কঠিন শাস্তির মুখে অভিযুক্ত কোচ। ফাঁস হওয়া সেই ভিডিয়ো থেকে নেওয়া ছবি।
ফোনের ও পারের গলাটা মাঝে মাঝেই আটকে আসছে। জড়িয়ে যাচ্ছে কষ্টের বাষ্প। তার মধ্যেই ভাঙা ভাঙা আওয়াজ জানাল, বৃহস্পতিবার দুপুরে আসা ফোনটার কথা।
সকালেই টুইট করে নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেন রিজিজু। অভিযুক্ত সাঁতার কোচের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। সে সব কথা জানাই ছিল নিজের কোচের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলা রিষড়ার কিশোরীর। কিন্তু কিরেন রিজিজুর নির্দেশে যে তাঁর সচিব ফোন করবেন তাকে, সেটা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল ওই কিশোরী এবং তার পরিবারের কাছে।
এ দিন দুপুরে ওই কিশোরী সাঁতারুর কাছে ফোন আসে কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীর দফতর থেকে। কী কথা হল? বিকেলে আনন্দবাজারকে কিশোরী বলে, ‘‘ক্রীড়ামন্ত্রীর সচিব আমাকে ফোন করেছিলেন। আমাকে অনেকটা সাহস জুগিয়েছেন। ক্রীড়ামন্ত্রী গোটা বিষয়টা দেখছেন বলে আমাকে জানান ওঁর সেক্রেটারি। সব রকম ভাবে আমার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।’’ এর পর কিছু ক্ষণ চুপচাপ ফোনের ও পার। তার পর ভাঙা গলায় ভেসে এল, ‘‘সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল!’’
আরও পড়ুন: যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত সাঁতার কোচের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ঘোষণা রিজিজুর
আরও পড়ুন: দিনের পর দিন যৌন হেনস্থা, গোয়ায় কোচের দুষ্কর্মের ভিডিয়ো তুলল বাংলার কিশোরী সাঁতারু
কোচ সুরজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল ওই কিশোরী। তার পরিবারও। কোচের ডাকে সাড়া দিয়ে তাই চলতি বছরের মার্চে সপরিবার গোয়া চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেখানে যাওয়ার পর থেকেই যৌন হেনস্থার শুরু। দীর্ঘ ছ’মাস নানা অছিলায় সুরজিৎ জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ওই কিশোরী সাঁতারুর যৌন হেনস্থা করতেন বলে অভিযোগ। লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখত মেয়েটি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় এক দিন নিজেই ঠিক করে ফেলে, সব ফাঁস করে দেবে। সেই মতোই কোচের দুষ্কর্মের ভিডিয়ো মোবাইলবন্দি করে সে। এ দিন কিশোরী বলে, ‘‘গোয়া যাওয়ার পর থেকেই স্যর আমার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করতেন। ব্ল্যাকমেল করতেন। আমি আর মানসিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। তখনই ঠিক করি, কিছু একটা করতে হবে। সেই মতো মোবাইলে ওই ভিডিয়ো রেকর্ড করি।’’
থানায় এই লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে কিশোরী সাঁতারুর পরিবার।
জাতীয় প্রতিযোগিতা থেকে পদক জেতা বাংলার ওই কিশোরী সাঁতারু গোয়া থেকে পালিয়ে আসার কাহিনিও এ দিন শোনান আনন্দবাজারকে। তার কথায়, ‘‘স্যর তখন গোয়ায় ছিলেন না। সিনিয়র ন্যাশনাল মিটের জন্য ভোপালে গিয়েছিলেন। সেই সময়েই আমরা পালিয়ে আসি রিষড়ার বাড়িতে। স্যর ওখানে থাকলে আমরা হয়তো ফিরতেই পারতাম না। আরও বড় ক্ষতি হয়ে যেত আমার।’’
এর পর অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই কয়েকটা বাক্য উঠে এল ওই কিশোরীর বুজে আসা গলায়, ‘‘গত পাঁচ বছর ধরে স্যরের পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। খুবই ভাল ছিল। স্যরের ছেলেও খুব ভাল সাঁতারু।’’ একটু থেমে, ‘‘কোনও দিন ভাবিনি, স্যর আমার সঙ্গে এ রকম...!’’ কথা আর শেষ করতে পারে না বছর পনেরোর কিশোরী। ফোনটা সাইলেন্ট হয়ে যায়।
কিশোরী সাঁতারুর এই বিস্ফোরক অভিযোগের পরে সুরজিৎকে নিয়ে এখন কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে বাংলার সাঁতার মহলে— অতীতেও নাকি তিনি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন! কিন্তু, কোচের কুকীর্তি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি। নিজেদের কেরিয়ার নষ্ট হওয়ার কথা ভেবে। তবে সে সবের কোনও প্রমাণ নেই বলেই প্রকাশ্যে তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে সুরজিতের উপর যে কলকাতার সাঁতার মহল ভীষণই ক্ষুব্ধ, তা টের পাওয়া গেল প্রাক্তন সাঁতারু বুলা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার সময়। তিনি বলেন, ‘‘আজ শিক্ষক দিবস। শিক্ষক তো বাবার থেকেও বড়। শিক্ষক হিসেবে সুরজিতের এই ব্যাভিচার মেনে নেওয়া যায় না। আমার তো সব শুনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।’’
কিরেন রিজিজুর সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেই মনে করছেন বুলা। তাঁর কথায়, ‘‘ক্রীড়ামন্ত্রী একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোথাও যেন চাকরি না পায় ওই লোকটা (সুরজিৎ)। তবে, মেয়েটার মানসিক অবস্থা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। আশা করব, যে সাঁতারের জন্য ওকে এত বড় মূল্য দিতে হয়েছে, সেই সাঁতার যেন ও না ছাড়ে। প্রচণ্ড মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়েছে। ওর সারা জীবন পড়ে রয়েছে। আগামী দিনেও এ রকম কঠিন মানসকিতারই যেন পরিচয় দেয় মেয়েটা।’’
একই কথা বলছেন অলিম্পিয়ান দীপা কর্মকারের কোচ বিশেশ্বর নন্দী। এ দিন আগরতলা থেকে তিনি বলেন, ‘‘ঘটনটি যদি ১০০ শতাংশ সত্যি হয়, তা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় যা সাজা হওয়া দরকার তাই যেন হয় ওই কোচের।’’
কোচের এই ‘কীর্তি’র কথা জানতে পেরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ টেবল টেনিস খেলোয়াড় পৌলমী ঘটক। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘বাবার পরেই আমরা কোচকে রাখি। একটা-দুটো ঘটনার প্রেক্ষিতে সবাইকে এক ভাবে বিচার করা ঠিক হবে না। মেয়েটা যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে, তাতে আমি গর্ব বোধ করছি। ও আরও অনেক মেয়েকে সাহস দিয়ে গেল।’’
মেয়েকে নিয়ে গর্বিত ওই কিশোরীর বাবাও। ভয়-আতঙ্ক-মেয়ের কেরিয়ার— সব কিছুকে সরিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘বাবা হিসেবে এই পোস্ট লিখতে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমার মেয়ের সমবয়সী তো ওঁর (সুরজিতের) ছেলে রয়েছে। এই নোংরামি করার আগে কি একবারও ছেলের কথা ওঁর মনে পড়ল না?’’ এ দিনও তিনি রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন। সোমবার রাতে তাঁরা প্রথম রিষড়া থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ দায়ের করতে। কিন্তু পুলিশ তাঁদের গোয়ায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করাতে পরামর্শ দেয়। এর পর মঙ্গলবার দুপুরে চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার (শ্রীরামপুর) ঈশানী পালের সঙ্গে আনন্দবাজারের তরফে যোগাযোগ করা হয়। সমস্তটা শুনে তিনি অভিযোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু, কিশোরীর পরিবারের অভিযোগ বুধবার রাতে দীর্ঘ ক্ষণ তাঁদের অপেক্ষা করিয়ে রেখেও অভিযোগ নেয়নি রিষড়া থানা। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই অভিযোগ দায়ের করতে পেরেছেন তাঁরা।
লড়াই করতে জলে নেমেছিল। আচমকা সেই জলই কেড়ে নিচ্ছিল লড়াইটা। ফের সেই লড়াইতেই ফিরতে চায় ওই কিশোরী। তবে এ বারের লড়াইয়ে তার পাশে রয়েছে সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy