আইপিএলের আকর্ষণ কমছে। —ফাইল চিত্র
‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ এক সময় বাংলার নাট্যমঞ্চে ঘুরে বেড়িয়েছিল। কিন্তু এ বারের আইপিএল সেই চরিত্রগুলিই হারিয়ে ফেলেছে। পাড়ার চায়ের দোকান, ক্লাবের আড্ডা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আইপিএল? সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজলে সব চোখ খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছে না? উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।
চায়ের দোকানে কিছু দিন আগে আড্ডা দেওয়ার সময় সমীরের একটা কথা কানে লাগল। সমীর ছোটবেলা থেকে খেলা পাগল। প্রতি দিন বিকেলে পাড়ার মাঠে আর কাউকে পাওয়া যাক বা না যাক সমীরকে পাওয়া যেতই। খেলা দেখার জন্যেও মুখিয়ে থাকত ছেলেটা। কিন্তু সে দিন সন্ধে আটটা বেজে গেলেও ওর মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া দেখলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে আইপিএলের ম্যাচ নেই আজকে?” সমীর বলল, “ধুস! সেই ব্যাপারটা নেই এ বারের আইপিএলে। ধোনি নেই, বিরাট নেই। নেতৃত্ব ছাড়ার পর ওরা যেন কেমন হারিয়ে গিয়েছে।”
সত্যিই কি তাই? আইপিএল দেখার উৎসাহ হারিয়ে গিয়েছে? বার্কের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে গত বারের চেয়ে এ বারের আইপিএলের টিআরপি কমে গিয়েছে। প্রথম সপ্তাহের চেয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহে আইপিএলের টিআরপি অনেকটাই কমে গিয়েছে। বয়সের ভিত্তিতে ১৫-২১, ২২-৩০ এবং ৩১-৪০ বছরের মানুষদের মধ্যে করা সমীক্ষায় এ বারের আইপিএল দ্বিতীয় সপ্তাহে দেখা কমিয়েছেন যথাক্রমে ১৭%, ১২% এবং ১৫% মানুষ। গত বারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ১৫-২১ বছরের মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ কম মানুষ আইপিএল দেখছেন, ২২-৩০ এবং ৩১-৪০ বছরের মধ্যে ৩৪ শতাংশ কম মানুষ আইপিএল দেখছেন। প্রথম সপ্তাহে এই বয়সের ভাগে ৩৮ শতাংশ, ৩৩ শতাংশ এবং ৩২ শতাংশ কম মানুষ আইপিএল দেখছেন।
গুরুগ্রামের কিয়োস মার্কেটিং নামক একটি কন্সালটেন্সি ফার্মের প্রধান সজল গুপ্ত বলেন, “সমীক্ষা বলছে আইপিএল দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত। শেষ তিনটি আইপিএল দেড় বছরের মধ্যে ছ’মাসের ব্যবধানে হয়েছে। অতিমারির জন্য মানুষ এক জায়গায় ছিল, সেই সময় টিভিতে খেলা দেখেছে। কিন্তু এখন সেটা নয়। মানুষ ঘুরছে, খাচ্ছে, দোকানে যাচ্ছে তাই টিভিতে খেলা দেখা কমেছে।” অনেকের মতে শুরুর দিকে আইপিএল নিয়ে যে আগ্রহ ছিল, সেটা সময়ের সঙ্গে কমে গিয়েছে। মুম্বইয়ের একটি মিডিয়া সংস্থার প্রধান শ্রেনিক গাঁধী বলেন, “দ্বিতীয় সপ্তাহে টিআরপি কমে যাওয়া নিয়ে আমি চিন্তিত নই। প্রতিযোগিতা যত প্লে-অফের দিকে এগবে, তত খেলা দেখার আগ্রহ বাড়বে।”
এ বারের আইপিএলে নতুন দল এসেছে। পুরনো দলগুলিতে একাধিক নতুন ক্রিকেটার। সেই সঙ্গে এ বারের আইপিএলে নেই অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, বিরাট কোহলী। নেই এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেলরাও। এ বারের আইপিএলে অনেক সময়ই বিরাটকে দেখা যাচ্ছে বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করছেন। ৩০ গজের মধ্যে তাঁর আগ্রাসী উপস্থিতি অন্য বারের থেকে কম। বোলারদের সঙ্গে কথা বলছেন বেঙ্গালুরুর অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি। নির্লিপ্ত লাগছে বিরাটকে। ধোনি যদিও জাডেজাকে সাহায্য করছেন। তিনি যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন সেটা স্পষ্ট। কিন্তু নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর কিছুটা জৌলুস হারিয়ে ফেললেন তাঁরা। ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশের মত তেমনটাই।
এ বারের প্রতিযোগিতা শুরুর আগে আইপিএলে ধোনির বেশ কিছু বিজ্ঞাপন নজর কেড়েছিল। কখনও রাস্তার মাঝে বাস থামিয়ে খেলা দেখতে বসে যাচ্ছেন সকলে, কখনও গোটা পরিবার এক হয়ে বসে আইপিএল দেখছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রচার স্বত্ব থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য রেখেছে। ২০২২ সালে গত পাঁচ বছরের দ্বিগুণ আয় সম্ভব বলে মনে করছে তারা। ২০১৭ সালে সম্প্রচার স্বত্ব থেকে বিসিসিআই পেয়েছিল ২৬,৩৪৮ কোটি টাকা। এই বছর সম্প্রচারকারী সংস্থা বিজ্ঞাপনের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি ১০ সেকেন্ডের জন্য ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতাদের। গত বছর সেটা ছিল ১৩-১৪ লক্ষ টাকা।
প্রযোজক স্নেহাশিস চক্রবর্তীর এই মুহূর্তে বেশ কিছু ধারাবাহিক চলছে। তিনি বললেন, “আইপিএল চললে তার অল্প বিস্তর ফারাক পড়ে। কারণ, এই প্রজন্ম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আইপিএল দেখতে ভালবাসেন। ফলে, সাড়ে সাতটায় যে ধারাবাহিক চলে সেই ধারাবাহিক দেখতে দেখতেই অনেকে চ্যানেল ঘুরিয়ে খেলা দেখতে থাকেন। কেউ পুনঃসম্প্রচার দেখে জেনে নেন ধারাবাহিকের নতুন গল্প। কয়েকটা দিন খেলাকেই এগিয়ে রাখেন তাঁরা। আবার এমনও অনেকে আছেন যাঁরা নির্দিষ্ট ধারাবাহিক ছেড়ে নড়েন না। তাঁরা এই সময়ে চ্যানেল ঘোরান না। এ ভাবেই মোটামুটি ভারসাম্য বজায় রক্ষা হয়। তার পরেও বলব, রেটিং চার্টে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে এই বিশেষ খেলা।”
আইপিএল মানেই এক একটি চরিত্রের লড়াই। তাঁদের দেখার জন্যই ভিড় করে দর্শক। সেই চরিত্রগুলিই কি হারিয়ে গেল? অভিনেতা এবং পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী বললেন, “ধোনি, কোহলী অধিনায়ক না থাকায় সত্যিই আইপিএলের জৌলুস কমে গিয়েছে। ধোনির তবুও বয়স হয়েছে, কিন্তু কোহলী অধিনায়ক নয় এটা মানতে কষ্ট হয়। তবে এখন মানুষ সন্ধেবেলা যুদ্ধের খবর বোধ হয় বেশি দেখছেন, আইপিএল ছেড়ে।” ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্র দিব্যজ্যোতি দত্ত। আইপিএলের ম্যাচ চলার সময়ই তাঁর ধারাবাহিকের সম্প্রচার হয়। তিনি নিজে ধোনির অন্ধভক্ত। দিব্যজ্যোতি বললেন, “আইপিএল শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও জনপ্রিয়। আমার এক আত্মীয় থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানেও আইপিএল দেখা হয়। ধোনি-বিরাট নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ায় জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমি নিজে যদিও রোজ ম্যাচ দেখতে পাচ্ছি না কাজের চাপে।”
আইপিএলের টিআরপি কমেছে। আইপিএলে বেশ কিছু চরিত্র কমেছে। নতুন চরিত্র এখনও খুঁজে পাচ্ছে না দর্শক। কিছুটা আগ্রহও হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার মানুষ টিভি ছেড়ে এখন মোবাইলে খেলা দেখার দিকেও ঝুঁকছে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথেই মোবাইলে খেলা দেখছেন মানুষ। সেটার প্রভাবও পড়ছে টিআরপি-তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy