গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
প্যারিস অলিম্পিক্সে তাঁর সুযোগ পাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। সেই বিতর্ক কাটিয়ে অলিম্পিক্সে ভাল খেলেছিলেন অর্চনা কামাথ। কিন্তু অলিম্পিক্স থেকে ফিরেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আর টেবল টেনিস খেলবেন না। পড়াশোনা করতে বিদেশে গিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠছে। আর্থিক কারণেই কি মাত্র ২৪ বছর বয়সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্চনা? এই বিষয়ে কী বলছে বাংলার টেবল টেনিস মহল?
অর্চনার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ খুলেছেন তাঁর কোচ অংশুল গর্গ। তাঁকে নাকি অর্চনা প্রশ্ন করেছিলেন, ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে কি পদক জিততে পারবে ভারত? কোনও জবাব দিতে পারেননি কোচ। ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ ও পড়াশোনার প্রতি ভালবাসার কারণেই নাকি টেবল টেনিস ছেড়েছেন অর্চনা। যদিও অংশুলের একটি কথা আর্থিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, “দেশের বড় খেলোয়াড়দের কোনও সমস্যা হয় না। তারা স্পনসর পায়। কিন্তু যারা উঠতি খেলোয়াড়, তাদের মনে সংশয় থাকে। টেবল টেনিস খেলে সংসার চালানো যাবে তো? তাই অর্চনার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি প্রশ্ন করতে পারছি না।” তা হলে কি বকলমে টাকার বিষয়টিই তুলে ধরতে চাইলেন অংশুল?
টেবল টেনিসে পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম বড় অ্যাকাডেমি ‘ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’ বা ডিডিএসপি। অ্যাকাডেমির কর্নধার চন্দ্র কুমার ধানুকা। অ্যাকাডেমি চালান ভারতের দুই প্রাক্তন খেলোয়াড় সৌম্যদীপ রায় ও পৌলমী ঘটক। কলকাতায় চারটি অ্যাকাডেমি রয়েছে তাঁদের। অনেক বাচ্চা সেখানে শেখে। এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রথম মহিলা জুটি হিসাবে পদক জেতা ঐহিকা মুখোপাধ্যায় ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়ও এই অ্যাকাডেমিতেই অনুশীলন করেন। চন্দ্র কুমারের মতে, তিনি এই ধরনের কোনও ঘটনা দেখেননি। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “উনি তো আমার অ্যাকাডেমির নন। আমি আমার অ্যাকাডেমি নিয়ে বলতে পারি যে, এখানকার কোনও খেলোয়াড় কোনও দিন বলেনি টাকার জন্য খেলতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা আর্থিক সাহায্যও করি। বাইরে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার খরচ দিই। ঐহিকাও (মুখোপাধ্যায়) তো প্যারিসে গিয়েছিল (ভারতের মহিলাদের টেবল টেনিস দলে রিজ়ার্ভে ছিলেন তিনি)। ওখান থেকে এসে বলল, পরের বার পদক জেতার লক্ষ্য নিয়ে নামবে। আমার অ্যাকাডেমিতে কত বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলে। কোনও দিন এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি।”
বাংলার হয়ে টেবল টেনিসে প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন পৌলমী মনে করেন, অর্চনার যা পারিবারিক অবস্থা ও তিনি যা সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাতে আর্থিক সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “অর্চনার বাবা-মা ডাক্তার। ও সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে। ছোট থেকেই ফেডারেশনের সুবিধা পেয়েছে। ভারতের সেরা টেবল টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকায় ও সরকারি সুবিধা পেত। কোনও প্রতিযোগিতায় নামতে টাকা লাগত না। ওর স্পনসরও ছিল। আমার মনে হয়, অন্য কোনও কারণে ও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর্থিক সমস্যা কোনও কারণ নয়।” তাঁর নিজেরও অ্যাকাডেমি রয়েছে। সেখানেও অনেকে নিখরচায় অনুশীলন করেন বলে জানিয়েছেন পৌলমী। তাঁর কথায়, “খেলো ইন্ডিয়ায় অংশ নেওয়া অনেকে আমাদের অ্যাকাডেমিতে নিখরচায় অনুশীলন করে। এখন টেবল টেনিসে একটু ভাল জায়গায় যেতে পারলে আর্থিক সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সরকার এগিয়ে এসেছে। স্পনসরও পাওয়া যায়। আমার মনে হয়, ওর লক্ষ্য এখন টেবল টেনিস নয়। তাই ও ছেড়ে দিয়েছে।”
আর এক প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মৌমা দাসের মতে, ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে খেলার খরচ কম। তবে সেটাও খুব কম নয় বলেই জানিয়েছেন বাঙালি টেবল টেনিস তারকা। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “পশ্চিমবঙ্গে খেলার খরচ অন্য সব রাজ্যের থেকে কম। আমি শুনেছি সৌম্যদীপ-পৌলমীদের অ্যাকাডেমিতে থাকা, খাওয়া, অনুশীলন সব মিলিয়ে মাসিক প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। যদি কেউ অর্ধেক সেশন খেলে বা অ্যাকাডেমিতে না থাকে, তা হলে বোধহয় ১২-১৩ হাজার টাকায় হয়ে যায়। আবার কোথাও খেলতে গেলে কোচ নিয়ে গেলে তার জন্য আলাদা টাকা লাগে।” মৌমা জানিয়েছেন, অর্চনা নাকি আগে থেকেই খেলা ছাড়ার কথা ভাবছিলেন। তিনি বললেন, “আমি অর্চনার কোচের কাছে যা শুনেছি, কমনওয়েলথ গেমসের দলে সুযোগ না পাওয়ায় ও খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিল। তখনই ও খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর কোচ, বাবা-মা বলেছিল, আরও দু’বছর অন্তত খেলতে। তার পরে ও খেলেছিল। ভালই খেলছিল। অলিম্পিক্সেও সুযোগ পেল। কিন্তু ফিরে এসেই ছেড়ে দিল। ও মন থেকে নাকি খেলতে চাইছে না। যে মন থেকে চাইছে না, তাকে তো আর জোর করে খেলানো যায় না। আমারও অবাক লাগছে।”
প্রশ্ন উঠছে, অর্চনা যদি আগে থেকেই খেলা ছাড়তে চাইছিলেন তা হলে তিনি অলিম্পিক্সে গেলেন কেন? সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিচারে ভারতীয় দলে মণিকা বাত্রা ও শ্রীজা আকুলার পরে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসাবে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল ঐহিকার। এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জের পাশাপাশি বিশ্বের এক নম্বর সুন ইয়েংসাকে হারিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও তাঁকে রিজ়ার্ভে রাখা হয়েছিল। অর্চনা যদি আগেই জানাতেন তাঁর খেলার ইচ্ছা নেই, তা হলে ঐহিকা সুযোগ পেতেন। তাতে কি ভারতের পদক জেতার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বাড়ত?
আরও একটি প্রশ্ন উঠছে। অলিম্পিক্সে অর্চনার পারফরম্যান্স খুব খারাপ ছিল না। প্রথম বার ভারতের মহিলাদের দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। সেখানে জার্মানির বিরুদ্ধে একমাত্র অর্চনাই নিজের ম্যাচ জিতেছিলেন। কারও যদি খেলার ইচ্ছা না থাকে, তা হলে তার পারফরম্যান্স কি ভাল হত? সে রকম তো কিছু ঘটেনি। তা হলে কি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ না থাকার আশঙ্কা থেকেই টেবল টেনিস থেকে সরে দাঁড়ালেন অর্চনা?
যদিও সংবাদমাধ্যমে অর্চনা জানিয়েছেন, পড়াশোনার প্রতি ভালবাসার কারণেই টেবল টেনিস ছাড়ছেন তিনি। মিশিগানে পড়তে গিয়েছেন অর্চনা। সেখান থেকে তিনি বলেন, “একমাত্র পড়াশোনার কারণেই টেবল টেনিস ছেড়েছি। এত দিন সব রকমের সাহায্য পেয়েছি। আর্থিক সমস্যাও হয়নি। তাই এটা স্পষ্ট করে বলতে পারি যে কোনও রকম আর্থিক কারণে খেলা ছাড়ছি না।” অর্চনার বাবা গিরীশ কামাথও পড়াশোনার বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “আমার ছেলে নাসা-য় কাজ করে। অর্চনা ওর দাদার বড় ভক্ত। অর্চনাও ছোট থেকে পড়াশোনায় খুব ভাল। পাশাপাশি টেবল টেনিসকে বেছে নিয়েছিল ও। ১৫ হছর ধরে খেলেছে। দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এখন ওর মনে হয়েছে, পড়াশোনা শেষ করা উচিত। তাই গিয়েছে। ওর সিদ্ধান্তের পাশে আমরা আছি।”
অর্চনা বা তাঁর বাবা আর্থিক বিষয় নিয়ে মুখ না খুললেও প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। ভারতে ক্রিকেট বা ফুটবলে যে পরিমাণ টাকা তার ধারেকাছেও পান না ছোট খেলার সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়েরা। সেই কারণেই কি ২৪ বছর বয়সেই খেলা ছেড়ে দিতে হচ্ছে সদ্য অলিম্পিক্স খেলে আসা অর্চনাকে? প্রশ্ন উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy