নোভাক জোকোভিচ। —ফাইল চিত্র
১৫ বছর আগের জানুয়ারি মাস। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে পুরুষদের সিঙ্গলসে জো উইলফ্রেড সঙ্গাকে হারিয়ে নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন নোভাক জোকোভিচ। পরের ১৫ বছরে তিনি আরও ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম নিজের ট্রফি ক্যাবিনেটে তুলেছেন। ভেঙে ফেলেছেন রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদালের রেকর্ড। ক্রমতালিকায় বিশ্বের ১ নম্বর স্থান ধরে রাখার নিরিখেও রজার-রাফাকে টপকে গিয়েছেন জোকোভিচ। টেনিসের ওপেন যুগে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। কিন্তু তিনিই কি ‘সর্বকালের সেরা’ টেনিস তারকা! এক পক্ষের মতে, হ্যাঁ। গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যাও জোকোভিচের শ্রেষ্ঠত্বের দলিল। আবার অন্য একটি পক্ষ মনে করেন, শুধু গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যার উপর নির্ভর করে কাউকে সর্বকালের সেরা বলা যায় না।
নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার আগেই জোকোভিচ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পথে সেমিফাইনালে ফেডেরারকে স্ট্রেট সেটে হারিয়েছিলেন তিনি। তবে পেশাদার টেনিসে তাঁর উত্থান আরও আগে। ২০০৩ সালে ১৫ বছরের জোকোভিচ পেশাদার টেনিস শুরু করেন। সেই বছরই ফেডেরার নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন। নাদাল নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন দু’বছর পরে ২০০৫ সালে। পরের কয়েকটা বছর পুরুষদের টেনিসে দাপট দেখিয়েছেন এই দুই তারকা। তার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরেছেন জোকোভিচ। ধীরে ধীরে ফেডেরার ও নাদালের ‘বিগ ২’কে ‘বিগ ৩’তে পরিণত করেছেন তিনি।
২০০৬ সালে বিশ্বের প্রথম ৪০ জন পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন জোকোভিচ। সেই বছরই গ্রেট ব্রিটেন চেয়েছিল জোকোভিচ সার্বিয়া ছেড়ে তাদের হয়ে খেলুক। অ্যান্ডি মারের সঙ্গে নোভাকের বন্ধুত্বও গ্রেট ব্রিটেনের প্রস্তাবের একটা কারণ। সে বছর ডেভিস কাপের সময় জোকোভিচের মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছিল গ্রেট ব্রিটেন। মারের দেশের হয়ে খেললে বেশি সুযোগ সুবিধা পাবেন জেনেও জোকোভিচ নিজের দেশের হয়ে খেলবেন বলেই ঠিক করে নেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড স্ল্যামে ফেডেরার ও নাদালের কাছে হারলেও নিজের জায়গা তৈরি করতে শুরু করেছিলেন জোকোভিচ। যেমন, সেই বছর কানাডা ওপেনের সেমিফাইনালে নাদালকে ও ফাইনালে ফেডেরারকে হারিয়েছিলেন তিনি।
২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পর ২০১১ সাল পর্যন্ত কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেননি জোকোভিচ। কিন্তু তার মধ্যেই নজর কেড়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ১০টি প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠে ৫টি জেতেন তিনি। ২০১১ সাল জোকোভিচের কেরিয়ারের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বছর। সেই বছরে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, উইম্বলডন ও ইউএস ওপেন জেতেন সার্বিয়ার তারকা। টানা ৪১ ম্যাচ জিতে বিশ্বের ১ নম্বর তারকা হয়ে ওঠেন তিনি। সেই শুরু। তার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। পরের ১২ বছরে নিজেকে আরও শক্তিশালী করেছেন জোকোভিচ। জিতেছেন ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম।
ফেডেরার ও নাদালকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন জোকোভিচ। ফেডেরারের (২০) থেকে ৩টি ও নাদালের (২২) থেকে ১টি বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম তাঁর। বছরের শেষে ১ নম্বর খেলোয়াড় হিসাবে সাত বার শেষ করেছেন তিনি। সেটাও ফেডেরার ও নাদালের থেকে দু’বার বেশি। ৩৮৮ সপ্তাহ ধরে বিশ্বের ১ নম্বর টেনিস তারকা তিনি। ফেডেরার ছিলেন ৩১০ সপ্তাহ। স্টেফি গ্রাফ ৩৭৭ সপ্তাহ। আগামী দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ, ফেডেরার অবসর নিয়েছেন। চোটে জেরবার নাদালের অবসর নিয়েও অনেক জল্পনা চলছে। জোকোভিচ যখন পুরুষদের টেনিসে উদীয়মান তারকা তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্গা, মারে বা ওয়াওরিঙ্কারা অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। সঙ্গা তো অবসরই নিয়ে নিয়েছেন। এই বয়সেও কার্লোস আলকারাজ, ক্যাসপার রুডদের যে ভাবে হেলায় তিনি হারাচ্ছেন তাতে জোকোভিচ যখন থামবেন তখন তাঁর নামের পাশে যে রেকর্ড থাকবে তা হয়তো বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। জোকোভিচের এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে তাঁকে সর্বকালের সেরা বলছেন অনেকে।
আর একটি পক্ষের মতে, সর্বকালের সেরা অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। শুধুমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যা সেখান বিচার্য হয় না। জোকোভিচ আগে কোর্টের মধ্যে অনেক কথা বলতেন। নানা রকম মজা করতেন। অন্য খেলোয়াড়দের নকল করতেও দেখা যেত তাঁকে। সেই জন্যই তাঁকে ‘জোকার’ বলে ডাকা হয়। সেই সবের পিছনে একটা বড় কারণ অনুরাগীর সংখ্যা বাড়ানো। জোকোভিচ জানতেন, গোটা সার্বিয়ার সমর্থন তিনি পেতে পারেন, কিন্তু টেনিস দুনিয়া দু’ভাগে বিভক্ত। ফেডেরার ও নাদাল ভক্তদের মধ্যে নিজেকে তুলে ধরার একটা আপ্রাণ চেষ্টা দেখা যেত তাঁর মধ্যে। এখন সেটা নেই। এখন তিনি কোর্টে অনেক শান্ত। কিন্তু অবসর নিয়ে ফেলা ফেডেরার বা দীর্ঘ দিন কোর্টে না নামা নাদালের এখনও যে ভক্তকূল রয়েছে তার কাছে কি পৌঁছতে পেরেছেন জোকোভিচ!
ফেডেরারের খেলার একটা আলাদা সৌন্দর্য ছিল। সেখানে পেশির জোরের তুলনায় শিল্প অনেক বেশি। তাঁর প্রধান শক্তি ছিল এক হাতে ব্যাকহ্যান্ড। এখনও কোর্টে কেউ এক হাতে ব্যাকহ্যান্ড খেললে বলা হয় ‘ফেডেরারোচিত’। নাদালের আবার প্রধান শক্তি ফোরহ্যান্ড। কিন্তু জোকোভিচের আলাদা করে সে রকম কোনও শট নেই। জোকোভিচের খেলা দেখতে ভাল লাগে না। এখন খেলা অনেক বেশি পেশির জোরে হয়। এই খেলাটা কিন্তু জোকোভিচই শুরু করেন। সেখানে শিল্পের কোনও জায়গা নেই। লম্বা র্যালি খেলে ম্যাচ জেতাটাই আসল। ফলে শুধুমাত্র ট্রফিজয়ের হিসাবে কী ভাবে এক জনকে সর্বকালের সেরা বলা যাবে!
জোকোভিচের পিছিয়ে থাকার আরও একটা বড় কারণ বিতর্ক। খেলোয়াড় জীবনে ফেডেরার, নাদালেরা বিতর্কে জড়াননি। জোকোভিচ জড়িয়েছেন। এক বার নয়, বার বার। সে ২০২০ সালের ইউএস ওপেনে বল বয়ের গালে বল মেরে বিতাড়িত হওয়া হোক, বা কোভিড কালে একের পর এক প্রদর্শনী প্রতিযোগিতা আয়োজন করে নিন্দিত হওয়া। কোভিড টিকা না নেওয়া গোঁ ধরে রাখার জন্য অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলতে গিয়ে মেলবোর্নে আটক পর্যন্ত হতে হয়েছে তাঁকে। আর সেই কারণেই হয়তো খেলে উপার্জন বেশি করলেও বিজ্ঞাপন থেকে উপার্জনের নিরিখে অনেক পিছিয়ে তিনি। তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার আগে বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডও হয়তো একটু বেশি ভাবেন। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, ফেডেরার বিজ্ঞাপন থেকে উপার্জন করেছেন ৮১৩০ কোটি টাকা। নাদাল ৩২০০ কোটি টাকা। সেখানে জোকোভিচের উপার্জন ২৭০০ কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়, টেনিসেও বাকি সব খেলার মতো বিবর্তন হয়েছে। ১৯৬৮ সালের আগে যে ভাবে খেলা হত, ওপেন যুগে সে ভাবে হয় না। রড লেভার, বিয়ন বর্গ বা জিমি কোনর্সরা যে খেলাটা খেলতেন তার থেকে অনেক আলাদা ফেডেরার, নাদাল বা জোকোভিচের খেলা। সব থেকে বড় বিবর্তন হয়েছে টেনিসের মূল অস্ত্র র্যাকেটে। আগে খেলা হত কাঠের র্যাকেটে। এখন সেখানে গ্রাফাইটের র্যাকেট। তার ওজন কম। কিন্তু অনেক জোরে বল মারা যায়। ১৯৬২ ও ১৯৬৯ সালে লেভার যখন ক্যালেন্ডার স্ল্যাম (এক বছরে চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম) জিতেছিলেন তখনও তিনি কাঠের র্যাকেটে খেলতেন। সেই র্যাকেট ২০১৮ সালে উপহার হিসাবে ফেডেরারকে দেন তিনি। তা ছাড়া আগে ফরাসি ওপেন ছাড়া বাকি তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ঘাসের কোর্টে হত। ইউএস ওপেন ১৯৭৫ সালে লাল সুরকিতে খেলা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে আবার বদল হয়। সে বছর থেকে হার্ড কোর্টে খেলা শুরু হয় ইউএস ওপেন। খেলোয়াড়দের ডায়েট, শরীরচর্চা থেকে অনুশীলন সব বদলে গিয়েছে।
তবে ওপেন যুগের তুলনায় এখন খেলায় প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। আগে অপেশাদার খেলোয়াড়েরা গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলতেন। কিন্তু এখন সবটাই পেশাদার। গ্র্যান্ড স্ল্যামে সুযোগ পাওয়া নির্ভর করে ক্রমতালিকার উপর। অবাছাইদের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সুযোগ পেতে হয়। যে কেউ চাইলেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে পারেন না। প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ায় প্রত্যেক খেলোয়াড়ের শক্তি, দুর্বলতা প্রতিপক্ষের হাতের তালুতে থাকে। তাতে পরিকল্পনা করতে অনেক সুবিধা হয়।
আবার শুধুমাত্র যদি গ্র্যান্ড স্ল্যামের কথা ধরা হয় সেখানে পুরুষরা না হলেও জোকোভিচের থেকে এগিয়ে রয়েছেন দু’জন মহিলা তারকা। ওপেন যুগের আগে খেলা মার্গারেট কোর্টের সিঙ্গলস, ডাবলস ও মিক্সড ডাবলস মিলিয়ে গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যা ৬৪টি। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাও সব মিলিয়ে ৫৯টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন।
জোকোভিচ অবশ্য নিজেও মানেন না যে তিনি সর্বকালের সেরা। কয়েক দিন আগে ফরাসি ওপেন জিতে তিনি বলেছেন, ‘‘নিজেকে সর্বকালের সেরা আমি বলতে চাই না। কারণ, তা হলে বিভিন্ন সময়ে টেনিসের সেরা তারকাদের অসম্মান করা হয়।’’ একই কথা শোনা গিয়েছে তাঁর পূর্বসূরি ফেডেরার ও নাদালের গলাতেও।
জোকোভিচ আধুনিক টেনিসের সংজ্ঞা বদলেছেন। সার্বিয়ার মতো একটি ছোট দেশ থেকে এসে টেনিস বিশ্বে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১১ সালে যখন তাঁর ঝুলিতে মাত্র ৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম, তখনই ফেডেরার ও নাদালের মিলিত গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যা ছিল ২৫। সেখান থেকে ধাপে ধাপে দুই তারকার সাম্রাজ্যে ভাগ বসিয়েছেন তিনি। তৈরি করেছেন নিজের সাম্রাজ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত সার্বিয়ায় ছোট থেকে বেঁচে থাকার যে পরিশ্রম জোকোভিচকে করতে হয়েছে সেটাই হয়তো আগামীতে তাঁকে আরও দৃঢ় করেছে। সেখানে চোয়ালচাপা লড়াইয়ের বাইরে আর কিছু থাকে না। এটাই জোকোভিচের শক্তি। এই শক্তিই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আগামী দিনেও হয়তো এগিয়ে নিয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy