Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ইডেনে ঢাকের তালে বিশ্বসেরার সিংহাসনে

মহম্মদ শামির বাউন্সারটা ট্রেন্ট বোল্টের ব্যাটের কানায় লেগে উড়ে গেল আকাশে। এক ওভার আগেই নেওয়া নতুন টকটকে চেরিটা মুরলী বিজয়ের হাতে এসে পড়তেই শুরু হয়ে গেল বিজয়োৎসব।

ইডেন জয়ের মুহূর্তে। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ইডেন জয়ের মুহূর্তে। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

রাজীব ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:৩৮
Share: Save:

মহম্মদ শামির বাউন্সারটা ট্রেন্ট বোল্টের ব্যাটের কানায় লেগে উড়ে গেল আকাশে। এক ওভার আগেই নেওয়া নতুন টকটকে চেরিটা মুরলী বিজয়ের হাতে এসে পড়তেই শুরু হয়ে গেল বিজয়োৎসব। ইডেনে গমগম করে উঠল ঢাকের আওয়াজ। সঙ্গে ধুনুচি নৃত্যও। পাগলের মতো ধুনুচি নিয়ে নেচে চলেছেন একজন।

ইডেনের আবহ তখন সুরুচি সঙ্ঘ, মহম্মদ আলি পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রিনের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ঢাকের তালে কোমর দুলে উঠল আশপাশের প্রায় সবারই। কোহালিরা তখন ড্রেসিংরুমে নিজেদের মধ্যে জয় সেলিব্রেট করবেন কী, মাঠের এই বিজয়োৎসব তো আড়ম্বরে তার দশগুণ।

মাঝে মাঝে দশমীর তালও বেজে উঠছিল ঢাকে। ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।’ ওটা বোধহয় নিউজিল্যান্ডের জন্য। ইডেন টেস্টের চতুর্থীতেই যে ভাসান হয়ে গেল তাদের।

আর ভারতের দুর্দান্ত টেস্ট জয়, সিরিজ জয় ও টেস্টে কোহালিদের বিশ্বসেরার সিংহাসন জয়ের এই উৎসব দেখে রাজ্যের বাইরে থেকে আসা অতিথিদের অনেককেই বলতে শোনা গেল, এ কলকাতাই পারে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে যখন বারুদের গন্ধ, তখন পাকিস্তানের হাত থেকে টেস্ট দুনিয়ার সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার তৃপ্তিই অন্য রকম। তাই উৎসবের মাত্রাটাও বেশ চড়া। সোমবার কোহালিরা শুধু কিউয়িদের হারাননি, হারালেন পাকিস্তানকেও। টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের যে সিংহাসনে বসে পড়েছিল পাকিস্তান, তাদের নামিয়ে সেখানে এখন ভারত। তেরো টেস্টে অপরাজিত (১১ জয়, ২ ড্র) থাকার রেকর্ড যাদের, তারা তো এক নম্বরে যাবেই। এ যেন উরিতে ১৮ শহিদ জওয়ানের হত্যার বদলা কোহালিদের। রবিবারও জঙ্গিরা বারামুলায় রাতভর তাণ্ডব চালিয়েছে। উৎসব আর বদলার আবহে বিজয়োল্লাসের মাত্রাটাও তাই বেশ চড়া।

এখানেই অবশ্য শেষ নয়। ইডেনে আরও প্রাপ্তি বাংলার দুই তারকার সাফল্য। দুই ইনিংসেই অপরাজিত হাফসেঞ্চুরি করে ম্যাচসেরার খেতাব জিতে নিলেন ঋদ্ধিমান সাহা। আর দুই ইনিংসেই তিনটে করে উইকেটে পেয়ে ভারতের জয়ে বড় অবদান রাখলেন মহম্মদ শামি। এই চার দিনে ইডেনের মন ভরিয়ে দিয়েছেন দুই বঙ্গ ক্রিকেটার। তাঁদের প্রশংসায় মুখর ক্যাপ্টেন কোহালিও।

ইডেন জয়ের নায়ক আসলে দু’জন নন, তিন জন। তৃতীয় নায়ক ইডেনের বাইশ গজ। যা কোহালির সামনে তাঁদের অদূর টেস্ট ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন রাস্তা খুলে দিল। যে কোহালি এক সময় ভেবেছিলেন ঘূর্ণি উইকেট বানিয়ে স্পিন-অস্ত্রে বিদেশিদের বধ করা ছাড়া ঘরের মাঠে টেস্ট জেতার অন্য কোনও রাস্তা নেই, সেই কোহালি এ দিন সিরিজ জিতে উঠে বললেন, ‘‘দুর্দান্ত টেস্ট উইকেট। অনিয়মিত বাউন্সটা বাদ দিলে ভাল ক্রিকেট হওয়ার মতো পিচ।’’

শুধু স্পিনাররাই নয়, ঘরের মাঠে যে তাঁকে দলের পেসাররাও জয় এনে দিতে পারেন, তা এই ইডেন-পিচেই বুঝে নিলেন ভারত অধিনায়ক। দুই ইনিংসে পেসারদের এক ডজন উইকেট নেওয়ার পর এখন তিনি বলছেন, ‘‘আমরা এখন যে কোনও উইকেটে ভাল খেলতে পারি। সেই ক্ষমতা যে আছে আমাদের দলে, সেটাই বোঝা গেল। উইকেটের ভাবনা না ভেবে শুধু পজিটিভ মাইন্ডসেট নিয়ে খেললেই যে ভাল ক্রিকেট খেলা যায়, সেটাই প্রমাণ হল। ইডেনের এই উইকেটে খেলে আমরা বুঝে নিলাম আসল টেস্ট ক্রিকেটের লড়াই কী ভাবে লড়তে হয়।’’ দলের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কোহালিকে এত উৎসাহী শেষ কবে দেখিয়েছে? মনে পড়ে না।

ইডেন উইকেটের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাঁর। ২০০১-এর ঐতিহাসিক টেস্ট জয় ভারতীয় ক্রিকেটকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছিল। তার দেড় দশক পর সেই ইডেনেই টিম ইন্ডিয়ার সামনে একটা বিকল্প রাস্তা খুলে গেল। যে রাস্তায় হাঁটতে শুধু স্পিনারদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। পেস বোলারদের উপরও ভরসা করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে বোর্ডের কিউরেটরদের সামনেও এখন নতুন রাস্তা। বার্মুডা ঘাস আর ব্ল্যাক ক্লে দিয়ে তৈরি উইকেট। ‘‘সঙ্গে মাঠকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমও চাই’’, বললেন ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়, ‘‘খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও ওদের জন্যই এই উইকেটটা দাঁড় করিয়ে দিতে পারলাম।’’

এই টেস্টের স্কোরকার্ডে কোনও সেঞ্চুরি নেই ঠিকই। কিন্তু ব্যাট-বলের যুদ্ধ যে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তার প্রমাণ রয়েছে। প্রথম ইনিংসে ৪৩-৩ হয়ে যাওয়ার পর পূজারা-রাহানের পার্টনারশিপ। আর ভারতকে সেফ জোনে নিয়ে যাওয়ার ইনিংস ঋদ্ধিমানের। দ্বিতীয় ইনিংসেও ৪৩-৩ হয়ে যাওয়ার পর ফের খাদের কিনারা থেকে টেনে আনা রোহিত শর্মা ও কোহালির যুগলবন্দি। সোমবার সেই ঋদ্ধিই ৫৮-য় অপরাজিত থেকে ভারতের জয়ের প্রায় সিলমোহর লাগিয়ে দেন। প্রশ্ন ছিল, কখন আসবে সেই জয়। কারণ, ইডেনে চতুর্থ ইনিংসে এত রান তাড়া করে জেতা ‘সিরফ মুশকিল নেহি, নামুমকিন ভি হ্যায়’। নিউজিল্যান্ড পেসাররাও তো কুড়িটার মধ্যে চোদ্দো উইকেটই নেন। চার দিনে চল্লিশটা উইকেট ও প্রায় হাজারের কাছাকাছি রান। এই না হলে টেস্ট ক্রিকেটের আনন্দ!

তার উপর আবার এ দিন ইডেনে দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টাও কম করেননি ভারতীয় ক্যাপ্টেন। ভরা ইডেন না পেলেও দর্শকদের সব সময় মুখর রাখতে চেয়েছেন তিনি। দু’হাত তুলে সমানে গ্যালারিতে দর্শকদের চিৎকার করতে বলছিলেন। এই নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দর্শকদের ইনভলভ করতে চাইছিলাম। দর্শকরা গলা না ফাটালে আমরা ভাল খেলব কী করে?’’

৩৭৬-এর টার্গেট নিয়ে নেমে চা বিরতিতে নিউজিল্যান্ড ছিল ১৩৫-৩। প্রেসবক্সে তর্ক শুরু হয়ে যায় এক সেশনে সাত উইকেট ফেলে ভারত চারদিনেই ম্যাচ শেষ করে দিতে পারবে?

কেন পারবে না? এই ইডেনেই তো শেষ বেলায় সাত উইকেট তুলে রোমাঞ্চকর জয় ছিনিয়ে নেওয়ার দু-দু’টো উদাহরণ রয়েছে। ২০০১-এ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট জয়েই তো এমন হয়েছিল। শেষ দিন চায়ের সময় অস্ট্রেলিয়া ছিল ১৬১-৩। দিনের শেষে অল আউট।

তিন বছর আগে নভেম্বরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। ক্যারিবিয়ানরা চায়ে ১১২-৩। ফিরে এসে ১৬৮-তে অল আউট।

এ বারও সেই ঘটনার রিপ্লে। স্কোরবোর্ডে ১৩৫-৩ নিয়ে চা খেতে গিয়েছিলেন টম ল্যাথাম ও লিউক রঙ্কি। মাঠে ফিরে ৭৪-এ অশ্বিনের বলে কট বিহাইন্ড ল্যাথাম। ধস নামার শুরু। শামি, জাডেজা, ভুবনেশ্বরদের তাণ্ডবে এর পর রস টেলররা ১৯৭-এ শেষ। শেষ বিকেলের ইডেনে এই বোলিং সন্ত্রাস না এ বার বিপক্ষের আতঙ্ক হয়ে ওঠে।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ২২৭-৮ এর পর) ঋদ্ধিমান অপরাজিত ৫৮, ভুবনেশ্বর কুমার ক নিকোলস বো ওয়াগনার ২৩, মহম্মদ শামি ক ল্যাথাম বো বোল্ট ১, অতিরিক্ত ১৪, মোট ২৬৩। পতন: ২৫১, ২৬৩। বোলিং: বোল্ট ১৭.৫-৬-৩৮-৩, হেনরি ২০-২-৫৯-৩, ওয়াগনার ১৫-৩-৪৫-১, পটেল ৮-০-৫০-০, স্যান্টনার ১৬-২-৬০-৩।

নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (টার্গেট ৩৭৬) ল্যাথাম ক ঋদ্ধি বো অশ্বিন ৭৪, গাপ্টিল এলবিডব্লিউ অশ্বিন ২৪, নিকোলস ক রাহানে বো জাডেজা ২৪, টেলর এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৪, রংকি বো জাডেজা ৩২, স্যান্টনার এলবিডব্লিউ শামি ৯, ওয়াটলিং বো শামি ১, হেনরি ক কোহালি বো জাডেজা ১৮, পটেল বো ভুবনেশ্বর ২, ওয়াগনার অপরাজিত ৫, বোল্ট ক বিজয় বো শামি ৪, অতিরিক্ত ০, মোট ১৯৭। পতন: ৫৫, ১০৪, ১১৫, ১৪১, ১৫৪, ১৫৬, ১৭৫, ১৭৮, ১৯০, ১৯৭। বোলিং: ভুবনেশ্বর ১২-৪-২৮-১, শামি ১৮.১-৫-৪৬-৩, অশ্বিন ৩১-৬-৮২-৩, জাডেজা ২০-৩-৪১-৩।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Cricket Team Eden Test Eden Gardens
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE