Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sha'Carri Richardson

মা-কে হারিয়ে গাঁজা সেবন, অলিম্পিক্সের স্বপ্ন কেড়েছিল নির্বাসন, আশা জাগিয়েও পারলেন না শাকারি 

জন্মদাত্রী মা-কে হারিয়ে গাঁজা সেবন করে নির্বাসিত হয়েছিলেন। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে লড়া হয়নি। সেই শাকারি রিচার্ডসনের স্বপ্নপূরণ হল না প্যারিস অলিম্পিক্সে। মহিলাদের ১০০ মিটার রুপো জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হল তাঁকে।

সোনা হাতছাড়া করে হতাশ শাকারি রিচার্ডসন।

সোনা হাতছাড়া করে হতাশ শাকারি রিচার্ডসন। ছবি: রয়টার্স।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৪ ১০:৪৪
Share: Save:

‘ডোপিং’ এবং ‘ব্যান’। অ্যাথলেটিক্সের বিশ্বে খুবই পরিচিত দু’টি শব্দ। যে কোনও ক্রীড়াবিদের কাছে জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক দু’টি শব্দ। ডোপিং এবং নির্বাসনের রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক খেলাধুলোয় ফিরতে পেরেছেন, এমন ক্রীড়াবিদের সংখ্যা নেহাতই কম। তাঁদেরই একজন শাকারি রিচার্ডসন। মাত্র এক মাসের নির্বাসন কী ভাবে এক ক্রীড়াবিদের জীবন ওলট-পালট করে দিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে অলিম্পিক্সে খেলার স্বপ্ন, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আমেরিকার এই খেলোয়াড়। নির্বাসনের নির্মম বাস্তব কাউকে ছাড়ে না। নিয়ম সকলের ক্ষেত্রেই সমান। শাকারির ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু জীবনের অন্ধকূপ থেকে উঠে এসে আবার আলোয় ফিরতে সকলে হয়তো পারেন না। শাকারি সেটাই করে দেখিয়েছেন। কিন্তু আশা জাগিয়েও শনিবার বিশ্বের দ্রুততম মানবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন না। শেষ করতে পারলেন না জামাইকার একচ্ছত্র্য আধিপত্য। রুপো জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হল তাঁকে।

মাত্র এক মাসের নির্বাসন! সে আর এমন কী। সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন। নিষিদ্ধ ওষুধ, ড্রাগ খেয়ে কত জনই রোজ নির্বাসিত হচ্ছেন। কিন্তু গাঁজা খেয়ে নির্বাসন? তা-ও আবার নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুর শোক ভুলতে। মাত্র একটি মাসের নির্বাসন যদি কোনও ক্রীড়াবিদের থেকে অলিম্পিক্সে খেলার স্বপ্ন কেড়ে নেয়, যদি এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় গত কয়েক বছরের পরিশ্রম, যদি গোটা দুনিয়া তাঁর বিপক্ষে চলে যায়, তা হলে কেমন লাগতে পারে? শাকারি এই সব প্রশ্নেরই উত্তর জানেন। জীবনের কঠিনতম রূপ কেমন হতে পারে তা জানতেন। তাই গত তিন বছর কাটানো প্রতিটি রাত, অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাকে ফেলা প্রতিটি পদক্ষেপ তাঁর কাছে এক-একটি সঙ্কল্প ছিল। অল্পের জন্য সেই সঙ্কল্পপূরণ হল না শনিবার রাতে।

২০০০ সালের ২৫ মার্চ আমেরিকার ডালাসে জন্ম শাকারির। ছোটবেলা থেকেই ঠাকুমা বেটি হার্প এবং এক কাকিমার কাছে মানুষ। তাঁর জন্মদাত্রী মা-বাবার পরিচয় কোনও দিন প্রকাশ্যেই আনা হয়নি। ঠাকুমা কোনও দিন নাতনিকে জানতে দেননি মায়ের ব্যাপারে। কেন সেই ঘটনা জানতে দেননি তা আজও অজানা। তবে ছোটবেলায় শাকারির মনে তা প্রভাব ফেলেনি খুব একটা। প্রভাব ফেলেছিল মায়ের মৃত্যুর পরে।

আমেরিকার স্কুলে অ্যাথলেটিক্স-সহ বিভিন্ন খেলাধুলোর উপরে খুব ছোটবেলা থেকেই জোর দেওয়া হয়। কিছু কিছু স্কুলে খেলাধুলোয় অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক। ছোটবেলা থেকে দৌড়ের প্রতি শাকারির আগ্রহ ছিল। স্বাস্থ্যও ছিল তেমনই। ডালাসের কার্টার হাইস্কুলে পড়াশোনা করার সময় থেকেই তাঁর উত্থান। সেই স্কুলের হয়েই আমেরিকার জুনিয়র অলিম্পিক্সে অংশ নেন। এটি আমেরিকার যুবক-যুবতীদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। সেখানে নজর কাড়তে পারলে আরও উঁচু জায়গায় পৌঁছনো যায়। সেই প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ড্যাশে প্রথম হয়ে নজর কেড়ে নেন তিনি। পরের বছরেও সাফল্য। আমেরিকার জাতীয় জুনিয়র অলিম্পিক্স ট্র্যাক ও ফিল্ড প্রতিযোগিতায় ২০০ মিটারে সোনা জেতেন। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও অভিষেক হয় শাকারির। অনূর্ধ্ব-২০ প্যান আমেরিকান প্রতিযোগিতায় সোনা জেতেন ৪*১০০ মিটার রিলে রেসে।

২০১৮ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর লুইজ়‌িয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে ন্যাশনাল কলেজিয়েট অ্যাথলেটি অ্যাসোসিয়েশন (এনসিএএ) আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ১০.৭৫ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ন। সে বছর এনসিএএ আয়োজিত কোনও প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে হারেননি। আমেরিকার বর্ষসেরা মহিলা ক্রীড়াবিদ হন। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পেশাদার খেলাধুলোয় মন দেন। সে বছরই এক বিখ্যাত সংস্থার সঙ্গে প্রচুর অর্থে চুক্তি হয়।

২০২১ সালে আমেরিকার অলিম্পিক্স ট্রায়ালে ১০.৮৬ সেকেন্ড সময় করে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করেন। টোকিয়োতেই জামাইকানদের আধিপত্যে থাবা বসানোর ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। এমন সময়েই জীবনের কঠিনতম আঘাত পান শাকারি। সাধারণ একটি ডোপ পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল পজিটিভ আসে। রক্তের নমুনায় গাঁজা সেবন করার উপাদান মিলেছিল। তার পরেই অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত অলিম্পিক্সের ঠিক আগে তাঁকে এক মাস নির্বাসিত করে আমেরিকার ডোপ-বিরোধী সংস্থা। ফলে ১০০ মিটারে নামার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় শাকারির। নির্বাসন শেষের পরে তিনি রিলে দৌড়ে নামতেই পারতেন। সেখানেও আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়নি।

সেই নির্বাসন নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। খোদ দেশের প্রেসিডেন্টকেও নামতে হয়েছিল আসরে। গাঁজা সেবন করার কারণ হিসাবে শাকারি জানিয়েছিলেন, অলিম্পিক্সে নামার বিপুল চাপ এবং জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুর শোক ভুলতে ওই কাজ করেছিলেন। সেটাও আবার ওরেগন প্রদেশে গিয়ে, যেখানে গাঁজা সেবন বৈধ। শাকারি কোনও দিন অপরাধের কথা অস্বীকার করেননি। ওই ঘটনা নিয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সাধারণ মানুষ জানে না যে কোন পরিস্থিতিতে ওই কাজ করতে হয়। নিজের সমস্ত কষ্ট ঢেকে বাইরের জগতে গিয়ে স্বাভাবিক মুখ দেখানো সোজা কাজ নয়। মনের মধ্যে এ রকম যন্ত্রণা চললে, আগে অনুভব করেননি এ রকম কোনও লড়াই আপনাকে করতে হলে কোন কাজ করা ঠিক সেটা কি বাইরের কেউ বলে দিতে পারে? আমি ক্ষমা চাইছি। আমি হতাশ। আমি জানি ট্র্যাকে নামলে শুধু নিজের জন্য নামি না। আমি একটা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করি, যারা আমায় সব সময় ভালবাসা, সমর্থনে ভরিয়ে রাখেন। আমি আপনাদের সবাইকে হতাশ করেছি। আসলে কী ভাবে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা জানতাম না। আমি যদি আপনাদের হতাশ করে থাকি, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।”

তবে বিতর্ক এখানেই থামেনি। শাকারিকে অন্যায় ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে দাবি করে গর্জে ওঠে গোটা আমেরিকা। গাঁজা সেবনের নিয়মকে আরও উদার করার দাবি ওঠে সে দেশে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পর্যন্ত বলেন, ডোপ-বিরোধী নিয়মকে নতুন করে সংশোধন করতে হবে। আমেরিকার ডোপ বিরোধী সংস্থা (উসাডা) জানায়, এই নিয়ম বদলানোর সাধ্য তাদের নেই। নিয়ম তৈরি করে বিশ্ব ডোপ-বিরোধী সংস্থা (ওয়াডা)। যে হেতু গাঁজা সেবন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে অবৈধ, তাই এই নিয়ম বদলানো খুব একটা সোজা কাজও নয়। চাপে পড়ে ওয়াডা জানায়, তারা নিয়ম খতিয়ে দেখবে। নির্বাসনের পর প্রি-ফন্টেন ক্লাসিকে নেমেছিলেন শাকারি। সবার পিছনে শেষ করেন।

তার পরের বছরটাও ভাল কাটেনি। চোট-আঘাত এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকায় কোথাও ভাল ফল করতে পারেননি শাকারি। আমেরিকার খেলোয়াড়কে আবার নিজের সেরা ফর্মে পাওয়া যায় ২০২৩ সাল থেকে। ১০০ মিটারের ইতিহাসে চতুর্থ দ্রুততম সময়ে দৌড় শেষ করেন। ১০.৫৭ সেকেন্ডে। প্রথম বার ডায়মন্ড লিগ জেতেন। আমেরিকার ট্র্যাক ও ফিল্ড প্রতিযোগিতায় সোনা জেতেন। তার পরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান। রিলে দৌড়েও তাঁর দাপট ছিল দেখার মতোই।

এ বছর আমেরিকার অলিম্পিক্স ট্রায়ালে সহজেই জেতেন এবং প্যারিসে আসার টিকিট নিশ্চিত করেন। আমেরিকার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও জিতেছেন।

শুধু খেলাধুলো নয়, সামাজিক কাজকর্মেও মন রয়েছে। ২০২১ সালেই তিনি জানিয়েছিলেন এক বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। সমকামীদের আন্দোলন বরাবর সমর্থন করেছেন। স্বীকার করেছেন, নিজে উভকামী। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ১০০ মিটারে যেমন পারলেন না, তেমনই ২০০ মিটারের যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেননি শাকারি।

অন্য বিষয়গুলি:

Sha’carri Richardson Paris Olympics 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy