বিষণ্ণ: প্রথম বিশ্বকাপের স্মৃতি রোমন্থন ঘাউড়ির। ফাইল চিত্র
ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে ডুবে থাকা বিরাট কোহালিরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না চুয়াল্লিশ বছর আগে তাঁদের পূর্বসূরিদের কী অবস্থার মধ্যে কাপ অভিষেক ঘটেছিল।
কোহালিরা যখন ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ অভিযানে নেমে পড়েছেন, তখন এক প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটারের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে চুয়াল্লিশ বছর আগের স্মৃতি। যে স্মৃতি কিছুটা বেদনার, কিছুটা অসহায় আত্মসমপর্ণের এক কাহিনি। সেই ১৯৭৫ সালে, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলা কার্সন ঘাউড়ির সঙ্গে কথা বললে বোঝা যাবে, ভারতের সেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার নেপথ্যের আসল কাহিনিটা কী।
ভারত যখন প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নামে, ক্রিকেটাররা জানতেনই না সীমিত ওভারের ক্রিকেটটা ঠিক কী জিনিস। আর গেমপ্ল্যান বা রণকৌশল কষা? সে তো দূর অস্ত্। শ্রীনিবাস বেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারত যে এগারো জনকে নামিয়েছিল, তাতে ছিলেন ঘাউড়িও। মুম্বই থেকে ফোনে এই প্রাক্তন অলরাউন্ডার বলছিলেন, ‘‘একটা জিনিস বুঝতে হবে আপনাদের। তখন কিন্তু ওয়ান ডে ক্রিকেটটা কী ভাবে খেলতে হয়, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল।’’ পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে একটি ম্যাচ বাদ দিলে বাকিগুলোয় শোচনীয় ভাবে হারতে হয়েছিল ভারতকে।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ড তোলে ৬০ ওভারে ৩৩৪-৪। এর পরে ভারত যে খেলাটা খেলেছিল, তা অবশ্য এখনও ভুলতে পারেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। ৬০ ওভার ব্যাট করে তিন উইকেটে ১৩২! যেখানে সুনীল গাওস্কর করেছিলেন ১৭৪ বলে অপরাজিত ৩৬ রান! কী ভাবে সম্ভব হয় ও রকম ব্যাটিং করা? ঘাউড়ি বলছিলেন, ‘‘ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কী করা উচিত, তা নিয়ে আমাদের কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। আর ওরা যখন তিনশোর ওপর রান তুলে দিল, তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, ম্যাচ হেরে গিয়েছি। একটা দলের যদি ও রকম মানসকিতা হয়, তা হলে আর কী হবে বলুন?’’
কিন্তু গাওস্করের ইনিংসের ব্যাখ্যা কী? ওই ম্যাচের পরে একটা রসিকতা চালু হয়ে গিয়েছিল। ভারত নাকি ওয়ান ডে ম্যাচ ড্র করতে নেমেছিল! শুনে হেসে ফেললেন ঘাউড়ি। তবে সেই হাসিতে যন্ত্রণার ছাপই বেশি। ‘‘কী জানেন, সানি তখন আর ম্যাচটা জেতার জন্য খেলছিল না। ও টেস্টের প্র্যাক্টিস সেরে নিচ্ছিল। ও জানত, ভবিষ্যতে জন স্নো, জেফ আর্নল্ড, ক্রিস ওল্ডদের খেলতে হবে। তাই ও রকম উচ্চমানের বোলারদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতিটা সেরে নেয়।’’ ম্যাচের পরে আপনাদের কি কোনও বৈঠক হয়েছিল? কাটাছেঁড়া হয়েছিল? ঘাউড়ি বলে উঠলেন, ‘‘না, না, কিছুই হয়নি। কোনও আলোচনা হয়নি, কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। যে রকম চলছিল, সে রকমই সব চলতে থাকে।’’
ঘাউড়ির কথায় সামনে আসছে ওই সময়কার ভারতীয় দলের অবস্থার কথা। প্রতিযোগিতা শুরুর দিন চারেক আগে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিল ভারত। কয়েকটা দিন হাল্কা প্র্যাক্টিসের পরে সোজা বিশ্বকাপ খেলতে নামা। এবং ইংল্যান্ড ম্যাচের আগের দিন না হয়েছে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কোনও পরিকল্পনা, না হয়েছে টিম মিটিং। ঘাউড়ি বলছিলেন, ‘‘আমার একটা জিনিস ভেবে এখনও খারাপ লাগে। ম্যাচের আগের দিনও আমাদের কোনও টিম মিটিং হয়নি, বিপক্ষকে নিয়ে কোনও পরিকল্পনাও হয়নি।’’
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংও ওই সময় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ডেনিস অ্যামিস, কিথ ফ্লেচার, টনি গ্রেগ, মাইক ডেনেসরা মিলে সে দিন ভারতীয় বোলিংকে চূর্ণ করে দেন। সেঞ্চুরি করেছিলেন অ্যামিস। ঘাউড়ি আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘আমরা এক বার আলোচনাও করিনি, কী ভাবে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে বল করতে হবে। কোন লাইনে ওদের আক্রমণ করতে হবে। আমি বলছি না, টিম মিটিং হলেই আমরা জিতে জেতাম। কিন্তু ম্যাচে একটা লড়াই হত।’’
তখনকার দিনে কোচ কেউ ছিলেন না। এক জন ম্যানেজার ছিলেন। যাঁকে একার হাতে সামলাতে হত হাজার দায়িত্ব। তাই নাম কে ওয়াস্তে একটা প্র্যাক্টিসের পরে ক্রিকেটারেরা যে যার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। ‘‘আসলে ওয়ান ডে ক্রিকেট ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছিল আমাদের। বিশ্বকাপের গুরুত্ব জানতাম, কিন্তু তার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, কী রকম দল হওয়া উচিত, এ সব নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের,’’ বলছিলেন ঘাউড়ি। যোগ করলেন, ‘‘এখনকার দলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। কী ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, কতটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তৈরি হচ্ছে। আমাদের সময় এ সব ভাবাই
যেত না।’’
আরও একটা ব্যাপার সে সময় ভারতীয় ক্রিকেটারদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা হল, মানসিকতা। ওই সময় বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করত ক্লাইভ লয়েড, ভিভিয়ান রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবিয়ান পেস আক্রমণের সামনে তখন প্রতিরোধ করার মতো ব্যাটসম্যান সে ভাবে পাওয়া যেত না। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঘাউড়ি বলছিলেন, ‘‘তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুরন্ত দল। আমরা ধরেই নিতাম, বিশ্বকাপ মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজই জিতবে। তা ছাড়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াও ভাল দল ছিল। ভারত যে এ রকম প্রতিযোগিতা জিততে পারে, সেটা ক্রিকেটারেরা নিজেরাই বিশ্বাস করত না। মোদ্দা কথা হল, ম্যাচ শুরুর আগেই হেরে বসে থাকত ভারত।’’
বিশ্বকাপে ঘাউড়ির স্মরণীয় স্মৃতি বলতে বাকিংহ্যাম প্যালেসে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া এবং ভারতীয় বোর্ডের দেওয়া একটি ব্লেজার। ‘‘ওই সময় আমরা বিদেশ সফরে গেলে ভারতীয় বোর্ডের পক্ষ থেকে কয়েকটা ব্লেজার দেওয়া হত। বিশ্বকাপের সেই ব্লেজার এখনও রাখা আছে আমার কাছে,’’ বলছিলেন ঘাউড়ি।
একটা কথা পরিষ্কার। চুয়াল্লিশ বছর পরেও ঘাউড়ির যন্ত্রণায় কোনও প্রলেপ পড়েনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy