অপ্রতিরোধ্য: জয়ের পরে মোহনবাগানের ফুটবলারেরা। এআইএফএফ
এই মরসুমে মোহনবাগানের খেলাটা যেন কালজয়ী গানের সুরের মতো। শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যার রেশ থেকে যায়।
রবিবার ইম্ফলে ট্রাউয়ের বিরুদ্ধে জোসেবা বেইতিয়াদের জয় নিয়ে সংশয় ছিল না। এই মুহূর্তে মোহনবাগানকে আটকানোর ক্ষমতা খুব কম দলেরই আছে। তা সত্ত্বেও টেলিভিশনের সামনে বসেছিলাম কিবু ভিকুনার জন্য।
আগের ম্যাচে মোহনবাগানের প্রতিপক্ষ ছিল চার্চিল ব্রাদার্স। এ বার ট্রাউ। দু’টো দলের খেলার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। উইলিস প্লাজ়াকে সামনে রেখে নিজেদের মধ্যে পাস খেলে চার্চিল আক্রমণে ওঠে। ট্রাউয়ের রণনীতি হল, দ্রুত বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে পৌঁছে যাওয়া। যা রক্ষণের উপরে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। তার উপরে চোটের কারণে মোহনবাগান রক্ষণের অন্যতম ভরসা ড্যানিয়েল সাইরাস দল থেকে ছিটকে গিয়েছে। আর এক ডিফেন্ডার আশুতোষ মেহতাও নেই। ফলে আরও মরিয়া হয়ে ঝাঁপানোর পরিকল্পনা নিয়েই নামবে ট্রাউ। এই পরিস্থিতিতে কিবু কী রণনীতি নেন, সেটা দেখাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
রবিবার ম্যাচটা শুরু হওয়ার দু’মিনিটের মধ্যেই ট্রাউয়ের যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় মোহনবাগান। ট্রাউয়ের অস্ত্রেই ট্রাউকে ঘায়েল করলেন কিবু। এ দিন আর ম্যাচের শুরু থেকে বিপক্ষকে পাসের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি জোসেবা বেইতিয়ারা। বরং প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল দ্রুত বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়া। যাতে রক্ষণ সামলাতে নেমে আসতে বাধ্য হয় ট্রাউয়ের মিডফিল্ডার ও ফরোয়ার্ডেরা। ঠিক সেটাই হল। মাঝখানে পাপা বাবাকর জিয়োহারাকে রেখে দু’দিক দিয়ে সুহের ভি পি ও কোমরন তুর্সুনভ আক্রমণে ঝড় তুলল। ক্লান্তিহীন ভাবে ওদের পাস দিয়ে গেল বেইতিয়া, ফ্রান গঞ্জালেস, শেখ সাহিলেরা।
ম্যাচের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এগিয়ে যেতে পারত মোহনবাগান। বক্সের মধ্যে ট্রাউয়ের ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে সুহের যে শট নিয়েছিল, অল্পের জন্য তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মিনিট দু’য়েক পরে একই ভাবে গোল নষ্ট করে গঞ্জালেস। চাপ সামলাতে না পেরে ১৩ মিনিটে তুর্সুনভকে বক্সের মধ্যে ফাউল করে ট্রাউয়ের ডিফেন্ডার ধনচন্দ্রম মিতেই। পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করেনি গঞ্জালেস। ২২ মিনিটে ডান পায়ের বাঁক খাওয়ানো শটে অসাধারণ গোল করে ২-০ করে ম্যাচের সেরা বেইতিয়া। এক মিনিট পরে ফের গোল। এ বার তুর্সুনভের পাস থেকে গোল পাপার। ম্যাচের ভবিষ্যৎ ২৩ মিনিটেই লেখা হয়ে গেল।
ট্রাউয়ের বিরুদ্ধে কিবুর রণনীতি দেখে আমার প্রয়াত অমলদার (দত্ত) কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আগের ম্যাচে ২৩টি পাসে অসাধারণ গোল করেছিল তুর্সুনভ। যা ডায়মন্ড সিস্টেমকে মনে করাচ্ছে। রবিবাসরীয় ম্যাচে অমলদার মতোই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুললেন কিবু। ১৪ ম্যাচে ৩৫ পয়েন্ট নিয়ে শুধু লিগ টেবলের শীর্ষ স্থান দখলে রাখাই নয়, ধরাছোঁয়ারও বাইরে চলে গেল মোহনবাগান। সঙ্গে করিম বেনশরিফার সময়ে টানা ১১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার কীর্তিও ম্লান করে দিলেন কিবু (টানা ১২ ম্যাচ অপরাজিত)। চ্যাম্পিয়ন হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সম্ভবত সত্তরের দশকের শেষ। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে আমাদের ম্যাচ ছিল। অমলদা তখন মোহনবাগানের কোচ। সে বছর দুর্ধর্ষ দল ছিল ইস্টবেঙ্গলের। আমাদের দুর্বল জায়গা ছিল রক্ষণ। ম্যাচের আগে অমলদা বলেছিলেন, ‘‘আমাদের রক্ষণের যা অবস্থা, ইস্টবেঙ্গলকে আটকানো কঠিন। তাই আমাদের অতিআক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে হবে। যাতে ওদের সবাই বাধ্য হয় নীচে নেমে রক্ষণ সামলাতে।’’ অমলদার নির্দেশে আমিও সেই ম্যাচে বার বার আক্রমণে উঠেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা জিতেই মাঠ ছেড়েছিলাম। কোচিং জীবনে আমিও অসংখ্যবার এই রণকৌশল নিয়ে সফল হয়েছি।
কিবু নিজেও খুব ভাল জানেন, এই মরসুমে মোহনবাগানের রক্ষণ খুব একটা শক্তিশালী নয়। যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। এ দিনও ট্রাউয়ের দুই বিদেশি জোয়েল সানডে ও জোসেফ ওলালেয়েকে আটকাতে গিয়ে বার বার সমস্যায় পড়েছে ফ্রান মোরান্তে, ধনচন্দ্র সিংহেরা। সবুজ-মেরুন রক্ষণের ভুলেই ৩৪ মিনিটে গোল করে ব্যবধান কমায় সানডে। অবিশ্বাস্য ভাবে গোল নষ্ট করে জোসেপ, নওচা সিংহেরা। গোলরক্ষক শঙ্কর রায় দুর্দান্ত না খেললে কী হত বলা কঠিন। আসলে এই সময়টায় বেইতিয়াদের আক্রমণের ঝাঁঝ একটু কমে গিয়েছিল। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় ট্রাউয়ের ফুটবলারেরা।
মোহনবাগানের এই দলটার ফুটবলারদের সব চেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের বদলে ফেলার দক্ষতা। ওরা যখনই দেখল, ট্রাউয়ের আক্রমণের তেজ বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে খেলার ধরন বদলে ফেলল। অর্থাৎ, ফের আক্রমণে ঝাঁঝ বাড়িয়ে ট্রাউয়ের রক্ষণকে চাপে ফেলার রণনীতি। এই কারণেই ৬৯ মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে তুর্সুনভ বেরিয়ে যাওয়ার পরেও ট্রাউ কিছু করতে পারেনি। সংযুক্ত সময়কে ধরলে শেষ ৩৫ মিনিট দশ জনেও একই রকম ভাবে আধিপত্য বজায় রেখে খেলল মোহনবাগান। ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে নামা জামশিদ নাসিরির ছেলে কিয়ানকেও ভাল লাগল। ঠিক মতো গড়ে তুলতে পারলে অনেক দূর যাবে।
যে দলে এত বৈচিত্র, তাদের আটকাবে কে?
ট্রাউ: সায়ন রায়, দীনেশ সিংহ, ধনচন্দ্রম মিতেই, প্যাট্রিক উচে, দীপক দেবরানি, ওয়াহেংবাম লুয়াং, নেত্রজিৎ সিংহ, জেরার উইলিয়ামস, প্রেমজিৎ সিংহ (কৃষ্ণনন্দ সিংহ), ওলালেয়ে ও সানডে (নওচা সিংহ)।
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, ফ্রান মোরান্তে, লালরাম চুলোভা, ধনচন্দ্র সিংহ, জোসেবা বেইতিয়া, নংদোম্বা নওরেম (রোমারিয়ো জেসুরাজ), শেখ সাহিল (শিল্টন ডিসিলভা), ফ্রান গঞ্জালেস, কোমরন তুর্সুনভ, সুহের ভি পি (কিয়ান নাসিরি) ও পাপা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy