প্রয়াত সুভাষ ভৌমিক।
তিনি যখন বল পায়ে এগোতেন, ধুকপুক করত বিপক্ষ রক্ষণের হৃদযন্ত্র। তাঁর পায়ের জোরে কেঁপে যেত জাল। তাই কলকাতা ময়দান ভালবেসে তাঁর নাম দিয়েছিল ‘বুলডোজার’। তাঁর পায়েই সম্ভবত মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল সত্তরের দশক। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকে এসে কোনও তথাকথিত গডফাদার ছাড়াই টানা প্রায় এক যুগ ময়দানে রাজত্ব করেছিলেন সুভাষ ভৌমিক। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, পরে কোচ হিসেবেও একের পর এক গৌরবের মুহূর্ত তৈরি করে গিয়েছেন তিনি।
প্রকৃত অর্থেই ‘অলরাউন্ড ফরোয়ার্ড’ ছিলেন সুভাষ। আধুনিক ফুটবলের ‘ফল্স নাইন’ (কোনও এক জন বিশেষ ফরোয়ার্ড নয়। প্রয়োজনে সবাই আক্রমণে উঠতে পারে) ঘরানার একেবারে বিপরীত। সুযোগসন্ধানী। ক্ষিপ্রগতি। সঙ্গে তুঙ্গ শারীরিক ক্ষমতা। এই তিন অস্ত্র ধার করে একের পর এক গোল করে গিয়েছেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদরের ‘ভোম্বলবাবু’। পরে কোচ হিসেবেও সেই রীতি মেনেছেন। দলে এক বা একাধিক ফরোয়ার্ড থাকে, যাদের কাজ শুধু গোল করা— প্রশিক্ষক হিসেবে এই নীতিই মেনে চলতেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনকে কোনও দিন খেলার মাঠে নিয়ে আসেননি সুভাষ। অল্পবয়সে পুত্রের মৃত্যুও টলাতে পারেনি তাঁকে। নিয়ম করে ময়দানে গিয়েছেন। আসলে ফুটবলই ছিল তাঁর জীবনীশক্তি। সর্বরোগহর বটিকা। তাই যখনই সমস্যায় পড়েছেন ফুটবলকে আঁকড়ে ধরেছেন। মাথার চুল পাতলা হলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সব সময় ফুটবল নিয়ে ভাবতেন। কোচিং করানোর সময় বিদেশি ফুটবল সাময়িকী পড়তেন। বিশ্ব ফুটবলে কোথায় কী হচ্ছে, নিয়ত খোঁজ রাখতেন। আর সেই প্রকরণ নিজের প্রশিক্ষণে আনার চেষ্টা করতেন। দলের ভালর জন্য তথাকথিত নামকরা ফুটবলারকে দিনের পর দিন রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখতেও দু’বার ভাবেননি। আবার যে ফুটবলারের মধ্যে প্রতিভা দেখেছেন, তাঁর পিঠে ভরসার হাত রেখেছেন। তুলে এনেছেন একের পর এক তরুণ বাঙালি ফুটবলার।
ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো দলগত খেলায় সাজঘর বিশেষ ভূমিকা নেয়। সেখানকার পরিবেশ ভাল না থাকলে মাঠে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। এই চিরসত্য সুভাষ জানতেন। তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা জানেন দলকে কী ভাবে এক সুতোয় বেঁধে রাখতেন ময়দানের ‘ভোম্বলদা’। তাই খাতায়কলমে অনেক কমজোরি দল নিয়েও সাফল্য পেয়েছেন ডাকাবুকো কোচ সুভাষ।
কলকাতা ময়দানে ফুটবলার সুভাষের অভিযেক মাত্র ১৯ বছর বয়সে। তার পরের ১১ বছর দুই প্রধানে তাঁকে নিয়ে দড়ি টানাটানির ইতিহাস ময়দানের অন্যতম সেরা লোকগাথা। প্রথম বড় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। মাত্র এক মরসুম সেখানে খেলেই যোগ দেন প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব মোহনবাগানে। সেখানে তিন বছর খেলে প্রত্যাবর্তন লাল-হলুদে। তিন বছর পরে ফের সবুজ-মেরুনে। আরও তিন বছর সেখানে খেলার পরে তাঁকে ফের সই করায় ইস্টবেঙ্গল। এক বছর সেখানে খেলে ১৯৭৯ সালে অবসর নেন সুভাষ। অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গলে তিনি খেলেছেন পাঁচ বছর (১৯৬৯, ১৯৭৩-৭৫, ১৯৭৯)। আর গঙ্গাপাড়ের ক্লাবে ছ’বছর (১৯৭০-৭২, ১৯৭৬-৭৮)।
ক্লাব কেরিয়ারে মোট ২৭টি ট্রফি জিতেছিলেন সুভাষ। মোহনবাগানকে দিয়েছিলেন ১৬টি ট্রফি। তাঁর সময়ে ইস্টবেঙ্গল পেয়েছিল ১১টি ট্রফি। কলকাতা লিগ থেকে শুরু করে আইএফএ শিল্ড— কী না ছিল তাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে। কলকাতা লিগ জিতেছেন পাঁচ বার (১৯৭৩-৭৬, ১৯৭৮)। শিল্ড জিতেছেন ছ’বার (১৯৭৩-৭৮)। আট বার জিতেছেন রোভার্স কাপ (১৯৬৯-৭৩, ১৯৭৫-৭৭)। এ ছাড়া দু’বার করে বরদলই ট্রফি (১৯৭৬-৭৭), ডিসিএম ট্রফি (১৯৭৩-৭৪) এবং এক বার করে ফেডারেশন কাপ (১৯৭৮), ডুরান্ড কাপ (১৯৭৭), দার্জিলিং গোল্ড কাপ (১৯৭৬) ও নাগজি ট্রফি (১৯৭৮) জিতেছেন সুভাষ।
১১ বছরের মধ্যে এক মাত্র ১৯৭৯ সালে কোনও ট্রফি জিততে পারেননি তিনি।
মোহনবাগানের হয়ে ছ’বছরে মোট ৮২টি গোল করেছিলেন সুভাষ। তার মধ্যে ছিল চারটি হ্যাটট্রিক। অন্য দিকে লাল-হলুদের হয়ে পাঁচ বছরে ৮৩টি গোল করেছিলেন। গোলের নিরিখে তাঁর সেরা দু’বছর ১৯৭০ এবং ১৯৭৬। ১৯৭০ সালে ২৭টি এবং ১৯৭৬ সালে ১৯টি গোল করেছিলেন তিনি।
বাংলা ও দেশের হয়েও ট্রফি জিতেছেন সুভাষ। বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। ভারতের হয়ে এশিয়ান গেমসে (১৯৭০) ব্রোঞ্জ পদকজয়ী দলের সদস্য ছিলেন এই তেজিয়ান ফুটবলার।
ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ফুটবলে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন সুভাষ। কোচিং। ১৯৮৬ সালে জর্জ টেলিগ্রাফের কোচ হিসেবে সুভাষের সেই পর্বে অভিষেক। ১৯৯১ সালে প্রথম বড় দল মোহনবাগানের কোচ হন। তবে সুভাষের কোচিং জীবনের সেরা সময় কেটেছে ইস্টবেঙ্গলে। প্রথমে ১৯৯৯-২০০০ এবং তার পরে ২০০২-’০৫ এবং ২০০৮-’০৯ সালে লাল-হলুদের কোচ ছিলেন তিনি। তাঁর কোচিংয়েই ২০০৩ সালে আশিয়ান কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল। যা সুভাষের কোচিং জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। ২০০২-’০৩ এবং ২০০৩-’০৪ মরসুমে ইস্টবেঙ্গলকে পর পর দু’বার জাতীয় লিগ (অধুনা আই লিগ) চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। বাংলা দলেরও কোচ হয়েছিলেন সুভাষ।
ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান ছাড়াও ২০০৬ সালে মহমেডান স্পোর্টিং, ২০০৭-’০৮ গোয়ার সালগাঁওকর ও ২০১২-’১৩ মরসুমে গোয়ারই ক্লাব চার্চিল ব্রাদার্সের কোচ ছিলেন সুভাষ। গোয়ার ক্লাবকে আই লিগ চ্যাম্পিয়নও করিয়েছেন তিনি। মাঝে ২০১০-’১১ মরসুমে মোহনবাগানের কোচ হয়েছিলেন। শেষ বার ২০১৮ সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হন সুভাষ।
খেলোয়াড় হোন বা কোচ— বরাবর স্বাধীনচেতা এবং ডাকাবুকো ছিলেন সুভাষ। কখনও কারও সঙ্গে আপস করেননি। নিজের ইচ্ছে এবং মর্জিতে চলেছেন। সব সময় ফুটবলারদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। নিজের জীবনকে সবার অগোচরে রাখলেও প্রিয় ছাত্রদের সমস্যা শুনতেন। তাঁর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারতেন ফুটবলাররাও। সমর্থকদেও সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল সুভাষের। কোনও সময় অনুশীলন দেখতে আসা সমর্থকদের সঙ্গে গল্প জুড়তেন। সেই সুভাষই আবার শেষ সময়ে মাঠের মধ্যে তর্কে জড়িয়েছেন সমর্থকদের সঙ্গে।
ক্লাবকর্তাদের মন জুগিয়ে চলা ধাতে ছিল না। তাই সাফল্যের পরেও সরে যেতে হয়েছে। যে দলকে আশিয়ান জিতিয়েছেন, যে দলের হয়ে বড় ম্যাচে ঐতিহাসিক ৫-০ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন, সেই ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবেই মোহনবাগানের হয়ে ৩-৫ গোলে হেরে সমর্থকদের বিষোদ্গার শুনেছেন। দলের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কখনও সফল হয়েছেন। কখনও ব্যর্থ। কিন্তু কোনও দিন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাননি। সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্কও সঙ্গী হয়েছে সুভাষের। ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্কবিভাগে সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে কর্মরত সুভাষের বিরুদ্ধে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই মামলায় ২০১৮ সালে কারাবাসের নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁর বিরুদ্ধে। পরে জামিনে ছাড়া পান তিনি। ঘটনাচক্রে, তখন তিনি শেষ বারের মতো ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ। কিন্তু মাঠে তাঁকে দেখে মনে হয়নি ব্যক্তিগত জীবনে অতটা সমস্যায় রয়েছেন।
কিডনির অসুখের সঙ্গে লড়তে লড়তে যাঁর জীবন থেমে গেল, তিনি বরাবর অসম সাহসের সঙ্গে ময়দান কাঁপিয়েছেন। তাঁর পায়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছে প্রতিপক্ষ। ‘বুলডোজার’ হয়ে ভেঙেছেন বিপক্ষের রক্ষণ। সারা জীবন লড়াই করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত সামলেছেন সবুজ ঘাসের গালিচা আশ্রয় করে। কলকাতা ময়দানে মনে রাখবে, বাঙালি ফরোয়ার্ডের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন মালদহ থেকে আসা সুভাষ ‘ভোম্বল’ ভৌমিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy