Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
খেতাবি ম্যাচ ঘিরে গুরুতর অভিযোগ, ফেডারেশন নীরব ছিল কেন

মিনার্ভা নিয়ে কমিশনারের চিঠিতে প্রশ্ন

খেতাবের নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও নজিরবিহীন বিতর্কে ঢুকে পড়ল আই লিগ। এমনই প্রবল আকার নিয়ে ফেলেছে সেই বিতর্ক যে, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে খেতাবের সত্যতা নিয়ে। 

গত শনিবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁবুতে দলের জয় দেখার পরেও হতাশ সমর্থকেরা। ফাইল চিত্র

গত শনিবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁবুতে দলের জয় দেখার পরেও হতাশ সমর্থকেরা। ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৯ ০৩:১০
Share: Save:

খেতাবের নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও নজিরবিহীন বিতর্কে ঢুকে পড়ল আই লিগ। এমনই প্রবল আকার নিয়ে ফেলেছে সেই বিতর্ক যে, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে খেতাবের সত্যতা নিয়ে।

চেন্নাই বনাম মিনার্ভা ম্যাচের কমিশনার সর্বভারতীয় ফেডারেশনকে লিখেছেন যে, মিনার্ভার সেই ম্যাচে সৎ ভাবে খেলেছে কি না তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে। ম্যাচ কমিশনার বালাসুব্রমণ্যম চিঠিতে লিখেছেন, ম্যাচটি সঠিক ‘স্পিরিটে’ খেলা হয়নি। জানা গিয়েছে যে, ‘রেফারি অ্যাসেসর’ (রেফারিদের ম্যাচ পরিচালনা তদারকির জন্য যিনি থাকেন) একই সন্দেহ প্রকাশ করে রিপোর্ট দিয়েছেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে (এআইএফএফ)।

ম্যাচ কমিশনার তাঁর চিঠিতে বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘ম্যাচের ৫৩ মিনিটে ১৭ নম্বর জার্সিধারী ফুটবলার গোল করার পরেও তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। ওই ফুটবলার দারুণ খেলছিলেন। তার পরেও যে ভাবে তাঁকে তুলে নেওয়া হল, সেটা ছিল বেশ অবাক করে দেওয়ার মতোই ঘটনা।’’

আই লিগের শেষ ম্যাচে এক দিকে গোকুলমের বিরুদ্ধে খেলছিল ইস্টবেঙ্গল। অন্য দিকে চেন্নাই খেলছিল মিনার্ভার সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গল এবং চেন্নাই দুই দলই ছিল খেতাবের দৌড়ে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, ইস্টবেঙ্গল যদি জিতত আর চেন্নাই হারত বা ড্র করত, তা হলে লাল-হলুদ দলই চ্যাম্পিয়ন হত। আর দুই দলই জিতলে সেরা হত চেন্নাই। শেষ পর্যন্ত দুই দলই জেতায় চেন্নাই নতুন দল হিসেবে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়।

কিন্তু চেন্নাই বনাম মিনার্ভা ম্যাচ আদৌ সঠিক ভাবে খেলা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দেয়। নানা অভিযোগ, গুঞ্জন ভেসে আসতে থাকে যে, মিনার্ভা না কি সৎ ভাবে ম্যাচটি খেলেনি। বিশেষ করে একটি ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ইস্টবেঙ্গল ভক্তদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি, ম্যাচ কমিশনার পর্যন্ত তাঁর চিঠিতে এই পেনাল্টি শট মারা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ম্যাচ কমিশনার লিখেছেন, ম্যাচের ৫৬তম মিনিটে চেন্নাইয়ের বিদেশি ফুটবলার পেদ্রো মানজ়ি পেনাল্টি মারার আগে হাত দিয়ে বিস্ময়কর ভাবে নির্দেশ করছেন কোন দিকে তিনি শট মারবেন। যে দিকে পেদ্রো হাত দেখান, মিনার্ভার গোলকিপার ঠিক তার উল্টো দিকে ঝাঁপান। ফাঁকা গোলে বল ঢুকে যায়। ম্যাচ কমিশনার আরও লিখেছেন, ‘‘পঞ্জাবের দল মিনার্ভা তাদের সেরা দুই বিদেশিকেই তুলে নিয়েছিল। ১০ নম্বর এবং ১৭ নম্বর জার্সিধারী দুই বিদেশি ফুটবলার রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ডাগআউটে ফিরে আসার পরে।’’ আরও সাংঘাতিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে কমিশনারের চিঠিতে। লেখা হয়েছে, যে রকম শান্ত এবং নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে মিনার্ভা মালিক বসে তাঁর দলের হার দেখলেন, সেটাও বিরল। ম্যাচ কমিশনারের চিঠির বয়ান অনুযায়ী, ‘‘গোটা আই লিগে নিজের দলের ম্যাচের সময় মিনার্ভার মালিক যে ভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন, ঠিক তার উল্টো ছবিই ধরা পড়েছিল চেন্নাই ম্যাচে। তিনি একটু বেশি শান্ত মেজাজেই ছিলেন।’’ ফেডারেশনকে পাঠানো চিঠিতে ওই ম্যাচের এমনই বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে ম্যাচ কমিশনার জানিয়েছেন, ‘‘আমার এবং রেফারি অ্যাসেসরের মনে হয়েছে, মিনার্ভা-চেন্নাই ম্যাচটি সততার সঙ্গে খেলা হয়নি।’’

যদিও সোমবার আত্মপক্ষ সমর্থন করে মিনার্ভা মালিক রঞ্জিত বাজাজ টুইট করেছেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তাদের মাঠে আমরা বিদেশি ফুটবলারকে তুলে নিয়ে ১৭ বছরের ভারতীয় ফুটবলার মাকান চোটেকে নামিয়েছিলাম। ও-ই ম্যাচে গোল করেছিল এবং ইস্টবেঙ্গল হেরে গিয়েছিল। তখন তো কেউ একটি কথাও বলেননি। আমরা এ বার আই লিগের আটটি ম্যাচে বিদেশিদের তুলে নিয়ে পরিবর্ত হিসেবে ভারতীয় ফুটবলারদের খেলিয়েছি।’’

চেন্নাই বনাম মিনার্ভা ম্যাচ নিয়ে গুঞ্জন, অভিযোগ, অনুযোগ চলছিল। কিন্তু এ বার জানাজানি হয়ে গিয়েছে যে, ওই ম্যাচ নিয়ে কমিশনার এবং অ্যাসেসর পর্যন্ত সন্দেহমুক্ত তো ছিলেনই না, বরং তাঁদের মনেও জোরাল প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল মিনার্ভার সততা নিয়ে। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে ম্যাচ ছাড়াছাড়ির ঘটনা এর আগে অনেক রয়েছে। ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু আই লিগের খেতাবের নিষ্পত্তির দিন এ ভাবে একটি দলের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ম্যাচ কমিশনার এবং রেফারি অ্যাসেসরের রিপোর্ট জমা পড়ার ঘটনা বিরল।

সব চেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের মনোভাব নিয়ে। শনিবার রাতেই জমা পড়ে গিয়েছিল ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্ট। সাধারণত প্রথা হচ্ছে, ম্যাচ সম্পর্কে এই ধরনের গুরুতর প্রশ্ন কমিশনারের রিপোর্টে থাকলে, দ্রুত তা নিয়ে পদক্ষেপ করবে ফেডারেশন। সঙ্গে সঙ্গে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে সেই রিপোর্ট পাঠানোটাই প্রথা। এ ক্ষেত্রে মঙ্গলবার সন্ধে পর্যন্ত সেই কাজ করা হয়নি। সোমবারেও এআইএফএফ কর্তারা কমিশনার বা অ্যাসেসরের রিপোর্ট নিয়ে

নীরব ছিলেন।

তবে সেখানেই শেষ নয়। মিনার্ভা বনাম চেন্নাই ম্যাচ নিয়ে যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা জানার পরেও ফেডারেশন কর্তারা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। পরে তদন্তের কথা বলা হলেও শোনা যাচ্ছে আরও একটি সম্ভাবনার কথা। রেফারি অ্যাসেসর এবং ওই ম্যাচ কমিশনারকে পরবর্তী সময়ে ম্যাচ পরিচালনার বাইরেও রাখা হতে পারে। সাহসী হওয়ার ‘পুরস্কার’!

ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কমিশনারের চিঠির ভিত্তিতে তদন্ত করার উদ্যোগও চোখে পড়ছিল না। একটি সংবাদপত্রকে ফেডারেশন সচিব কুশল দাস সোমবারে বলেছিলেন, ফেডারেশনের ‘ইন্টিগ্রিটি অফিসার’ জাভেদ সিরাজ মাঠে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর চোখে ‘অন্যায়’ বা ‘অসৎ’ কিছু না কি ধরা পড়েনি। আর আই লিগের সিইও সুনন্দ ধর এ দিন আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘এএফসি থেকে আমরা ছাড়পত্র পেয়েছি, ম্যাচ ঠিক ভাবেই খেলা হয়েছে। ম্যাচ কমিশনারের চিঠি আমরা পেয়েছি। তা ইন্টিগ্রিটি অফিসারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ কিন্তু শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে কেন কমিশনারের রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে না? তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব কি সেই কমিটির নয়? সুনন্দ উত্তরে বললেন, ‘‘ইন্টিগ্রিটি অফিসারের তদন্ত শেষ হলে সেই রিপোর্ট আমরা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেব।’’ যদিও আই লিগ বা আইএসএলের ক্ষেত্রে বহু ম্যাচের ঘটনাই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে তদন্তের জন্য পাঠানোর উদাহরণ রয়েছে। ফেডারেশনের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান এবং ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন আইনি পরামর্শদাতা ঊষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার বললেন, ‘‘সাধারণত ম্যাচ কমিশনার বা রেফারি রিপোর্টে অভিযোগমূলক কিছু থাকলে সঙ্গে সঙ্গে সেই রিপোর্ট শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে পাঠানোটাই প্রথা।’’ ঊষানাথ বাবুকে জিজ্ঞাসা করা হল, চেন্নাই-মিনার্ভা নিয়ে ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্ট কি আপনারা হাতে পেয়েছেন? তাঁর জবাব, ‘‘না, এই রিপোর্ট আমরা এখনও হাতে পাইনি।’’ এ ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া কেন মানা হচ্ছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

কারও কারও মনে হচ্ছে, এমন গুরুতর অভিযোগ যখন উঠেছে এবং তা সরকারি ভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে এমনকি ম্যাচ কমিশনারের চিঠিতে, তার পরেও কী করে এত দায়সারা মনোভাব নিতে পারে ফেডারেশন? ক্রিকেটে গড়াপেটার অভিযোগের সময়ে সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ বড় আকার ধারণ করে সিবিআই তদন্ত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কারও কারও পরামর্শ, পুলিশকে তদন্ত করতে বলা হোক সে দিন ম্যাচে কী ঘটেছিল। তাতে সন্তুষ্ট না হওয়া গেলে সিবিআইকেও ডাকা যেতে পারে।

শেষ হয়েও আই লিগের ‘শেষ ম্যাচ’ মনে হচ্ছে এখনও বাকি!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE