সুভাষ ভৌমিক। ফাইল ছবি
প্রায় সব ফুটবলারের কাছেই তিনি ছিলেন ‘পিতৃসম’। বকতেন, কথা শোনাতেন, কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে তাঁদের বুকে জড়িয়েও ধরতেন। বকলমে এটাই ছিলেন কোচ সুভাষ ভৌমিক। শনিবার তাঁর প্রয়াণে স্বাভাবিক ভাবেই অ্যালভিটো ডি’কুনহা, রহিম নবি, সুনীল ছেত্রীরা প্রিয়জনকে হারালেন।
ফুটবল খেলে বিখ্যাত হওয়ার পরেই কোচিং জীবনে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু খেলার সম্পর্কে অসাধারণ পাণ্ডিত্যই বাকিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল তাঁকে। বয়স হয়ে গেলেও রাতের পর রাত জেগে বিদেশের ফুটবল খেলা দেখতেন। যতটা সম্ভব শিখতেন। সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতেন ফুটবলারদের মধ্যে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে কিছুদিন আগে পর্যন্তও একের পর এক কলাম লিখেছেন। সেখানেই বোঝা যেত, কতটা খুঁটিয়ে দেখতেন ম্যাচগুলি।
কোচি হিসেবে কী করে ফুটবলারদের থেকে সেরাটা আদায় করে নেওয়া যায়, তা সুভাষের থেকে ভাল আর কেউ জানতেন না। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে সফল হওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল। দলের মধ্যে একটা পরিবারের মতো পরিবেশ তৈরি করে রাখতেন। সব ফুটবলারের সঙ্গেই সমান ব্যবহার করতেন। যে কারণে ম্যাচে নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য ঝাঁপাতেন তাঁর দলের খেলোয়াড়রা। ফুটবলারদের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল সুভাষের। ফুটবল সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান ছিল। বিভিন্ন ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষের সম্পর্কে ভাল করে পড়াশোনা করে নিতেন তিনি। তারপর সেই অনুযায়ী ফুটবলারদের প্রস্তুত করাতেন। খেলার বিশ্লেষণ করতেও তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না।
পাকা জহুরির মতোই ময়দান থেকে প্রতিভা তুলে আনতে তাঁর কোনও বিকল্প ছিল না। সৈয়দ রহিম নবিই যেমন। ফুটবল জীবনের শুরুতে স্ট্রাইকার হিসাবে খেলতেন নবি। সেখান থেকে আক্রমণাত্মক উইং-ব্যাক হিসাবে নবিকে তৈরি করেন সুভাষ। সেই পজিশনে খেলেই জীবনের সোনালি সময় কাটিয়েছেন নবি। জাতীয় দলেও এই পজিশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিলেন। তিনিই ভারতের প্রথম কোচ হিসেবে তিন ব্যাকে দলকে খেলিয়েছেন। তাঁর কোচিংয়ে যে কোনও দলের ফুটবল খেলা দেখতেই অসাধারণ লাগত। বিশেষত দুই প্রান্ত যে ভাবে তিনি কাজে লাগাতেন তা অসাধারণ ছিল।
ইউরোপীয় ফুটবল সম্পর্কে দুর্দান্ত ধারণা থাকায় কলকাতার ফুটবলে তিনি সেই প্রক্রিয়া আমদানি করা শুরু করেন। ইউরোপের পেশাদার ক্লাবগুলি যে ভাবে অনুশীলন করে, সেই জিনিসই ইস্টবেঙ্গলে দেখা যেতে থাকে। তাঁর উদ্যোগে ক্লাবে প্রথম বসে জাকুজি। ফুটবলারদের ফিটনেস অন্য পর্যায়ে পৌঁছে যায় সুভাষের উদ্যোগে। ফুটবলাররা প্রথম বার পাঁচতারা হোটেলে থাকা শুরু করেন। সেখানে জিমন্যাশিয়ামের ব্যবহার এবং নিজেদের ফিটনেস ঠিক রাখার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ম্যান ম্যানেজমেন্ট ছিল তাঁর আর একটা বড় গুণ। কী ভাবে, কোন ফুটবলারের থেকে নিজের সেরাটা বের করে আনতে হবে সেটা তাঁর থেকে ভাল আর কেউ জানতেন না। ২০০৩ সালে আশিয়ান কাপ জয়ই হোক বা টানা দু’বার লাল-হলুদকে জাতীয় লিগ দেওয়া, প্রত্যেক বারই সাফল্যের পিছনে আসল কৃতিত্ব ছিল তাঁর অসাধারণ ম্যান ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতির।
কোচিং থেকে বেশ কিছুদিন বিরতি নেওয়ার পর তিনি ২০১২ সালে গোয়ার ক্লাব চার্চিল ব্রাদার্সে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ততদিনে কোচ হিসেবে কলকাতা ময়দানে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুটা কমেছে। কিন্তু গোয়ায় গিয়ে তিনি যে চার্চিলকে নিয়ে এ ভাবে জাদু দেখাবেন, তা সম্ভবত কেউই ভাবতে পারেননি। অখ্যাত বেলাল, আক্রম মোঘরাবিকে নিয়ে মাত করে দেন কলকাতার দুই প্রধানকে। সেই সময় ওই দলে ছিলেন সুনীল ছেত্রীও।
বর্তমান জাতীয় দলের অধিনায়ক তথা বেঙ্গালুরু এফসি ফুটবলার সুনীলের জীবনেও তাঁর অবদান অসামান্য। কলকাতা ময়দানে খেলার সময় সুনীল সে ভাবে পাত্তা পেতেন না। চার্চিলে তাঁকে অন্য পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষই। এ ছাড়া সন্দীপ নন্দী, টোম্বা সিংহ ছাড়াও সুভাষের ভালবাসা পেয়েছেন আরও অনেকেই।
সাধে কি আর তিনি ফুটবলারদের কাছে পিতৃসম! ভালবেসে ফুটবলাররা তাঁকে ‘পাপা’ বলে ডাকতেন। প্রয়াত হলেও সুভাষ ফুটবলারদের ‘পাপা’ হিসেবেই থেকে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy