আরও বেশি ফিট হয়ে ওঠার লক্ষ্যে ঝুলন। ফাইল ছবি।
চাকদার গলি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রাজপথ। ১৭ বছরের ক্রিকেট-সফর বাড়িয়েছে অভিজ্ঞতা। শাণিত করেছে প্রতি মুহূর্তে। এবং একেবারেই অবাক করার নয় যে, বছরের পর বছর নতুন বলে আক্রমণ শুরুর ধকল সত্ত্বেও অটুট রয়েছে ভিতরের খিদে। নতুন মরসুম শুরুর আগে ঝুলন গোস্বামীর গলাতেই যা ধরা পড়ছে। পারলে এখনই যেন রানআপ থেকে দৌড় শুরু করবেন!
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজ শুরু হচ্ছে ৯ অক্টোবর। তিন ম্যাচের সিরিজের পর রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। এখন আর টি-টোয়েন্টি খেলেন না। নতুনদের সুযোগ করে দেওয়ার কথা ভেবে নিয়েছেন অবসর। তাই ৫০ ওভারের ফরম্যাটের জন্য নিজেকে তৈরি রাখছেন। দু’বছর পরের বিশ্বকাপের কথা এখনই মাথায় আনতে চাইছেন না। বরং একটা একটা করে সিরিজের দিকে তাকাচ্ছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে সোজাসুজি বললেন, “না, সে রকম কোনও টার্গেট সামনে রেখে কোনওদিন খেলিনি, রাখবও না। প্রত্যেকটা সিরিজকে গুরুত্ব দিয়েই বরাবর খেলেছি। প্রত্যেক সিরিজে ভাল খেলাকেই অগ্রাধিকার দিই। বিশ্বকাপ তাই মাথায় নেই। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ জেতার ব্যাপারেই মন দিচ্ছি। হোম সিরিজে বাড়তি উত্তেজনা থাকে সব সময়।”
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ৩৬ পূর্ণ হবে ঝুলন গোস্বামীর। বয়স যাতে নিছক সংখ্যাতেই থেমে থাকে, রিফ্লেক্স ও স্কিলে থাবা বসাতে না পারে, সঙ্গী হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। জিমে খাটাখাটনি এবং অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ডায়েট। মোবাইলে দেওয়া রয়েছে অ্যালার্ট। কখন কী খাবেন, যাতে ভুলে না যান। চিরতরে বাদও পড়েছে অনেক কিছু। ডানহাতি পেসারের কথায়, “বয়স বাড়ছে। এটাই চ্যালেঞ্জ যে আরও বেশি ফিট থাকতে হবে। যত খেলতে চাইব, তত শরীরকে যত্ন করতে হবে। রিকভারি টাইম ছোট হয়ে যায় বলে শুধু ট্রেনিং নয়, ডায়েটের উপর ফোকাস রাখতে হয়। যখন কম বয়স ছিল, তখন যা পেতাম খেয়ে নিতাম। কোনও বাধা ছিল না। এখন ১০ বার ভাবি, কোনটা উপকার করবে, কোনটা করবে না। কোনটা পরের দিন সকালে অসুবিধায় ফেলবে, কোনটা ফেলবে না। গত দুই বছরে অনেক বদলে ফেলেছি নিজেকে। প্রোটিন-আয়রন-ম্যাগনেসিয়াম কত লাগবে, সেটা সকাল থেকে বিকেলে রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছি মোবাইলে।”
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ সিরিজ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিলেন ধোনি!
আরও পড়ুন: সিরিজ জিততে দলে কি এক পরিবর্তন? দেখে নিন ডি’ ককদের বিরুদ্ধে কোহালিদের সম্ভাব্য একাদশ
ঝুলন জানেন, ত্যাগ না করলে কিছু মেলে না। আর ক্রিকেটারকে তো পছন্দের অনেক কিছুকেই ছেঁটে ফেলতে হয়। তা সে বাঙালির সেরা উত্সবের সময় বাইরে থাকাই হোক বা লুচি-মিষ্টিকে জীবন থেকে বাদ দেওয়াই হোক। বিরিয়ানির অমোঘ আকর্ষণকেও ঝেড়ে ফেলেছেন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে। আর এ ভাবেই হেলায় অবসর নিয়েছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। বললেন, “মনে হয়েছিল বয়স বাড়ছে, চোট পাচ্ছি ঘনঘন। সুস্থ হতে সময়ও লাগছিল। নতুনদের জায়গা আটকে রাখতে চাইনি। ওদেরও তো সুযোগ দিতে হবে আন্তর্জাতিক আসরে মানিয়ে নেওয়ার। তবেই তো আমি ছাড়ার পর যে আসবে সে এই চাপের সঙ্গে পরিচিত থাকবে। মহিলা ক্রিকেট কী করে এগোবে, এটা আমি ভাবি।”
ক্রিকেটের চরিত্র ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বদলাচ্ছে বোলারের ভূমিকাও। অবশ্য ঝুলন এখনও নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছেন। এখনও তিনিই দলের পয়লা নম্বর স্ট্রাইক বোলার। আর সেই দায়িত্ব পালন করাই মোটিভেশন। বললেন, “আগেও তিন স্পেলে বল করতাম। এখনও তিন স্পেল ধরাই আছে। পাওয়ারপ্লের সময়ে পাঁচ ওভার। মাঝখানে তিন ওভার। আর শেষে দুই ওভার। প্রতিটাই আলাদা আলাদা চ্যালেঞ্জ। সেই মতো পরিকল্পনা করি। এখনও ম্যাচের সবচেয়ে কঠিন সময়ে বল হাতে দৌড়ে আসি। চাপের মধ্যে সেরাটা দেওয়া এখনও উপভোগ করি। সিনিয়র হিসেবে বাড়তি দায়িত্বও থাকে। দেখুন, এই পর্যায়ে ট্যালেন্ট সবারই থাকে। আসল হল, চাপের সময় কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে সেটা সামলাতে পারছে। সেটাই তফাত জুনিয়রদের সঙ্গে। খারাপ দিন আসতেই পারে। কিন্তু তার থেকেও বেরিয়ে আসতে হয়।”
ডেথ ওভারে ইয়র্কারই এখনও সেরা অস্ত্র বলে মানেন ঝুলন। ফাইল ছবি।
আধুনিক পেসারের হাতে এখন অনেক বৈচিত্র। স্লোয়ার বাউন্সার, নাকল বল। ঝুলন অবশ্য ভরসা রাখছেন চিরকালের ইয়র্কারে। তাঁর যুক্তি, “আগে আমরা ডেথ ওভারে ভেঙ্কটেশ প্রসাদের মতো লেগকাটার করার চেষ্টায় থাকতাম। তখন মনে হতো এটা রপ্ত করতে হবে। এখন তো অনেক বৈচিত্র এসেছে। নাকল বল নতুন বলেও করা হচ্ছে। স্লোয়ার বাউন্সার এসেছে, ব্যাক অফ দ্য হ্যান্ড ডেলিভারি এসেছে। কিন্তু বেসিকস পাল্টায়নি। সেটা এখনও একই রকম রয়েছে। ডেথ ওভারে আমার মতে ইয়র্কারের বিকল্প নেই। ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার ঠিকঠাক অফস্টাম্পে ফিনিশ করতে পারলে মারা কঠিন। অন্য বৈচিত্র ব্যাটসম্যানের মনে সংশয় তৈরি করবে। কিন্তু পুরনো বলে ইয়র্কারই উইকেট দেবে। তবে সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু ইয়র্কারে মার খেয়ে যেতে হয়। তার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম দরকার। তবেই নিখুঁত হবে ইয়র্কার।”
কেরিয়ারে টেস্টের সংখ্যা মাত্র দশ। আক্ষেপ থাকছেই। সবাই তো সব পায় না, নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়া। কিন্তু হালফিল মহিলাদের ক্রিকেটেও এসেছে জোয়ার। বিগ ব্যাশ লিগ বা কিয়া সুপার লিগে খেলছেন স্মৃতি মন্ধানারা। বিশ্বের অন্যত্র টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে ইচ্ছা করে না? ঝুলন অকপট, “প্রস্তাব এসেছিল তো। কিন্তু বাংলার হয়ে খেলার কথা ভেবে বিগ ব্যাশ লিগে খেলিনি। যে বছর থেকে শুরু হয়েছে মহিলাদের বিগ ব্যাশ, তখন থেকেই যোগাযোগ করেছিল দলগুলো। কিন্তু আমাদের এখানে ক্রিকেট মরসুমের সময়ই তো চলে বিগ ব্যাশ। বাংলার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে, বাংলা ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা তাগিদও রয়েছে।” বিগ ব্যাশে মেলবোর্ন স্টারস, সিডনি সিক্সার্স, পার্থ স্কর্চার্সের প্রস্তাবে তাই সাড়া দেননি। কিয়া সুপার লিগেও তাই ছেড়ে দিয়েছেন ওয়েস্টার্ন স্টর্মের প্রস্তাব।
না, আফশোস নেই। ঝুলনের দাবি, “বেরিয়ে যাওয়া মুশকিল ছিল। বাংলার মেয়েদের গাইড করতে চেয়েছিলাম। এখন বাংলা তিন ফরম্যাটে চ্যাম্পিয়ন, এটাই আমার আনন্দ। হ্যাঁ, আর্থিক ভাবে হয়তো উপকৃত হতে পারতাম, আন্তর্জাতিক আসরের অভিজ্ঞতাও বাড়ত। নতুন কালচার শিখতে পারতাম। তবে আমি ও ভাবে ভাবতে চাইনি।” ভবিষ্যতেও কি খেলবেন না কখনও? সোজাসাপ্টা জবাব, “না, আর তো টি-টোয়েন্টি খেলি না। তাই খেলার প্রশ্নই নেই। এই ফরম্যাটের প্রতি মোহও নেই। জীবনে আসল মোহ ছিল দেশের হয়ে খেলা। সেটা যখন এখনও খেলে চলেছি, দুঃখ নেই। এক জীবনে সবাই সব কিছু পায় না।”
বিশ্বকাপও তো নেই। সেটাও কি না-পাওয়া হয়েই থেকে যাবে? ঝুলন ভাবতে চান না। মহিলাদের ওয়ানডে ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক যেমন নিজের উইকেট সংখ্যাই মাথায় রাখেন না। নিছক বল নয়, ঝুলনের হাতে যে মহিলা ক্রিকেটের অদৃশ্য পতাকাও থাকে সবসময়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy