Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

নিয়ম তো সকলে জানত, ইংল্যান্ড যোগ্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন

নক-আউট পর্বে এসে যাতে নিয়মের নির্মমতার শিকার না হতে হয়, সেটা ভেবে দেখা হবে। এ বারের জন্য তো আর কিছু করার নেই। যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। 

যোগ্য দল হিসেবেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে।—ছবি এপি।

যোগ্য দল হিসেবেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে।—ছবি এপি।

ওয়াসিম আক্রম
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৯ ০৪:২৯
Share: Save:

কী অসাধারণ একটা ম্যাচ দিয়ে শেষ হল ২০১৯ বিশ্বকাপ। আমার দেখে সর্বকালের সেরা ফাইনাল। প্রথমে টাই হল, তার পরে সুপার ওভারও টাই! কে ভাবতে পেরেছিল এমন একটা রুদ্ধশ্বাস স্ক্রিপ্ট! শেষ দেড় ঘণ্টা যা চলল, মনে হচ্ছিল গল্পে পড়া কোনও থ্রিলার। বাস্তবে এমন হতে পারে, ভাবাই যায় না।

আর টাইয়ের নিয়মকানুন নিয়ে যতই বিতর্কের ঝড় উঠুক, আমি একটাই কথা বলব। টুর্নামেন্টের আগে থেকেই তো নিয়ম ঠিক হয়ে আছে। সকলে রাজি হয়েছে এই প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী খেলতে। তখন কেউ প্রশ্ন তোলেনি কেন? এখন যদি বাউন্ডারি বেশি মারার জন্য ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, সেটা ঠিক হবে না। সামনের দিকে তাকিয়ে বলা যেতে পারে, নিশ্চয়ই নিয়মের এই দিকটা নিয়ে নিয়ামক সংস্থা ভেবে দেখবে। অন্তত নক-আউট পর্বে এসে যাতে নিয়মের নির্মমতার শিকার না হতে হয়, সেটা ভেবে দেখা হবে। এ বারের জন্য তো আর কিছু করার নেই। যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে।

বরং আম্পায়ারিংয়ের যে গলদের প্রশ্নটা উঠেছে, ওভারথ্রো থেকে এক রান বেশি দেওয়ার, সেটা হওয়া উচিত হয়নি। মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে, আম্পায়ারেরাও মানুষ। কিন্তু এখন তো প্রযুক্তি এসে গিয়েছে। টিভি আম্পায়ারের সাহায্য নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর পরেও এ রকম ভুল হবে কেন? তা-ও আবার ফাইনালের মতো ম্যাচে এবং খেলার ভাগ্য গড়ে দেওয়ার মতো একটা পরিস্থিতিতে!

আমার মনে হয়, যোগ্য দল হিসেবেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে। চার বছর ধরে ওরা তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তটার জন্য। অস্ট্রেলিয়ায় গত বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ওরা। তার পরে টিমটাকে ঢেলে সাজিয়েছে। প্রত্যেকটা জায়গার জন্য সেরা ক্রিকেটারদের খুঁজে এনে তাঁদের তৈরি করে বিশ্বকাপের দল সাজিয়েছে। এই মুকুট ওদের অবশ্যই প্রাপ্য। একই সঙ্গে নিউজ়িল্যান্ডের জন্য খারাপ লাগতেও বাধ্য। অসাধারণ লড়েছে ওরা। আমার মতে কেন উইলিয়ামসন মাঠে এবং মাঠের বাইরে এখন বিশ্বের সেরা ক্যাপ্টেন। শুধু নিজের দলের হয়ে ব্যাট হাতে একা কুম্ভই হয়ে ওঠেনি, দারুণ নেতৃত্বও দিয়েছে। দু’দলের মধ্যে লর্ডসে কোনও ব্যবধানই ছিল না। বলতেই হবে, শেষে গিয়ে ভাগ্য ইংল্যান্ডের সঙ্গী হয়েছে। তবু ওদের কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়া যাবে না। গোটা টুর্নামেন্টে ওরা ভাল ক্রিকেট খেলছে।

এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা ইংল্যান্ড টিম। অইন মর্গ্যানের মতো নতুন, তরুণ অধিনায়ক এনে নতুন যুগের সূচনা করতে চেয়েছে। বোলিং বিভাগকে কী দারুণ ভাবে সাজিয়েছে দেখুন। ফাস্ট বোলিং বিভাগে দু’জন ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করার লোক আছে। জোফ্রা আর্চার এবং মার্ক উড। তার পরে লিয়াম প্লাঙ্কেট আর বেন স্টোকস আছে। তৃতীয় পেসার হিসেবে ক্রিস ওকস। দুর্দান্ত সিম বোলার। প্রত্যেকটা ম্যাচে শুরুতে উইকেট দিয়েছে ওকস। হয়তো এক্সপ্রেস গতি নেই, কিন্তু ইংল্যান্ডের পরিবেশে দারুণ কার্যকরী মিডিয়াম পেসার। এর সঙ্গে স্পিন বিভাগে আদিল রশিদ আর মইন আলি। সব দিকে সম্পূর্ণ বোলিং আক্রমণ। তার সঙ্গে ব্যাটিংয়ে অমন গভীরতা এবং দুর্দান্ত সব পাওয়ারহিটার। যারা ভয়ডরহীন ভাবে খেলতে পারে। বেন স্টোকসে দেখুন। আমি বোথাম, ইমরান, কপিল, হ্যাডলি যুগের ক্রিকেটার। ফাইনালে স্টোকসের পারফরম্যান্স দেখে আমার মনে হচ্ছে, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের এক জন হয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে ওর। যে ছেলেটা রাস্তায় মারামারি করে হাজতবাস করতে যাচ্ছিল, ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ ওভারে চারটে ছক্কা খাওয়ার মতো অভিশাপ যার মাথায় চেপে ছিল, সে-ই কি না বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডের জয়ের নায়ক। লর্ডসের ফাইনাল দেখিয়ে দিল, বেন স্টোকস শুধু শারীরিক ভাবে শক্তিশালী এক ক্রিকেটার নয়, ওর মানসিক জোরও শ্রদ্ধা করার মতো।

মাঠে নেমে নিজেদের উন্মুক্ত মনে মেলে ধরো— এটাই ছিল নতুন ইংল্যান্ডের ওয়ান ডে মন্ত্র। এত খোলামেলা মনোভাব নিয়ে কোনও ইংল্যান্ড দলকে আমি খেলতে দেখিনি। ওদের এই নতুন মন্ত্রই কিন্তু কাপ জেতাল। বিরানব্বইয়ে ইংল্যান্ডকে হারিয়েই আমরা বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। সেই দলটাতে গ্রাহাম গুচ আর ইয়ান বোথাম ওপেন করত। আলেক স্টুয়ার্ট, গ্রেম হিক, নীল ফেয়ারব্রাদার, অ্যালান ল্যাম্ব, ক্রিস লুইস ছিল। বেশ গভীরতা ছিল ওদের ব্যাটিংয়ে। ডেরেক প্রিঙ্গল নামত নয় নম্বরে। তবু আমি বিশ্বকাপ জয়ী এই ইংল্যান্ড দলকে অনেক এগিয়ে রাখব।

বিরাট কোহালিদের নিশ্চয়ই ফাইনালটা টিভিতে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই দিনটায় আমাদের থাকার কথা ছিল লর্ডসে! সত্যিই ওরা খুব ভাল দল হিসেবে বিশ্বকাপে এসেছিল। শুধু মিডল অর্ডারটা ঠিক করে নিয়ে আসতে পারেনি। হয়তো বিরাটরা ভেবেছিল, তরুণরা তৈরি হয়ে যাবে। খেলে দিতে পারবে। সেই ধারণা মেলেনি। ক্রিকেট এ ভাবেই শিক্ষা দেয় কখনওসখনও। দেখার এটাই যে, কে কত তাড়াতাড়ি শিক্ষা নিয়ে ভুলগুলো মেরামত করতে পারে। আমি নিশ্চিত, বিরাট ফিরে গিয়ে সেই ময়নাতদন্ত করে আবার ওর দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে। বিরাটের খিদে, দায়বদ্ধতা, ফিটনেস নিয়ে পরিশ্রম, জেদ এবং স্কিলের কোনও তুলনা নেই। ওর সঙ্গে কোচ রবি শাস্ত্রীর বোঝাপড়াটাও দারুণ। আমার মতে, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় প্রশাসকরা কোচ-অধিনায়কের জুটিকে ভেঙে ফেলতে চাইলে, বিরাট ভুল করবেন।

উপমহাদেশের ক্রিকেটার বলে জানি, বিশ্বকাপের পরে কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা করার চেষ্টা করা হয়। সব চেয়ে সহজ টার্গেট হতে পারে কোচ। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, ২০১৪-তে শাস্ত্রী কোচ হয়ে আসার পরের থেকে কী ভাবে দলটাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। বিরাট তখন একেবারেই তরুণ আর কাঁচা ছিল। আজকের এই বিরাট কোহালিকে ধৈর্য ধরে তৈরি করেছে শাস্ত্রীই। পুরো দলটাকে নতুন করে সাজিয়েছে। না হলে সেই সময় বিদেশি কোচ ডানকান ফ্লেচারের অধীনে অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ধুঁকছিল ভারতীয় দল। সেখান থেকে ধোনি পরবর্তী যুগের অধিনায়ক হিসেবে বিরাটকে তৈরি করা এবং যুগ বদলের চ্যালেঞ্জ সামলানো। আমি একটা হিসাব দেখছিলাম যে, গত তিন বছরে শাস্ত্রী-কোহালির অধীনে প্রায় সত্তর শতাংশ ওয়ান ডে ম্যাচ জিতেছে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বার ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জিতেছে, ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজ়িল্যান্ডে। বিশ্ব ক্রিকেটে বিরাটের ভারত এখন সব চেয়ে ধারাবাহিক টিমগুলোর একটা।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হেরে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া তো হবেই। ময়নাতদন্তও হওয়া দরকার। কিন্তু বলির পাঁঠা যেন খোঁজা না হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy