নিয়ে উন্মাদনায় কোনও হেরফের হয়। তিনি— বিরাট কোহালি। তাঁকে ঘিরে এই উন্মাদনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দিনের পর দিন নীরব লড়াই করে সাফল্য পেয়েও যিনি পূজিত হন না, তাঁর নাম চেতেশ্বর পূজারা। এত দিন ধরে চলতে থাকা সেই প্রথাই যেন পাল্টানোর লক্ষণ দেখা গেল বৃহস্পতিবার। এমন একটা দিনে যখন চারদিক থেকে শিরোনামে পূজারা।

অর্জুন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। শ্রীলঙ্কার মাটিতে তিনটি টেস্টে এই নিয়ে তাঁর তিন নম্বর সেঞ্চুরি হয়ে গেল। সচিন তেন্ডুলকর ছাড়া কারও নেই। রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে দ্বিতীয় দ্রুততম ভারতীয় হিসেবে টেস্টে চার হাজার রানে পৌঁছে গেলেন।

সাধারণ ক্রিকেট ভক্তদের কাছে এ সব সংখ্যার কোনও গুরুত্ব নেই। তাঁরা পূজারার টি-টোয়েন্টি জমানা বিরোধী মূলত ডিফেন্স-নির্ভর ব্যাটিং নিয়েও খুব আগ্রহী হবেন কি না সন্দেহ। তবু কলম্বোর মাঠে কোহালির সই সংগ্রহ হয়ে যাওয়ার পরেও ক্রিকেট ভক্তরা চলে গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন পূজারার জন্য।

আরও পড়ুন: অর্জুন পুরস্কারের জন্য নাম পাঠানো হল পূজারা, হরমনপ্রীতের

অজিঙ্ক রাহানে? তিনি কোথায় গেলেন? তিনি তো পূজারার মতোই গ্ল্যামারের দুনিয়া থেকে বিসর্জিত। ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক নীরব সৈনিক। মুম্বই ক্রিকেটের সুনাম আছে বেঁটেখাটো চ্যাম্পিয়ন উপহার দেওয়ার জন্য। তালিকায় নতুন সংযোজন রাহানে।

পঞ্চাশতম টেস্ট খেলতে নামা পূজারা দিনের শেষে ২২৫ বলে ১২৮ নট আউট। প্রথম ৭৫ বল থেকে করেছিলেন মাত্র ২৩। তখনকার মতো মনে হচ্ছিল, ফের না তাঁর স্ট্রাইক রেট নিয়ে কথা উঠতে শুরু করে। শুরুতে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হতে হতেও বাঁচলেন। আরও বিপত্তি। ক্রিজে জমে যাওয়া কে এল রাহুলের রান আউটেও তিনি ছিলেন ভিলেন। বিরক্ত রাহুল হাত নেড়ে ‘আমার কল ছিল ওটা, আমার কল’ বলতে বলতে মাঠ ছাড়লেন।

‘কল’টা সত্যিই তাঁর ছিল। পূজারা স্টার্ট নিয়েও থেমে গেলেন। কাঁধে অস্ত্রোপচার এবং জ্বরের হাত থেকে ওঠার পরে এটাই ছিল প্রত্যাবর্তন টেস্ট। ৮২ বলে ৫৭ করে ভাল সেট হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখনই এমন দুর্ঘটনা। রাহুল ক্ষোভ আটকাতে পারেননি। সাধারণত, এ রকম ঘটনা ঘটলে নন-স্ট্রাইকারও অনুতাপে ভুগে মনঃসংযোগ হারাতে পারেন। কিন্তু রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিং গ্রহের বাসিন্দা পূজারার যে আবার ওটাই সেরা অস্ত্র— মনঃসংযোগ। তিনি যেন ‘রিফ্রেশ’ বাটন টিপে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সারা দিন নাড়ানো গেল না।

এমনিতে এই শ্রীলঙ্কা দলের যা বোলিংয়ের অবস্থা, রেকর্ড-টেকর্ড যাঁর যা করার আছে, এই সিরিজে টার্গেট করে নেওয়া যায়। ভাবা কঠিন এই দ্বীপপূঞ্জ থেকেই এক সময় মুথাইয়া মুরলীধরন নামে কেউ এসেছিলেন। পেসারদের মধ্যে নুয়ান প্রদীপ এবং বাঁ হাতি স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ ছাড়া কারও বোলিং দেখে ভক্তি হবে না।

সংখ্যায় দুই নায়কের দুরন্ত রেকর্ড

চেতেশ্বর পূজারা

• ১২৮ ন.আ., ২২৫ বল,

• বাউন্ডারি- ১০

• ওভার বাউন্ডারি-১

বিদেশে পূজারার চতুর্থ সেঞ্চুরি

• শ্রীলঙ্কায়-৩,

• দক্ষিণ আফ্রিকায়-১

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি

• ২০১৫-য় কলম্বোয় ১১৫, • ২০১৭-য় গলে ১৫৩ ও কলম্বোয় ১২৪ ন.আ.।

• সর্বোচ্চ টেস্ট গড়- ৫৩.৮০*

৫০তম টেস্টে সপ্তম ভারতীয় শতরানকারী

• সর্বোচ্চ সুনীল গাওস্করের ২২১

• টেস্টের ৪০০০ ক্লাবে ১৫ নম্বর ভারতীয়।

অজিঙ্ক রাহানে

• ১০৩ নটআউট

• ১৬৮ বল

• বাউন্ডারি ১২

বিদেশে ছ’নম্বর সেঞ্চুরি

• শ্রীলঙ্কায় ২

• ইংল্যান্ড ১

• অস্ট্রেলিয়া ১

• নিউজিল্যান্ড ১

• ও. ইন্ডিজে ১

• শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভারতের দু’শোর বেশি রানের ছ’নম্বর পার্টনারশিপ এটা।

• সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ ২৫৬, সচিন তেন্ডুলকর-সুরেশ রায়না, কলম্বো, ২০১০।

৩০ বছর পেরিয়ে গিয়ে মালিন্দা পুষ্পকুমারের টেস্ট অভিষেক হল। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাড়ে পাঁচশোর বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাঁ হাতি এই স্পিনারকে একেবারেই আন্তর্জাতিক মানের মনে হয়নি। তাঁর অ্যাকশনটাও কেমন যেন গোলমেলে দেখাল এবং আম্পায়ার যদি সন্দেহজনক বলে রিপোর্ট জমা দেন, অবাক হওয়ার থাকবে না। ১৯.২ ওভার বল করে পুষ্পকুমার দিলেন ৮২। মানে ওভার প্রতি ৪.২৪ রান করে খরচ করলেন। না নিলেন উইকেট, না আটকাতে পারলেন রান।

পূজারা যেমন টপ গিয়ারে উঠতে সময় নেন, রাহানের গাড়ি চলতে থাকে অটো গিয়ারে। যখন যেমন দরকার, তথন তেমন চলবে। দু’বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে মিচেল জনসনদের কাউন্টার অ্যাটাক করে রান করেছিলেন রাহানে এবং কোহালি। এ দিন কোহালি ২৯ বলে ১৩ করে হেরাথের বলে কাট মারতে গিয়ে স্লিপে ধরা দিলেন। দারুণ ক্যাচ নিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সেই রণনীতি নিয়ে হেরাথদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাহানে। ১৬৮ বলে ১০৩ রানে অপরাজিত তিনি। ইনিংসে ১২টি চার। স্ট্রাইক রেট ৬১.৩০। পূজারা ২২৫ বলে ১২৮ অপরাজিত। স্ট্রাইক রেট ৫৬.৮৮। ইনিংসে ১০টি চার ও ১টি ছয়। দু’জনের অবিচ্ছেদ্য পার্টনারশিপে চতুর্থ উইকেটে যোগ হয়ে গিয়েছে ২০১ রান।

রাহানের সেঞ্চুরি পূরণের সময় গ্যালারিতে উচ্ছ্বসিত দেখাল শ্রীমতী রাহানে-কে। মুম্বইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বামী-স্ত্রী। তেমনই মাটির মানুষ থেকে গিয়েছেন। ‘হ্যালো’ বলাটাও এত মার্জিত!

পঞ্চাশতম টেস্টে পূজারার হয়ে গেল ১৩তম টেস্ট সেঞ্চুরি। ৩৯তম টেস্টে রাহানের হল ৯ নম্বর সেঞ্চুরি। রাহানে মুম্বইয়ের। পূজারা রাজকোটের। কিন্তু দু’জনেই মুম্বইয়ের ভি়ড় ঠাসা লোকাল ট্রেনে চেপে কিটব্যাগ নিয়ে নিত্যযাত্রীর কৃচ্ছ্রসাধন করে তবেই এই জায়গায় পৌঁছেছেন। রাহানে থাকতেন ডম্বিভ্‌লিতে। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে প্র্যাকটিসে আসতে হতো। আর ছেলেকে ক্রিকেটার করার স্বপ্ন নিয়ে অরবিন্দ পূজারা মুম্বইয়ে এসেছিলেন কিশোর চেতেশ্বরকে নিয়ে। দু’জনেরই ক্রিকেটার হিসেবে বালক থেকে যুবক হওয়াটা তাই মুম্বইয়ের ক্রিকেট ময়দানে। পরে পূজারার সঙ্গে মুম্বইয়ে অফিস লিগেও একসঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছেন রাহানে। তাই তাঁদের দু’জনের পার্টনারশিপে বরাবরই দারুণ বোঝাপড়া চোখে পড়ে।

প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের মাঠের স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে ৩৪৪-৪। ওভার প্রতি রানরেট ৩.৮৮। দুই নীরব যোদ্ধার দাপটে সিরিজে ২-০ এগিয়ে যাওয়ার বাজনা বাজতে শুরু করে দিয়েছে। ও দিকে পূজারা-রাহানে অপরাজিত থেকে ড্রেসিংরুমে ঢুকে যেতেই মাঠে নেমে পড়লেন ভারতীয় স্পিনাররা। পূর্বাভাস হচ্ছে, এই পিচে দ্বিতীয় দিনের শেষের দিক থেকেই বল ঘুরতে পারে। শ্রীলঙ্কা সেই কারণে তিন স্পিনার খেলিয়েছে। কোহালিরা প্রত্যাশা মতোই হার্দিক পাণ্ড্যকে রেখে দুই স্পিনারেই নেমেছেন।

ভারতীয় শিবিরের রণনীতি হচ্ছে, প্রথম ইনিংসে ৫৫০-৬০০ রানের গন্ধমাদন চাপিয়ে দাও চণ্ডীমলদের মাথায়। তার পর? ওভার টু অশ্বিন!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE