বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ ইউক্রেন
ফুটবল ভালবাসেন তিনি। সব ঠিকঠাক থাকলে রবিবার রাতে কার্ডিফ স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে হয়তো দেখা যেত তাঁকে। সেই ‘সৌভাগ্য’ অবশ্য হয়নি ভলোদিমির জেলেনস্কির। দেশের ফুটবল দল যখন সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে নামছে, তখন তিনি ছিলেন ৩,৪৮৬ কিমি দূরে ডনবাসে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ব্যস্ত ছিলেন দেশজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেখা করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলতে-থাকা যুদ্ধের আগামী রণনীতি সাজাতে। ছক কষছিলেন, কী ভাবে রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রাখা যায়!
এ এক কাকতালীয় ঘটনাই যে, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে এখনও পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখলেও ফুটবল মাঠের যুদ্ধে ওয়েলসের কাছে হেরে গেল জেলেনস্কির দেশ। কার্ডিফের বৃষ্টিস্নাত মাঠে ওয়েলসের কাছে হেরে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল ইউক্রেনের। তবে ফুটবলাররা মাঠ ছাড়ার আগে প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছেন, নতুন লড়াইয়ের শুরুও এখান থেকেই!
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল। তার পর কেউ ভাবতে পারেননি, দেশটা বিশ্ব ফুটবলে এতদূর এসে পৌঁছবে। ঘরোয়া লিগ বন্ধ, জাতীয় ফুটবল বন্ধ, একের পর এক মাঠ নষ্ট করে দিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। কোথাও অনুশীলনের জায়গা নেই। প্রাণে বাঁচতে পালাতে হচ্ছে অন্য দেশে। রাতারাতি ইউক্রেনীয় ফুটবলারদের স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত যোগ্যতা অর্জন পর্বে খুব একটা খারাপ খেলেনি ইউক্রেন। দু’টি প্লে-অফ জিতলেই বিশ্বকাপের ছাড়পত্র মিলত। কিন্তু প্লে-অফ খেলবেন কোথায় তাঁরা? নিজেদের মাঠই তো নেই! তখন একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের ছবির মতো যে মাঠে ২০১২ সালের ইউরো কাপ হয়েছিল, সেই মাঠের এখনকার অবস্থা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
ইউক্রেনের মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়েছিল ফিফা। মার্চের প্লে-অফ পিছিয়ে জুনে করা হয়। প্রথম প্লে-অফ ম্যাচ যাদের বিরুদ্ধে ছিল, সেই স্কটল্যান্ড তাদের দেশের দরজা খুলে দিয়েছিল। ইউক্রেনকে বলেছিল, তাদের দেশে এসে অনুশীলন করতে, যেখানে ভয়ের কোনও পরিবেশ নেই। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন আন্দ্রেই ইয়ারমোলেঙ্কো, ওলেকজান্ডার জিনচেঙ্কোরা। স্কটল্যান্ডের মাটিতে ইউক্রেন তাদের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ করে দেওয়ার পরেও স্কটিশদের আতিথেয়তায় কোনও খামতি ছিল না। স্কটল্যান্ড ফুটবল সংস্থা ম্যাচের পর বলেছিল, ‘মাঠের ওই ৯০ মিনিটই আমরা শত্রু। বাকি সময়টা আমরা বন্ধু।’ গ্লাসগোর হ্যাম্পডেন পার্কে দেশীয় সমর্থকদের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি স্কটিশদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি ইউক্রেনীয় ফুটবলাররা।
রবিবার সেই আনন্দ বদলে গেল হতাশায়। ম্যাচের পর অঝোরে কাঁদছিলেন ইউক্রেনের তারকা ফুটবলার ইয়ারেমচুক। বৃষ্টি পড়ছিল তুমুল বেগে। তা সত্ত্বেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তাঁর চোখের জল। বুঝতে পারছিলেন গ্যালারির হাজার দুয়েক সমর্থকও। তাঁরাও নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারেননি। একটা গোটা দেশের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিল ফুটবল। হাজার চিন্তার মাঝেও অনেককে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছিল। স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বার্তা পাঠিয়েছিলেন ফুটবলারদের। ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ‘দু’ঘণ্টার আনন্দ’ দেওয়ার জন্য।
ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়তে-থাকা সেনাবাহিনীর বার্তাও পেয়েছিলেন ইউক্রেনের ফুটবলাররা। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলেও রবিবার কিছুক্ষণের জন্য তাঁদেরও চোখ ছিল ফুটবল ম্যাচের দিকে। পাল্টা বার্তা গিয়েছিল ফুটবলারদের তরফেও। ডিফেন্ডার রুসলাম মালিনোভস্কি বলেছিলেন, “দেশবাসীর কথা আমরা প্রতিটা মুহূর্তে ভাবি। ওঁদের সামান্য আনন্দ দিতে পেরেছি, এটা ভেবেই আমি খুশি। সেনাবাহিনী যেমন দেশে নিজেদের কাজ করছে, তেমনই ফুটবল মাঠে আমরাও নিজেদের কাজটা ঠিক করে করব।”
এ যাত্রায় স্বপ্নপূরণ হয়নি। তবে স্বপ্নের কাছাকাছি অন্তত পৌঁছনো গিয়েছে, এই ভেবেই আপাতত স্বস্তি পেতে পারেন তাঁরা। ভাগ্যদেবতা যে ইউক্রেনের দিকে ছিলেন না, এমন নয়। কার্ডিফ থেকেই হাসিমুখেই ফেরার কথা ছিল ইউক্রেনের। বাধা হয়ে দাঁড়াল একের পর এক সুযোগ নষ্ট। মরণবাঁচন ম্যাচে এত সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হবেই। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে আত্মবিশ্বাসী ইউক্রেনকে দেখা গিয়েছিল, সেটা ওয়েলসের বিরুদ্ধে দেখা গেল না। ম্যাচের একমাত্র গোলটিও হল ইউক্রেনের ফুটবলারের ভুলেই। গ্যারেথ বেলের ফ্রিকিক আটকাতে গিয়ে নিজের গোলেই বল ঢুকিয়ে দিলেন আন্দ্রেই ইয়ারমোলেঙ্কো। স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাচের পর সবচেয়ে হতাশ লাগছিল তাঁকে। মাঠের এক ধারে গিয়ে কাঁদছিলেন। তবে শেষের দিকে বাকি সতীর্থদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধন্যবাদ জানালেন সমর্থকদের।
ইউক্রেনের লড়াই শেষ হয়নি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। পরের বিশ্বকাপে যাওয়ার লড়াইও শুরু হয়ে গেল রবিবার থেকেই।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy