বিদায় বন্ধু
এত দিন একই মাঠে একে অপরকে বিরক্ত না করে একই সঙ্গে দু’টো সিরিজ চলছিল।
ভারত-শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজ। কুমার সঙ্গকারার বিদায়ী অভ্যর্থনা সিরিজ!
এত দিন যদি এটা অদৃশ্য থাকে, সোমবার এক বছর এক মাস বাদে ভারত প্রথম টেস্ট ম্যাচ জিতে ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রকাশ্যে চলে এল। দু’টো মঞ্চ তৈরি হয়ে গেল ওভাল প্যাভিলিয়নের সামনে। প্রথমটায় টেস্ট ঘিরে যাবতীয় পুরস্কার-অর্পণ আর বক্তব্য রাখা। পরেরটায় শুধু তো ক্রিকেটমহল নয়, লুকিয়ে ছিল একটা জাতির গত দু’সপ্তাহের তুঙ্গস্পর্শী আবেগ। ওখানেই তো আনুষ্ঠানিক বিদায়ী সম্মান জানানো হবে সঙ্গকারাকে।
এত দিন সমান্তরাল ভাবে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁচিয়ে চলছিল এবং সোমবার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ভারতের ২৭৮ রানে জয় আর সঙ্গার পনেরো বছরের ক্রিকেট জীবনের সমাপ্তি দু’টোই পালিত হল একই সঙ্গে।
সচিন তেন্ডুলকরের ক্রিকেটীয় সূর্যাস্তের দিনে আবেগ আরও ঊর্ধ্বগামী ছিল। স্টিভ ওয় সিডনি মাঠে অবসরে চলে গিয়েছিলেন আরও রংচং, আরও উত্তেজনা, আরও বাহারের মধ্যে। কিন্তু উদাসী গাম্ভীর্যের ব্যাপ্তিতে সঙ্গার দেশের হয়ে শেষ বিকেল বাকিদেরও ছাপিয়ে গেল! ভারত যেমন শেষ পর্যন্ত শেষ দিনে আট উইকেট ফেলতে পারবেই নিশ্চিন্ত বিশ্বাস করা যায়নি। তেমনই ভাবা যায়নি সঙ্গার ক্রিকেট মাঠে শেষ প্রহর এমন ভাবগম্ভীর চিত্রনাট্য অতর্কিতে আমদানি করবে! মনে হয়েছিল তাঁকে ঘিরে যা হওয়ার রোববারই হয়ে গিয়েছে। সোমবারের জন্য কয়েকশো গ্রাম ছাই পড়ে থাকল। এবং কী ভুলই না ভাবা হয়েছিল!
ঠিক যেমন মনে করা হয়েছিল গলের মতো এখানেও শেষ দিনে ভারতের নার্ভ ফেল করতে পারে। আজ নতুন দিন। নতুন স্বপ্ন। নতুন ফসল যেন প্রথম বলেই বুঝিয়ে ছাড়ল কোহলির ভারত। জয়ের পথে এক নম্বর কাঁটা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজ অফস্টাম্পের বাইরে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বল ছুঁয়েছেন কি না কানায় লেগে প্রথম স্লিপের দিকে কঠিন এবং নিচু ক্যাচ যাচ্ছে। বিকল্প কিপার লোকেশ রাহুল ডান দিকে ঝাঁপিয়ে যা ক্যাচ তুললেন তা ঋদ্ধি ধরলেও কঠিন ক্যাচের আখ্যাই পেত। তখনও ভাবা সম্ভব ছিল না শ্রীলঙ্কার শেষ আট উইকেট বাষট্টি রানে চলে যাবে। কিন্তু গোটা দিনের ট্রেন্ডটা প্রথম বলেই ভেসে উঠেছিল।
কিছু পরে তামিল ইউনিয়ন ক্লাবের প্যাভিলিয়নে ঢুকতে গিয়ে দেখি ব্যাপক নিরাপত্তার কড়াকড়ি চলছে। এত দিন মাঠে ঢোকার সময় কেউ ব্যাগ অবধি খুলে দেখেনি। আজ হঠাৎ মার্কিনি এয়ারপোর্টগুলোর মতো তীক্ষ্ণ শারীরিক তল্লাশি চালু হল, কী ব্যাপার?
জানা গেল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট আসছেন। সঙ্গে দেশের পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। অতিথিদের জন্য একটা বিশাল খাঁচা করা হয়েছিল। একটু পরে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পাশে আরও একটা পরিচিত মুখ। ইনি সদ্য নির্বাচন জিতে আরও একবার সাংসদ হলেন। শোনা যাচ্ছে শিগগিরই মন্ত্রীত্ব পাবেন। অর্জুন রণতুঙ্গা। এঁদের উপস্থিতিতে মাঠের মেজাজটাই তখন বদলে গিয়েছে। কী বাইরে, কী ভেতরে!
ভেতরে বদলেছে বলতে শ্রীলঙ্কা যেটুকু লড়াই দিচ্ছিল কালকে, এ দিন শুরু থেকে তা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত। ম্যাচের কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। প্রেসবক্স প্রান্ত থেকে বল করছিলেন বলে ঠিক পিছন থেকে আরও বুঝতে সুবিধে হচ্ছিল কী ভাবে গতির হেরফের করে যাচ্ছেন। ব্যাটসম্যান সুইপ করতে চাইছে দেখলে অফস্টাম্পের বাইরে থেকে ফাস্টিশ অফব্রেক। কখনও তাঁর ক্যারম বল। এই নিয়ে বারো বার পাঁচ উইকেট হয়ে গেল তাঁর। যে কৃতিত্ব কুম্বলে-হরভজন ছাড়া কারও নেই। এই বারো বারে নয় বার টিম জিতেছে এমন স্ট্যাটস থেকে আরওই পরিষ্কার কোহলির জমানায় তিনিই যে কুম্বলে! চলতি সিরিজে ১৭ উইকেট হয়ে গেল অশ্বিনের। যে উইকেটসংখ্যা আজ পর্যন্ত ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজে কোনও ভারতীয় বোলারের নেই। অশ্বিনকে না দিয়ে যে ম্যান অব দ্য ম্যাচ লোকেশ রাহুলকে বাছা হল, জয়ের আনন্দেও মূর্তিমান এক অবিচার!
সতীর্থদের আবেগ।
সঙ্গকারা নিজে তো বিদায়ী ভাষণে এমনকী প্রেস কনফারেন্সে এসেও অশ্বিনের কাছে ব্যক্তিগত হারের কথাটা তুললেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ব্র্যাডম্যান যেমন ওভালের শেষ ইনিংসে চোখের জলে বল দেখতে পাননি বলে শোনা যায়, আপনাকেও কি আবেগ খেয়ে ফেলল? সঙ্গা মানতে রাজি নন, ‘‘বাকিদের তো খেলে দিয়েছিলাম। অশ্বিনকে পারলাম না।’’ শুনলাম কাল তিনি আউট হওয়ামাত্র দোতলার সঙ্গকারা বক্সে বসা তাঁর চিরজীবনের ক্রিকেটীয় পথিকৃত নিজের বাবা ক্ষুব্ধ ভাবে বলে ওঠেন, ‘‘ব্যাকফুট খেলার বলটা ফরোয়ার্ড খেলল।’’
সচিনের যেমন অজিত, সঙ্গার তেমনই বাবা স্বর্ণকুমার। পেশায় আইনজীবী এই ভদ্রলোককে শেষ ম্যাচে উপস্থিত দেখে সঙ্গা আজ বক্তব্য পেশের সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি, দু’দেশের ক্রিকেটারদের ভিড়ের মধ্যেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। সচিন সে দিন একটা নোট আগে থেকেই পকেটে রেখে দিয়েছিলেন যাতে কাউকে মিস না করেন। সঙ্গা তা করেননি। না দেখেই পরপর নাম বললেন। কিন্তু পরিবার আর বাবা-মা বলতে গিয়ে এমন ভেঙে পড়লেন যে বউয়ের কথা বলা হল না তাঁর। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে অনুতাপও করলেন যে এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রীর নামটাই বাদ পড়ে গেল। তখনও অনেকের বিস্ময় কাটছে না। চিরসংযত সঙ্গাকে কখনও কেউ জনসমক্ষে এমন বেআব্রু দেখেনি।
কিন্তু বেআব্রু তিনি নিজের কাছে হয়ে আছেন শেষ ইনিংসে রান না পাওয়া থেকেও। কাল রাত্তিরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হোটেলের ঘরে বসে বলেছেন, ‘‘গত এক মাস টানা ইংল্যান্ডে খেলছিলাম বলেই কি ভুলটা হল? ওখানে বল দেরিতে আসছে। এই পাটা উইকেটে বল আগে ব্যাটে আসে। তাই মনে হয় হঠাৎ করে স্পিডটা সামলাতে পারলাম না।’’ শেষ ইনিংসে কী লক্ষ্য ছিল সঙ্গার? সেটাও বন্ধুকে বলেছেন, ‘‘নাথিং লেস দ্যান আ হান্ড্রেড।’’
স্ত্রীকে চুম্বন।
বিদায়ী অনুষ্ঠানে যখন তাঁকে ইংল্যান্ডে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত মনোনীত হওয়ার প্রস্তাব দিলেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট, সবাই অভিভূত। আজ পর্যন্ত কোনও ক্রীড়াবিদের অবসরলগ্নে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে আসেননি। তার ওপর এ রকম প্রস্তাব। একটু আগে মাহেলা আর মুরলী মাঠে ঢুকে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন। কোহলি নিজের জার্সি উপহার দিয়ে গিয়েছেন। আবেগের হিমশৈলের এমন বড় বড় সব চাঁই যে তিনি আত্মরক্ষা করবেন কী করে? সুনীল গাওস্কর এরই মধ্যে বলে গিয়েছেন, ‘‘সঙ্গা যবে থেকে তুমি শ্রীলঙ্কান ড্রেসিংরুমে এসেছ, ভেতরে চলা মিউজিক বদলে গিয়েছে কিন্তু তোমার ব্যাটে লেগে বল বাউন্ডারিতে ছিটকে যাওয়ার মিউজিক কিছুতেই বদলাল না। ধন্য তোমার ক্রিকেটারজীবন।’’ সঙ্গা আবেগে আরও আপ্লুত হয়ে পড়লেন। এর পর গাওস্কর স্বভাবসিদ্ধ মেজাজে একটা খাম তাঁর হাতে তুলে দিলেন, ‘‘এই নাও। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের ক্লাব মেম্বারশিপ।’’ সবাই হেসে উঠল।
কিন্তু যাবতীয় আবেগের মধ্যেও সঙ্গার ক্রিকেটীয় মননের রক্তাক্ত হওয়া যে থামেনি সাংবাদিক সম্মেলনে একাধিক বার বোঝা গেল। অমিত মিশ্র জয়সূচক উইকেট-সহ দ্বিতীয় ইনিংসে মোট তিনটে তুললেন। চণ্ডীমলের ডেলিভারিটা তো লেগস্পিনারের স্বপ্নের বলের মতো। লেগস্টাম্পের বাইরে থেকে টার্ন নিয়ে সুইপকারী ব্যাটসম্যানের লেগস্টাম্প ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু বাকি থেকে যাওয়া এসএসসি টেস্টে অমিত মিশ্র কখনওই শ্রীলঙ্কার দুর্ভাবনা নন। আর সেটা সঙ্গার কথায় বারবার বেরিয়ে আসছিল।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির শুভেচ্ছা। রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও (মাঝখানে)।
সঙ্গার খেদ বরাবর যেমন তিনি শ্রীলঙ্কার বিপদতারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, বিদায়বেলায় পারলেন না। সিরিজে অশ্বিনের ওঝা হওয়ার কথা ছিল তাঁর। উল্টে শিকার হয়ে গেলেন। বাকি টেস্টে বিপন্ন ব্যাটিং লাইনআপটা অশ্বিনের সামনেই পড়ে থাকল। কে না জানে কুমার সঙ্গকারা কখনও টিমমেটদের কারও জন্য কোনও কাজ ফেলে আসেননি। ক্রিকেট-অদৃষ্ট বিদায়বেলাতেই যেন সেই কবচ-কুণ্ডল কেড়ে নিল। তাঁর চোখের জলে আজ শুধু তো চলে যাওয়ার দুঃখ নয় অসহায়তার যন্ত্রণাও মিশে থাকতে পারে যে আমি পারলাম না।
ওই আবেগপ্রবণ বিশাল বিদায়ী জমায়েত শেষ হতে না হতেই রণতুঙ্গার কাছে কোহলিকে নিয়ে এলেন রবি শাস্ত্রী। এই উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্যাপ্টেন যদি তাঁর অধিনায়ককে কোনও টিপস দেন। ভারতের সিরিজ জেতার পরীক্ষা তো এখনও বাকি। ভিড়ে কী কথা হল, বুঝলাম না। তবে কোহলি হাতে ম্যাচ জয়ের যে বলটা রেখেছিলেন সেটাই নাচাতে নাচাতে ড্রেসিংরুম ফিরে গেলেন। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট জিতেছেন তা-ও ভারতের সর্বকালের অন্যতম বড় ব্যবধানে। কিন্তু কাজ তো এখনও বাকি। শুক্রবার নতুন টেস্ট শুরু।
কোহলিকে দেখে খুব অন্যমনস্ক, উদাসীন লাগল। বারবার সঙ্গকারার কথা বলছিলেন। মনে হচ্ছিল এই সমাবেশে দাঁড়িয়ে হয়তো নিজেকে বলছিলেন, ধন্য এমন বিদায়। আমার শেষ দিনেও যেন এ রকমই ভালবাসা থাকে।
বললাম না, সঙ্গার চোখের জল আর বাকি সিরিজ এখন আলাদা করা সম্ভব নয়। একটা আর একটায় মিলেমিশে এমন একাকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy