Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

হার্দিকের দাপটে ট্রেন্ট ব্রিজে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন কোহালিরা

মাত্র পাঁচ ওভারের একটা স্পেলে হার্দিক ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংকে।

স্মারক: ইনিংসের বল হাতে হার্দিক। রবিবার ট্রেন্ট ব্রিজে। ছবি: এএফপি।

স্মারক: ইনিংসের বল হাতে হার্দিক। রবিবার ট্রেন্ট ব্রিজে। ছবি: এএফপি।

সুমিত ঘোষ
নটিংহ্যাম শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৫৫
Share: Save:

সুনীল গাওস্কর এবং কপিল দেব— ভারতীয় পেস বোলিং ইতিহাসের বিপরীতধর্মী দুই মুখ। গাওস্কর শুধু নতুন বলের সামনে ব্যাট হাতেই দাঁড়াননি, বোলার হিসেবে নতুন বল ব্যবহারও করেছেন।

তখন ভারত অধিনায়কদের কাছে নতুন বল মানে আশীর্বাদ নয়, ছিল অভিশাপ। গাওস্করের মতো ব্যাটসম্যানদের হাতে বল তুলে দিয়ে পালিশটা তুলিয়ে নাও। তার পরে সামান্য পুরনো হওয়া বল তুলে দাও বেদী, চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন, বেঙ্কটের হাতে। স্পিনের মায়াজাল বুনে তাঁরা যদি প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে পারেন, তবেই ভারত জিতবে। কোনও এক কপিল দেবের আবির্ভাব প্রথম স্পিনের দেশকে শেখায় পেসারের জন্য গলা ফাটাতে।

রবিবারের ট্রেন্ট ব্রিজে বসে মনে হচ্ছিল, স্পিন থেকে পেসের দেশ হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটের সম্পূর্ণ বিবর্তন বোধ হয় ঘটেই গেল। দশ উইকেটের দশটাই নিলেন জোরে বোলারেরা। একমাত্র স্পিনার অশ্বিন এক ওভারের বেশি বল পেলেন না। এবং, অশ্বিনের ফিটনেস নিয়ে উদ্বেগ এর পিছনে প্রধান কারণ বলে মনে হয় না। অশ্বিনের কোমরের নীচের দিকে একটা চোট ধরা পড়েছে বলে ভারতীয় দল সূত্রে জানা গেল। মাঝখানে বেশ খানিক্ষণ তিনি মাঠে ছিলেন না। ট্রেন্ট ব্রিজের ইন্ডোরে ফিজিয়ো প্যাট্রিক ফারহার্টকে নিয়ে গিয়ে বল করেও দেখেন, ব্যথা হচ্ছে কি না। তার পরে মাঠে ফিরে এলেও বল করেননি। হার্দিক পাণ্ড্যরা তখন এমনই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যে, কোহালির আর তাঁর সেরা স্পিনারকে দরকার পড়েনি। দ্বিতীয় ইনিংসে খারাপ হতে থাকা উইকেটে বড় রানের বোঝা চাপিয়ে ইংল্যান্ডকে হারানোর রাস্তায় অশ্বিনকে কাজে লাগাতে পারেন কোহালি। তখন সুস্থ অশ্বিনকে হাতে পাওয়ার প্রার্থনা করবে ভারত।

শাসন: রুট ফিরতেই বিরাট কোহালির উচ্ছ্বাস।ছবি: এএফপি।

অতীতের কিছু ঐতিহাসিক ম্যাচের স্কোরকার্ড খুলে মেলাতে বসলে অবশ্য চমকপ্রদ তথ্য মনে পড়ে যেতে পারে। যেমন সদ্য প্রয়াত অজিত ওয়াড়েকরের অধিনায়কত্বে ১৯৭১-এর সেই ইংল্যান্ডে সিরিজ জয়ের টেস্ট ম্যাচ। ওভালের সেই টেস্টে ওয়াড়েকরের ফাস্ট বোলার কারা ছিলেন? হ্যারল্ড লারউডের শহরে বসে ভৌতিক শোনাতে পারে তাঁদের নাম। নতুন বলে শুরু করেন আবিদ আলি এবং একনাথ সোলকার। ওয়ান চেঞ্জ সুনীল গাওস্কর!

দিন পাল্টায়, বদলায় ক্রিকেট সংস্কৃতি। বেদী, প্রসন্ন, চন্দ্রের দেশ এখন ইংল্যান্ডের সামনে লেলিয়ে দিচ্ছে চার পেসার। মহম্মদ শামি, যশপ্রীত বুমরা, ইশান্ত শর্মার সঙ্গে অলরাউন্ডার হার্দিক পাণ্ড্য। তাঁরাই উড়িয়ে দিলেন ইংল্যান্ড ব্যাটিংকে। অ্যালেস্টেয়ার কুক এবং কিটন জেনিংস লাঞ্চ করতে গেলেন ৪৬-০ স্কোর নিয়ে। সেই রানটাও তাঁরা তুলেছেন মাত্র ৯ ওভারে। মানে ওভার প্রতি পাঁচ রানের বেশি করে স্কোরিং রেট। রীতিমতো দিশাহারা দেখাচ্ছিল তখন বোলিং বিভাগ এবং তাঁদের অধিনায়ককে।

মধ্যাহ্নভোজে হেড কোচ রবি শাস্ত্রী এবং বোলিং কোচ বি. অরুণ বসেছিলেন বোলারদের নিয়ে। তাঁদের বোঝান, ‘‘অনেক শর্ট অফ লেংথ বোলিং করছ। এখনও মেঘলা আকাশ রয়েছে। বল সুইং করবে। সিমও করবে। কিন্তু তার জন্য আরও উপরে বল করতে হবে।’’

কোচেদের ক্লাস করে দুর্দান্ত ভাবে ফিরে আসেন ভারতীয় বোলারেরা। লেংথ এবং লাইন ঠিক করতেই কুকদের অস্বস্তি বাড়তে শুরু করে। লাঞ্চে ইংল্যান্ড ছিল ৪৬-০। চা-পানের সময় ১৬১ অলআউট। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, যেন লর্ডসের ভারত হয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ড। মাত্র ৩৮.২ ওভার টিকল তাদের ইনিংস। এর মধ্যে ১১.৫ ওভার পর্যন্ত বিনা উইকেট ছিলেন কুকরা। এমন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া দেখে নাসের হুসেনরা পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে বলে ফেললেন, ‘‘ইংল্যান্ডের ব্যাটিং নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের ভরসা দেখাচ্ছিলাম আমরা। মোটেও খুব পোক্ত ব্যাটিং নয়।’’

এগারো বছর আগে রাহুল দ্রাবিড়ের দলের মতোই ট্রেন্ট ব্রিজে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে কোহালির দল। আর যিনি রবিবারের নায়ক হিসেবে সেই স্বপ্নের কারিগর হয়ে থাকলেন, তাঁর নাম হার্দিক পাণ্ড্য। যাঁকে কপিল দেবের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে বলে শুধুই ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো কেউ কেউ রাগত ভাবে বলেই ফেলেছেন, ‘‘কপিল দেবের মতো কিংবদন্তির সঙ্গে ওর তুলনা টানা বন্ধ হোক। ব্যাট না বল, কোনটা ও ঠিক মতো করতে পারে, তা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে।’’

কপিল দেবের সঙ্গে তুলনা নিশ্চয়ই এত সহজে করা যায় না। কিন্তু এটুকু বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি করা হবে না যে, ট্রেন্ট ব্রিজে বল হাতে হার্দিক যেন কপিলের সেই সুইং বোলিংয়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিলেন। মাত্র পাঁচ ওভারের একটা স্পেলে তিনি ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংকে। তাঁর বিষাক্ত আউটসুইং তো কেউ খেলতে পারছিলেনই না, হার্দিক মাঝেমধ্যে দারুণ বুদ্ধি করে ইনসুইং আর অফকাটারও মিশিয়ে দিচ্ছিলেন। পাঁচ উইকেটের মধ্যে সব চেয়ে দামি অবশ্যই ইংল্যান্ড অধিনায়কের উইকেট। হার্দিকের প্রথম বলেই স্লিপে ক্যাচ নিলেন কে এল রাহুল। যদিও পরিষ্কার ভাবে ক্যাচটা নেওয়া হয়েছে কি না, পরীক্ষা করতে চাইলেন আম্পায়ারেরা। দেখা গেল, বল যখন রাহুল তালুবন্দি করছেন, তাঁর আঙুল বলের নীচে মাটি ছুঁয়ে আছে। ধুকপুকানি বাড়িয়ে দেওয়া কয়েকটি মুহূর্তের অবসান ঘটিয়ে টিভি আম্পায়ার জানালেন, আউট। কোহালিদের উৎসবের মধ্যে রুটকে দেখে মনে হল না, প্রসন্ন হয়েছেন।

ভারতীয় দলের শরীরী ভাষাই পাল্টে গেল রুটের উইকেটে। হার্দিক এর পর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন। কোহালি স্বভাবসিদ্ধ আগ্রাসী মেজাজ বের করলেন, চিৎকার করে বোলারদের তাতাতে থাকলেন আর চোখ বড় বড় করে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ঘাড়ের উপরে এসে ‘কাম অন গাইস, কাম অন গাইস’ করতে থাকলেন। যত বাড়ল চাপ, তত তুবড়ে যেতে থাকল ইংল্যান্ড।

স্টুয়ার্ট ব্রড ব্যাট করতে আসার সময়ে হার্দিক হ্যাটট্রিকের মুখে। বলে না, ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা! এ মাঠেই টেস্ট হ্যাটট্রিক আছে ব্রডের। আর তিনিই কি না এ দিন নামলেন হ্যাটট্রিক বাঁচাতে। ব্রড ক্রিজে আসামাত্র কোহালিকে দেখা গেল বিশেষ ভঙ্গিতে ‘স্বাগত’ জানাচ্ছেন। এগিয়ে এলেন ইশান্ত শর্মাও। বোঝা গেল, টসের সময়ে তাঁর নাকের ডগায় এসে বোলিং শ্যাডো করাটা ঠিক ভাবে নেয়নি ভারতীয় শিবির। এ বার তাঁরা ফিরিয়ে দিতে চায়।

দিনের শেষে দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ১২৪-২। কোহালিরা এগিয়ে গিয়েছেন ২৯২ রানে। হাতে আট উইকেট থাকা অবস্থায় যা অনেক দূর পর্যন্তই যেতে পারে। অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান চেতেশ্বর পূজারা এবং কোহালি যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, তাঁদের মাথার উপরে মেঘলা আকাশ সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ।

কোহালি এক বার সেই আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখলেন। তার পর পূজারার কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে গেলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। ব্যালকনিতে অপেক্ষা করছে গোটা দল। ট্রেন্ট ব্রিজের আকাশের মতোই ঘুরতে শুরু করেছে সিরিজে কোহালিদের ভাগ্য!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE