সম্মান ও লজ্জা। সতীর্থদের কাঁধে সঙ্গকারা। শোভাযাত্রায় ধবন, কোহলি, রোহিত। ছবি পিটিআই
কুমার সঙ্গকারাকে কাঁধে নিয়ে তাঁর দুই সহ-খেলোয়াড় আর পাশে শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকা। গোটা মাঠ প্রদক্ষিণ করানো হল সঙ্গাকে। সেই মমত্বের সঙ্গে, যা ভারতে সহ খেলোয়াড়রা এক মাত্র সচিনের জন্য বরাদ্দ রেখেছিল। সঙ্গা এত দিন রান করে দেশকে টেনেছেন, জিতিয়েছেন। বিদায়বেলায় তাঁকে অপ্রত্যাশিত জয় উপহার দিয়ে গেল তাঁর স্পিনার সঙ্গীরা। স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে যা পালিত হওয়ার কথা ছিল ভারতে, আপাতত তাতেই বিভোর শ্রীলঙ্কা। তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে এটা ‘রিপ্লেজ বিলিভ ইট অর নট’ জাতীয় জয়ের পর্যায় ভুক্ত থাকবে। আর কোহলির ভারত?
বিদেশে ভারতের টেস্ট ম্যাচ হারের কাহিনি তো সেই রামায়ণ-মহাভারতের আমল থেকে চলছে। টেস্ট ক্রিকেটের পৌরাণিক যুগেও বিদেশ যাত্রা মানেই ভারতের বিমা করা বিপর্যয়। সিরিজের প্রথম টেস্টে তো অবশ্যই।
গলে হুমড়ি খেয়ে ৬২ রানে লজ্জাকর হারের সঙ্গে তাই ভারতীয় ইতিহাসের পৌনঃপুনিকতার কোনও রকম বিরোধ নেই। এই রকম অনেক স্বাধীনতা দিবস এসেছে গিয়েছে। বিদেশে ভারতীয় ক্রিকেট কখনও কখনও স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু পুরনো সব বিষণ্ণ লোকগীতিকে মনে রেখেও গল টেস্টে যা ঘটল তার পাশে রাখার মতো নমুনা একটার বেশি পাচ্ছিনা।
বিদেশে ভারতের এক রকম চিরকালীন কলঙ্কিত মার্কশিটের মধ্যেও একটাই সাবজেক্টে ভাল নম্বর রয়েছে। চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া। দুশোর কম রান চতুর্থ ইনিংসে তাড়া করে ভারত একবারই মাত্র টেস্ট হেরেছে। যেই হারের বিভীষিকাটা এমনই সর্বাত্মক ছিল। যে আজও মেলায়নি। আর আজকেরটা আঠারো বছর পর টাটকা এসে স্বাধীনতা দিবসের দৃপ্ত জয় হিন্দকেই মলিন করে দিল। জাতীয় ছুটির দিনে ভারতীয় দল এ ভাবে জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়া মানে তো গোটা জাতির মেজাজটাই ‘নো নেটওয়ার্ক’ হয়ে যাওয়া।
আঠারো বছর পুরনো দগ্ধ অতীতে ফেরা যাক। ১৯৯৭-এর বাের্বডোজ। আজ যেমন বাকি নয় উইকেটে অপারেশন ১৫৩ ছিল ভারতীয় ড্রেসিংরুমের মন্ত্র, সেদিনকার টার্গেট ছিল আরও কম। মাত্র ১২০ রান ধাওয়া করতে নেমে সচিনের দলের বিহ্বলকারী হার আজও ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অভিহিত করে থাকেন তখনকার মরাঠি অধিনায়ক।
হারের পর এমন তোলপাড় হয়েছিল সে দিন ভারতীয় ড্রেসিং রুমে যে সচিনের প্রেস কনফারেন্স হয়েছিল টিমের শৌচাগারে। তবু সেই হারে মনকে সাময়িক প্রলেপ দেওয়ার রাস্তা খোলা ছিল। সন্দেহ করা হয়েছিল আজহার-সহ দলের দু’এক জন ইচ্ছাকৃত বাজে শট খেলেছেন। সৌরভ রান পাননি, রাহুলও না। কিন্তু কেনসিংটন ওভালে ৮১ রানে অল আউট করা বিপক্ষ বোলারদের নামগুলো ছিল— ইয়ান বিশপ, কার্টলে অ্যামব্রোজ। সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কলিন রোজ- সেই সময়কার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা তরুণ রফতানি।
সচিনের নাতি তাও দাদুকে বলার সুযোগ পাবে, শক মনে বাঁচিয়ে রেখো না, ওরা তোমার মাপেরই ক্রিকেটার ছিল। কোহলির ছেলে তাঁকে কী করে সান্ত্বনা দেবে গল বিপর্যয়ের?
রঙ্গনা হেরাথ আর থারিন্দু কৌশল! সর্বোচ্চ পর্যায়ের বোলারের জাত হল! হেরাথ একটা সময় শ্রীলঙ্কাকে একগাদা ম্যাচ জিতিয়েছেন। কিন্তু ইদানীং তো তিনি এমনই অফ ফর্মে টিমে থাকবেন কেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ টেস্টে বসে যান। গলের প্রথম ইনিংসে বোলিং গড় ছিল ০-৬৭। সেই হেরাথকে আজ ভারত এমন ভাবে খেলল যেন ডেরেক আন্ডারউড! মাত্র ৪৮ রানে ৭ উইকেট পাওয়ার তিনি যোগ্য, এই ৩৭ বছর বয়সে? প্যাভিলিয়নের দিকে গুডলেংথের সামান্য আগে একটা প্যাচ হয়েছে। সেই ক্ষত চিহ্নে বল ফেলে গেলেন হেরাথ। আর ভারতীয়রা ক্রিজে নিশ্চেষ্ট থেকে তাঁকে একে একে উইকেটগুলো দিয়ে গেলেন। টার্নিং ট্র্যাকে টেস্ট ব্যাটিং তো স্বাধীনতা দিবসের লেফট্ রাইট লেফট প্যারেড নয়। এখানে ব্যাটসম্যানকে ইম্প্রোভাইজেশন দেখাতে হয়। উঠে গিয়ে বোলারের লাইন-লেংথ নষ্ট করতে হয়।
কাল দীনেশ চণ্ডীমলকে দেখেও সেই আক্রমণাত্মক স্টাইল আঁকড়ানোর চেষ্টা কেন করা হল না এটা রহস্য। অশ্বিন আর ধবন বাদ দিয়ে সব উইকেটই তো প্রায় ডিফেন্ড করতে গিয়ে। স্টেপ আউট করে দিনের প্রথম বাউন্ডারি দেখা গেল ভারতীয় দশম উইকেট জুড়ির ব্যাটিংয়ের সময়। পুরো ৫০ ওভারও কিনা টিম ব্যাট করতে পারেনি!
ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার অজিঙ্ক রাহানে ছাড়া বাকিদের দেখে মনে হচ্ছিল এরা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউজিল্যান্ড টিমের। টার্নিং ট্র্যাকে স্পিন খেলাটা আজও জানে না। হরভজনকে ব্যাটিং অর্ডারে অশ্বিনের আগে পাঠিয়ে একটা চাল কোহলি/শাস্ত্রী চেলেছিলেন। কিন্তু কোনও কাজ দেয়নি। সর্দারের অধুনা যা মানসিকতা, কলম্বোতে দ্রুত রূপান্তর না হলে তাঁর পিছনে প্রসেনজিত্-ঋতুপর্ণার নতুন ছবির ট্যাগ লেগে যাবে। প্রাক্তন।
দুর্দান্ত ক্লোজ ইন ফিল্ডিং করল শ্রীলঙ্কা। আম্পায়রিং থেকে যাবতীয় সাহায্য পাওয়া গ্লানি তারা শেষ দিনে ঢেকে দিয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্ড চেঞ্জ, লাইন মেনে বোলিং আর দুর্দান্ত ক্যাচিংয়ে। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে কৌশল সিলভা নিজের ব্যাটিং ব্যর্থতা মুছে দিলেন কোহলি আর হরভজনের ঝাঁপিয়ে পড়া ক্যাচে। মনে হচ্ছিল শ্রীলঙ্কার মাঠে সোলকার বুঝি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন!
আউট ফিল্ডের ধামিকা প্রসাদ আর নিজের বলে কৌশল বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে যে ক্যাচ দু’টো তুললেন তার একটাই নাম, কমিটমেন্ট। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এই উদ্দীপ্ত চেহারা ছিল কোথায়? ভারতীয়রা তো তাদের খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারেনি!
বিজয় অমৃতরাজের আমলে একটা কথা ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের মানসিকতা সম্পর্কে খুব শোনা যেত। ভাল খেলিয়াও পরাজিত। গ্যালান্ট লুজার।
এটা তাও নয়। হ্যাঁ, বার্বেডোজের চেয়ে অনেক বেশি মর্মান্তিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy