Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
মহারণের আগে পাক অলরাউন্ডার মুদাস্সার নজরের একান্ত সাক্ষাৎকার

ভারত ফেভারিট, পাক অস্ত্র বোলিং

পঁচাশির মেলবোর্নে ঐতিহাসিক বেনসন অ্যান্ড হেজেস ফাইনালে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিপক্ষ। পঞ্চাশ ওভারের কোনও বিশ্ব মানের টুর্নামেন্টে সেটাই ছিল একমাত্র ভারত-পাক ফাইনাল। প্রাক্তন পাক অলরাউন্ডার মুদাস্সার নজর ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।

পাকিস্তান লড়াই করবে, বিশ্বাস মুদাস্সারের।

পাকিস্তান লড়াই করবে, বিশ্বাস মুদাস্সারের।

সুমিত ঘোষ
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০৪:৩৮
Share: Save:

ভারতের বিরুদ্ধে ১৮ টেস্টে তাঁর মোট রান ১৪৩১। গড় ৬২.২১। দাঁড়ান, ছ’টা সেঞ্চুরিও আছে। আর কে ভুলতে পারবে তিরাশির জানুয়ারিতে সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদের সেই অভিশপ্ত টেস্ট। সুনীল গাওস্করের ভারত যে টেস্ট হারে ইনিংস ও ১১৯ রানে। ম্যাচটা বিখ্যাত হয়ে আছে জাভেদ মিয়াঁদাদের ২৮০ নট আউট এবং তাঁর ২৩১ রানের ম্যারাথন ইনিংসের জন্য। একদিনের ক্রিকেটে এতটা সাফল্য না থাকলেও ব্যাট হাতে ইনিংস গড়ার দক্ষতা এবং স্লো মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের প্যাকেজ নিয়ে খুবই উপযোগী ওয়ান ডে ক্রিকেটারের মশলা ছিল। পঁচাশির মেলবোর্নে ঐতিহাসিক বেনসন অ্যান্ড হেজেস ফাইনালে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিপক্ষ। পঞ্চাশ ওভারের কোনও বিশ্ব মানের টুর্নামেন্টে সেটাই ছিল একমাত্র ভারত-পাক ফাইনাল। ২০০৭-এ ধোনি বনাম মিসবার টিমের ফাইনাল ছিল টি-টোয়েন্টির। প্রাক্তন পাক অলরাউন্ডার মুদাস্সার নজর ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।

আরও পড়ুন: গাড়ি ঘিরে ধরলেন পাক-সমর্থকরা, কীভাবে সামলালেন সৌরভ? দেখুন...

প্রশ্ন: রবিবারের ফাইনাল নিয়ে আপনার পূর্বাভাস কী?

মুদাস্সার নজর: পূর্বাভাস করতে চাই না। আমি কী আশা করছি, সেটা বলতে পারি। আমি আশা করছি, গ্রুপ লিগের ম্যাচটার থেকে কাল বেশি লড়াই হবে। আশা করছি গ্রুপ লিগের চেয়ে ভাল একটা ম্যাচ দেখতে পাব। এজবাস্টনে প্রথম ম্যাচটায় ভারত একপেশে ভাবে জিতেছিল। সেটা ফাইনালে হবে না বলে মনে করছি।

প্র: মানে রবিবারের ফাইনালে ভারতকেই এগিয়ে রাখছেন?

মুদাস্সার: ভারতই ফেভারিট ফাইনালে। অস্বীকার করার কোনও জায়গা তো নেই। আমাদের জন্য ভাল লক্ষণ হচ্ছে, শেষ তিনটে ম্যাচে খুব ভাল খেলে জিতেছে পাকিস্তান। আমরা আশা করব, সেই তিনটে জয় থেকে দারুণ আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছে আমাদের দল। যদি সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে বুক উঁচিয়ে ওরা ফাইনালের মাঠে প্রবেশ করতে পারে, তা হলে কে বলতে পারে, অঘটন ঘটিয়ে ওরা ট্রফি জিতবে না!

প্র: যদি এক কথায় বলতে অনুরোধ করি, কারা জিতবে ফাইনালে? কী বলবেন?

মুদাস্সার: ভারতই এগিয়ে। পাকিস্তানকে জিততে হলে নিজেদের ছাপিয়ে যেতে হবে।

প্র: এতটা কেন এগিয়ে রাখছেন ভারতকে? কী ওদের শক্তি?

মুদাস্সার: কী শক্তি মানে! ভারতের প্রথম তিন জন ব্যাটসম্যানকে দেখুন। রোহিত শর্মা, শিখর ধবন, বিরাট কোহালি। যে কোনও এক জন দাঁড়ালে, খেলা শেষ করে দিতে পারে। যেমন ওরা ইনিংস গড়তে পারে, যেমন ধরতে পারে, তেমনই আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারে। কী দুর্ধর্ষ কোয়ালিটি! আমি এত শক্তিশালী ‘টপ থ্রি’ খুব কম দেখেছি।

প্র: আর কী আছে ভারতের?

মুদাস্সার: দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি এখনও শেষ করিনি। শুধু ‘টপ থ্রি’-ই তো নয়, তার পরেও ব্যাটিং অর্ডারে ওদের যুবরাজ আছে। ধোনি আছে। ওদের ফিল্ডিং ভাল। বোলিং ভাল। দুর্বলতার জায়গা অনেক কম। রুটিন হিসেবে ভারত অনেক শক্তিশালী দল। এটা বলতেই হবে। তবে পাকিস্তানের দিক থেকেও ইতিবাচক হওয়ার কারণ আছে। কারণ, এই টুর্নামেন্টে ওদের চেয়ে কাগজে-কলমে শক্তিশালী দলকে কিন্তু ওরা হারিয়েছে। পাকিস্তানকে হারিয়েছে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে। সরফরাজদের কাছে তাই আর একটা দিনের ও রকম অবিশ্বাস্য ক্রিকেট চাইছে গোটা পাকিস্তান।

প্র: সেটা কি সম্ভব?

মুদাস্সার: অবশ্যই সম্ভব। আরে, ক্রিকেট খেলাটায় তো এটাই মজার ব্যাপার। সব সময় তো আপনি ফেভারিট হিসেবে নামবেন না। হিসেব উল্টে দিয়ে জেতাটাও খেলাধুলোর অঙ্গ। ম্যাচটার পুরো পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ওভার তো বাকি!

প্র: ঐতিহাসিক ভাবে ভারত বনাম পাকিস্তান মানে ভারতীয় ব্যাটিং বনাম পাক পেস বোলিংয়ের লড়াই। রবিবারের ফাইনালও কি তাই?

মুদাস্সার: হ্যাঁ, এ বারেও তাই। ওয়াসিম, ওয়াকার বা তার পরে শোয়েবদের আমলে পাকিস্তান বোলিং ভারতকে চাপে রাখত। এ বারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও পাকিস্তানের বোলিংয়ই ওদের ফাইনালে তুলেছে। তেমনই ভারতীয় ব্যাটিং দুর্ধর্ষ ফর্মে রয়েছে।

প্র: আপনি নিজে অনেক ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ খেলেছেন। এই দ্বৈরথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর কী?

মুদাস্সার: স্নায়ুর চাপ যারা ভাল সামলাতে পারবে, তাদের বেশি ভাল করার সুযোগ থাকে। ম্যাচের শুরুটা ভাল করতে পারলে অ্যাডভ্যান্টেজ পাওয়া যায়। আর স্নায়ুর চাপটা কিন্তু ওভালে দু’টো দলেরই সমান থাকবে। তার কারণ, খেলাটা নিরপেক্ষ মাঠে হচ্ছে। যদি পাকিস্তানে খেলা হয়, তা হলে দর্শকরা পাকিস্তানকে সমর্থন করে। তখন ভারতের চাপ বেশি। আবার যখন ভারতে খেলা হয়েছে, পাকিস্তান বেশি চাপে থেকেছে কারণ পুরো দর্শক সমর্থনই ছিল ভারতের দিকে। এখানে ফিফটি-ফিফটি। লন্ডনে যেমন ভারতের সমর্থক আছে, তেমনই প্রচুর পাকিস্তানি ভক্তও আছে। সেই কারণে ফাইনালের জন্য দু’টো দলের সমর্থকরাই থাকবে।

প্র: দু’টো দলের প্রধান দু’তিন জন ক্রিকেটারকে বাছতে বললে কাদের বাছবেন? যাঁরা হতে পারেন রবিবারের গেমচেঞ্জার?

মুদাস্সার: এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের শক্তি কিন্তু টিমগেম। ওদের জিততে গেলে দলগত ভাবে ভাল খেলতে হবে। চার-পাঁচ বা এমনকী, ছ’সাত জন মিলে অবদান রেখে দলকে জেতাতে হবে।

প্র: আর ভারতের ক্ষেত্রে?

মুদাস্সার: টপ থ্রি তো বললামই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই বিরাট কোহালি। আমি ছেলেটাকে দেখে মুগ্ধ। বিরাট যে অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান, এখনকার ক্রিকেট বিশ্বের সেরাদের এক জন— এ সব সকলেই জেনে গিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ওর মাহাত্ম্য অন্য জায়গায়। চাপের মধ্যেও কী দুর্ধর্ষ রেকর্ড ওর! ওয়ান ডে-তে সতেরোটা সেঞ্চুরি করেছে রান তাড়া করার সময়। এবং, আশি শতাংশের বেশি ম্যাচে ‘চেজ’ করে ম্যাচ জিতিয়েছে। ওটাই গ্রেট ক্রিকেটারের গুণ।


চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও কি এ ভাবে মুঠোয় ধরবেন? ফাইনালের আগে অনুশীলনে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। শনিবার ওভালে। ছবি: রয়টার্স

প্র: অনেক বড় বড় ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে আপনি খেলেছেন। তাঁদের আন্দাজে কোহালিকে কোথায় রাখবেন?

মুদাস্সার: শুনুন, প্রথমেই বলি আমাদের সময়কার ভারতীয় দলের ব্যাটিংও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ভারতের ওই টিমটায় কিরমানি নামত নয় নম্বরে। এবং, অত নীচে নেমেও নিয়মিত ভাবে রান করত কিরি। সেটা থেকেই বোঝা যায়, তখনকার দিনেও ভারতীয় ব্যাটিংয়ে কী রকম গভীরতা ছিল। সানি, ভিশি, সচিন, রাহুল... ভারত থেকে যুগ যুগ ধরে বিশ্বমানের সব ব্যাটসম্যান বেরিয়েছে। বিরাট সেই তালিকায় খুব উজ্জ্বল সংযোজন। আমি মনে করি ভারতের সর্বকালের সেরাদের মধ্যে গণ্য হওয়ার দক্ষতা রয়েছে বিরাটের। হয়তো টেস্ট ম্যাচে ওকে আরও পথ যেতে হবে। কিন্তু ওয়ান ডে-তে ইতিমধ্যেই বিরাট ‘গ্রেটেস্ট’-দের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দ্রুততম আট হাজার রানও করে ফেলল। আমি অবাক হব না, একেবারেই অবাক হব না, যদি দেখি ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করছে বিরাট। ভীষণ দায়বদ্ধ, ফোকাস্ড। জেতার জন্য সব কিছু দিয়ে দিতে পারে। এ রকম প্লেয়ার একটা টিমের সম্পদ।

প্র: পঁচাশির মেলবোর্নে সেই ফাইনালের কথা কতটা মনে আছে?

মুদাস্সার: ভাল রকমই মনে আছে। আমরা খুব বেশি রান করতে পারিনি। ম্যাচটা একপেশে হয়ে গিয়েছিল। ফিরে তাকালে মনে হয়, আমরা খুব স্লো ব্যাটিং করেছিলাম। ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং ইউনিটের সামনে অত কম রান করে জেতা সম্ভব ছিল না।

প্র: অনেকে মনে করেন, মেলবোর্নে সেই বেনসন অ্যান্ড হেজেস চ্যাম্পিয়নশিপেই প্রথম আজকের বিনোদনমূলক ক্রিকেটের বীজ বপন হয়েছিল। রবি শাস্ত্রীর সেই অডি গাড়ি পুরস্কার পাওয়া ছিল ক্রিকেটের উদারীকরণের প্রথম ধাপ।

মুদাস্সার: আমি এই কথাটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ওয়ান ডে ক্রিকেটকে পাল্টে দিয়ে গিয়েছিল পঁচাশির বেনসন অ্যান্ড হেজেস চ্যাম্পিয়নশিপ। ওই টুর্নামেন্ট থেকেই ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে তুলে তুলে বল মারার অভিনবত্ব দেখাতে শুরু করল ব্যাটসম্যানরা। স্পিনার আর স্লো বোলারদের ভূমিকা বেড়ে গেল। সেই টুর্নামেন্টেই তো প্রথম চালু হল এই ভাবনাটা যে, যত পারো মাল্টি টাস্কিং প্লেয়ার দলে নাও। ব্যাট করবে, কিন্তু বলটাও কয়েক ওভার করে দিতে পারবে। এখন তো এই জিনিসগুলোই চলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ফিল্ডিংয়ে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল ওই টুর্নামেন্টেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE