কে জানত, তলিয়ে যেতে যেতেও বার বার ব্যাট হাতে তাঁর প্রত্যাবর্তনের ইনিংসগুলোর মতোই ফিরে আসবেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন।
প্রশ্ন: হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা কত বড় মুহূর্ত?
মহম্মদ আজহারউদ্দিন: খুবই স্মরণীয় মুহূর্ত। গত তিন বছর ধরে হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থায় যা খুশি তাই চলছে। আমাদের রাজ্যে এখনও প্রতিভার অভাব নেই কিন্তু খুব বেশি ক্রিকেটার উঠে আসছে না। তার কারণ রাজ্য ক্রিকেট সংস্থায় দুর্নীতি এবং হেরাফেরি। সেগুলো বন্ধ করা দরকার বলে মনে হয়েছিল। তাই আমি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি খুশি যে, মানুষ আমার উপরে আস্থা রেখেছে।
প্র: কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে সাধারণ নির্বাচনে ভোটে জিতেছেন। ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট পদের লড়াইয়ে জিতলেন। তুলনা করলে কী বলবেন?
আজহার: দু’টো নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা। সাধারণ নির্বাচন অনেক বড় ব্যাপার। তবে সংস্থার নির্বাচনটাও আমি খুব মন দিয়ে লড়েছি। অনেকের কাছে গিয়ে বলেছি, আমি কী করতে চাই। কেন আসতে চাইছি। হায়দরাবাদ ক্রিকেটের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। তাই মানুষও মনে করেছে, বদল দরকার।
প্র: সেই দিনগুলো নিয়ে কী বলবেন? যখন কোথাও আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হত না? কতটা কঠিন ছিল?
আজহার: কত কঠিন ছিল, আন্দাজই করতে পারছেন। কী আর বলব! যাক গে, পেরিয়ে আসা সেই সব দিনগুলো নিয়ে আর বলতে চাই না। সামনের দিকে তাকাতে চাই। আমি হায়দরাবাদ ক্রিকেট, ভারতীয় ক্রিকেটের সেবা করতে চাই। সেই সুযোগটা যে পেয়েছি, তাতেই ধন্য।
প্র: হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থাকে কী ভাবে সাজানোর কথা ভাবছেন?
আজহার: আমি ক্রিকেটের প্রতি নজরটাকে সবার আগে ফেরাতে চাই। হায়দরাবাদে খেলাটাই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। বাকি সব স্বার্থ অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে হালফিলে। আমি সেই সংস্কৃতি পাল্টাতে চাই। ইতিমধ্যেই সভা ডেকে বলে দিয়েছি, ক্রিকেট সংস্থার কাজ ক্রিকেট খেলাটাকে তুলে ধরা। নতুন নতুন প্রতিভা গড়ে তোলা। আমাদের কাছে তাই প্রাধান্য পাবে ক্রিকেট। হায়দরাবাদের প্রত্যন্ত জায়গায় ক্রিকেটকে নিয়ে যেতে চাই। জেলার দিকে প্রচুর প্রতিভা রয়েছে। অথচ, কেউ কোনও উদ্যোগ নেয়নি জেলা থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার। আমি এবং আমার টিম সেটা করব। সব ক’টা জেলা হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থার অনুমোদনও পায়নি এখনও। প্রত্যেকটা জেলাকে সংস্থার এক ছাতার তলায় আনতে হবে।
প্র: হায়দরাবাদ থেকে এত সব ভাল ক্রিকেটার বেরিয়েছেন। যাঁদের কব্জির জাদুতে মুগ্ধ থেকেছে ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু আপনার এবং ভি ভি এস লক্ষ্মণের পরে বিশ্বমানের ক্রিকেটার বেরচ্ছে না কেন?
আজহার: বেরচ্ছে না তার কারণ রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা বলেই তো কিছু ছিল না। যেটা ছিল, সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি একটা সংস্থা। শেষ কয়েক বছরের কার্যকলাপ নিয়ে তদন্ত হয়েছে, আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি লেগে থাকত। সংস্থা যদি এত নোংরামিতে ডুবে থাকে, ক্রিকেটার তৈরি হবে কী করে! খেলার উন্নতি যারা ঘটাবে, তারাই তো ব্যস্ত অন্য ধান্দায়। সবার আগে সুস্থ পরিবেশ ফেরানো হবে আমার লক্ষ্য। দায়বদ্ধতা আনতে হবে কর্তাদের মধ্যে।
প্র: নতুন কোচ, ট্রেনার আনার কথা ভাবছেন? নিজে এত ভাল ফিল্ডার ছিলেন। ফিল্ডিং নিশ্চয়ই প্রাধান্য পাবে আপনার ক্রিকেট নীতিতে?
আজহার: কোচ, ট্রেনার নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে বৈঠক করব। তবে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ফিটনেস এবং ফিল্ডিংকে খুবই প্রাধান্য দেওয়া হবে। এই দু’টো দিক ছাড়া এখন ক্রিকেটে দাঁড়ানোই যাবে না। হায়দরাবাদে অনেক কাঁচা প্রতিভা আছে। রাজ্য জুড়ে অ্যাকাডেমি গড়ে তুলতে চাই। ওদের একটু ঘষামাজা করলেই অনেক ভাল ক্রিকেটার বেরতে পারে। বুচিবাবুর মতো টুর্নামেন্টকে ফের বাঁচিয়ে তুলতে চাই। এই টুর্নামেন্টগুলোই তো আমাদের নিউক্লিয়াস ছিল। এই সব টুর্নামেন্টে ভাল খেলে একটা সময় জাতীয় দলের জন্য নির্বাচিত হত ক্রিকেটারেরা। এখন সেগুলোই অবহেলায় ধুঁকছে। ক্রিকেটকে বিকশিত হতে দিতে হবে। শরীরের আসল অংশে যদি রোগ দেখা দেয়, তা হলে বাকি অংশেও তো সেটা ছড়িয়ে পড়বে। সেটা মেরামত করতেই সংস্থায় আসা। না পারলে নিজে থেকেই সরে যাব। তফাত গড়তে না পারলে পদ আঁকড়ে থেকে কী লাভ!
প্র: খেলোয়াড় জীবনে অনেক কর্তার সংস্পর্শে এসেছেন। আপনার প্রশাসনিক জীবনে তাঁদের মধ্যে কার প্রভাব বেশি দেখা যাবে?
আজহার: হায়দরাবাদ থেকেই পি আর মান সিংহ আছেন (কপিল দেবের ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের যিনি ম্যানেজার ছিলেন)। আমি খুবই শ্রদ্ধা করি ওঁকে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ওঁর সঙ্গে কথাও বলেছি। জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন। এন শ্রীনিবাসন রয়েছেন। প্রত্যেকে ভারতীয় ক্রিকেটের নামী প্রশাসক। ভারতের অধিনায়ক থাকার সময় রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ডালমিয়াজি কী ভাবে ঠান্ডা মাথায় আর শক্ত হাতে সব কিছু সামলাতেন, সেটা একটা চিরকালের শিক্ষা। নিজে প্রশাসক হয়ে আসায় সেই সব শিক্ষা, অভিজ্ঞতা খুব কাজে লাগবে।
প্র: রাজ সিংহের সেই বিখ্যাত মন্তব্য, ‘‘মিঞাঁ, কাপ্তান বনোগে?’’ এ বারও কি কেউ এসে বলেছিল ‘‘মিঞাঁ, প্রেসিডেন্ট বনোগে?’’
আজহার (হাসি): এ বারে কোনও রাজ ভাই আসেননি আমাকে এই কথাটা বলতে। তবে নিজের ভিতর থেকেই যেন একটা সাড়া পাচ্ছিলাম এগিয়ে যাওয়ার। মনে হয়েছিল, মাঠে নেমেই লড়াইটা করার দরকার। আমরা প্রচুর খেটেছিলাম। ফলটা দেখে হয়তো মনে হবে একপেশে (আজহার নির্বাচনে জেতেন ১৪৭-৭৩ ফলাফলে) ভোট হয়েছে কিন্তু মোটেও তা ছিল না। তবে জেতার পরেই আমি টিমকে বলেছি, সদস্যরা আমাদের উপরে আস্থা রেখেছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব সেই আস্থার মর্যাদা দেওয়া।
প্র: সিএবি থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, হায়দরাবাদ থেকে আপনি। তারকা ক্রিকেটাররা আসছেন প্রশাসনে। এটা কি খেলার জন্য ভাল লক্ষণ?
আজহার: সেই বিচারের ভার মানুষের হাতেই ছেড়ে দেব। আমাদের কাজই বলে দেবে, কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারলাম। তবে এটা বলতে পারি যে, খেলোয়াড় যদি প্রশাসক হয়, তার নজরটা বেশি করে খেলার উন্নতিসাধনের দিকেই থাকবে। কেউ ক্রিকেটার হিসেবে সফল হয়েছে বলেই প্রশাসক হয়েও দারুণ করবে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু একটা কথা বলেই দেওয়া যায় যে, সে ক্রিকেটকে অবজ্ঞা করবে না।
প্র: সৌরভ পুনর্নির্বাচিত। আপনার অধীনেই তাঁর রাজকীয় অভিষেক। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে কি কথা হল প্রাক্তন অধিনায়ক এবং লর্ডসের দুরন্ত অভিষেককারীর মধ্যে?
আজহার (হাসি): হ্যাঁ, অভিনন্দন বিনিময় তো হয়েইছে। তবে আমি সৌরভের অভিষেক টেস্টের ক্যাপ্টেন হলেও ক্রিকেট প্রশাসনে ও আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। পরামর্শ নিতে হলে সে দিনের ক্যাপ্টেনকেই নিতে হবে অভিষেকে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের থেকে। তবে আমি সাগ্রহে তাকিয়ে রয়েছি বোর্ড নির্বাচনে সৌরভের সঙ্গে ক্রিকেট ও ক্রিকেট প্রশাসন নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আরও একটা কথা বলতে চাই। কলকাতার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। ইডেন আর কলকাতার মানুষ কখনও খালি হাতে ফেরায়নি। সব সময় ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেট কেরিয়ারের কঠিনতম সন্ধিক্ষণে ইডেন আমাকে অগ্নিপরীক্ষায় উতরে দিয়েছে। আজ তাই কলকাতা এবং ইডেনের মানুষদের কাছে আবদার করব, প্রার্থনা করুন যেন ইডেনের সেই সেরা ফর্ম প্রশাসক হিসেবেও দেখাতে পারি।
প্র: ২৩ অক্টোবর বোর্ডের নির্বাচন। আপনার প্রস্তুতি কী?
আজহার: আমি চাই, দেশ জুড়ে ক্রিকেটের উপরেই সকলে নজর দিক। সব জায়গাতে যেন ক্রিকেটই প্রাধান্য পায়। ঠিক করেছি, এই মর্মেই বোর্ডের সভায় বলব। এখনই এর বেশি কিছু ভাবিনি। সব রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল হয়ে গেলে বোর্ড নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হবে।
প্র: বর্তমান ভারতীয় দল নিয়ে কী বলবেন? বোর্ডের সভায় এ নিয়ে আপনার কোনও বক্তব্য থাকবে?
আজহার: এখনও জানি না, বোর্ডের সভায় কী নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব, ভারতীয় দল ভালই খেলছে। দেখতে হবে আরও ভাল কী করে করা যায়। দারুণ সব ক্রিকেটার রয়েছে আমাদের। বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মা, অজিঙ্ক রাহানে। আমাদের বোলিং আক্রমণ বিশ্বের অন্যতম সেরা। আমি ধারাবাহিকতার পক্ষে, তাই খুব বেশি খোঁচাখুঁচি করার পক্ষপাতী নই।
প্র: নিরানব্বই টেস্টে থেমে থাকা। নানা বিচার পর্বের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। ক্রিকেট বোর্ড-সহ বহু সংস্থার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো দেখা যে, দ্বার রুদ্ধ আপনার জন্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থায় ঢুকে কী মনে হচ্ছিল?
আজহার: উপরের দিকে তাকিয়ে একটাই কথা বলছিলাম। ঈশ্বর, তুমি সত্যিই করুণাময়! আরও একটা সুযোগ দিলে! ফিরে তাকিয়ে কখনও আমিও মনে করতে পারব, নিরানব্বইয়েই থেমে যাইনি। ফের ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছিলাম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy