সচিন স্যরের প্রশংসা বিশাল প্রাপ্তি আমার কাছে। এত দিন আমার কাছে সেরা মুহূর্ত ছিল ২০১৩ সালে বিশ্ব যুব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-৮ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চেন্নাই ফেরার দিনটা।
উত্থান: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কার্লসেনকে হারিয়ে চর্চায় প্রজ্ঞানন্দ। ফাইল চিত্র।
সপ্তাহের শুরুতেই এয়ারথিংস মাস্টার্স দাবা প্রতিযোগিতায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে চেন্নাইয়ের ছেলে আর প্রজ্ঞানন্দ। শনিবারই সে উড়ে যাবে ইটালিতে পরবর্তী প্রতিযোগিতায় খেলতে। তার আগে একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় দাবার বিস্ময় প্রতিভা জানাল তার অনুভূতি।
প্রশ্ন: এয়ারথিংস মাস্টার্সে সাফল্যের জন্য অভিনন্দন।
প্রজ্ঞানন্দ: ধন্যবাদ। কিন্তু সাফল্য বলতে আমি নারাজ। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলে বলা যেত সাফল্য। আমি তা হইনি। তাই সাফল্যও পাইনি।
প্রশ্ন: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারানো কি সাফল্য নয়?
প্রজ্ঞা: তার জন্য আমি খুশি। জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত অবশ্যই। কিন্তু সাফল্য নয়। এই পৃথিবী চ্যাম্পিয়নদের মনে রাখে। দ্বিতীয় বা রানার্স যে হন, তাঁকেও এক সময়ে ভুলে যায় মানুষ। তাই কথাটা বললাম।
প্রশ্ন: দাবা দুনিয়ার এক নম্বর কার্লসেনকে হারানোয় গোটা দেশ আলোড়িত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে সচিন তেন্ডুলকর সবাই অভিনন্দন জানিয়ে প্রচুর প্রশংসা করেছেন।
প্রজ্ঞা: সচিন স্যরের প্রশংসা বিশাল প্রাপ্তি আমার কাছে। এত দিন আমার কাছে সেরা মুহূর্ত ছিল ২০১৩ সালে বিশ্ব যুব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-৮ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চেন্নাই ফেরার দিনটা। সে দিন বিমানবন্দরে বিশ্বনাথন আনন্দ স্যরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে দাবার অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার পরে সচিন স্যর। সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী-সহ অনেক বড়মাপের মানুষ অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। এত সব বিখ্যাত মানুষরা যে দাবা খেলায় নজর রাখেন, তা দেখে ভাল লাগছে। এতে দাবার প্রসার ঘটবে আমাদের দেশে।
প্রশ্ন: কার্লসেনকে হারানোর পরে একান্তে এত শান্ত কি ছিলে? লাগামছাড়া আনন্দ হয়নি একবারও?
প্রজ্ঞা: দাবায় আমার দু’জন আদর্শ। একজন বিশ্বনাথন আনন্দ। তার পরেই কার্লসেন। তিনি আবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তাঁকে হারালে আনন্দ তো হবেই। আমি খুব খুশি। কিন্তু সেই খুশিতে ভেসে যেতে চাই না। ওই ম্যাচের পর দিন ঘুম থেকে ওঠার পরেই আমার কোচ আর বি রমেশ বলেন, একটা বিখ্যাত জয়েই আত্মহারা হয়ো না। আমিও তাঁর সঙ্গে একমত। আত্মহারা হচ্ছি না কার্লসেনকে হারিয়ে। দেশের মানুষ খুশি হতেই পারেন। আমাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হবে ভারত থেকেই। এই কথাটা ছোটবেলা থেকেই ঘুম থেকে উঠে রোজ বলি। জীবনে ওই ৩৯ চালের ম্যাচটা জেতা ছাড়া কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সব কিছু একই আছে। কার্লসেনও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নই রয়েছেন। ওই ম্যাচ জয় আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। ওইটুকুই। এগিয়ে চলার প্রেরণা পাচ্ছি।
প্রশ্ন: কার্লসেনের সঙ্গে কথা হয়েছে?
প্রজ্ঞা: না। প্রতিযোগিতাটাই অনলাইন। তাই ম্যাচের পরে কথা হওয়ার অবকাশই ছিল না।
প্রশ্ন: কার্লসেনকে হারানোর জন্য আগাম কিছু প্রস্তুতি ছিল?
প্রজ্ঞা: একদমই নয়। ওটা ছিল চতুর্থ ম্যাচ। আমি নিজের মনের আনন্দে খেলে গিয়েছি। আর কিছু নয়।
প্রশ্ন: নিজের একজন আদর্শকে হারিয়েছ। আনন্দের সঙ্গে কোনও খেলা হয়েছে?
প্রজ্ঞা: আনন্দ স্যরের অ্যাকাডেমি আমার ভুলভ্রান্তি শুধরে দেওয়ার কাজ করে। আমি ও আমার দিদি, দু’জনেই সেই অ্যাকাডেমির সঙ্গে জড়িত। আনন্দ স্যরের সঙ্গে দু’বার খেলেছি ওখানেই। কোনও প্রতিযোগিতায় নয়।
প্রশ্ন: কে জিতেছিল?
প্রজ্ঞা: জয়-পরাজয়ের কোনও ব্যাপারই ছিল না। ভুলভ্রান্তি বোঝাতে আমার সঙ্গে স্যর খেলেছিলেন। সেটাও একটা প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: কার্লসেনকে হারিয়ে এই নজির গড়ার পরে আনন্দ স্যর কী পরামর্শ দিলেন?
প্রজ্ঞা: আনন্দ স্যর আমাকে সব সময়েই পরামর্শ দেন। কার্লসেনকে হারানোর পরে তাঁর পরামর্শ ছিল, নিজের কাজ নিষ্ঠা সহকারে করে যাও। মোবাইল ফোন ও গণমাধ্যম থেকে দূরে থাকো। ম্যাচের এক সপ্তাহ আগে ইন্টারনেটে দাবা সংক্রান্ত কোনও ভিডিয়ো দেখবে না। নিজের উপরে অযথা চাপ ডেকে আনার কোনও প্রশ্নই নেই। স্যর আরও বলেছেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই। ভবিষ্যতের ভিত গড়বে বর্তমান। কঠোর পরিশ্রমই একজন দাবাড়ুকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই কথাগুলো মাথায় রেখেছি।
প্রশ্ন: কোচ আর বি রমেশ বলেছেন, তোমার সময়জ্ঞান ঠিক হলে আরও ক্ষুরধার হবে।
প্রজ্ঞ: একদমই। ওটা আমার সমস্যা হয়। রমেশ স্যর হলেন আমার কাছে সূর্যের মতো। আমি চাঁদের মতো তাঁর আলোকেই আলোকিত। উনি না থাকলে আমি এ ভাবে এগোতে পারতাম না।
প্রশ্ন: তোমার বয়স ষোলো বছর। পড়াশোনার সঙ্গে দাবা খেলে বিশ্বসেরাকে হারানো। এত কিছু একসঙ্গে সামলাও কী ভাবে?
প্রজ্ঞা: এর জন্য আমি আমার স্কুলের কাছে কৃতজ্ঞ। ওরা আমাকে প্রতিযোগিতায় খেলা, অনুশীলনের জন্য ছাড় দেয়। এতে অনেক সুবিধা হয়েছে। আমি এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। করোনাকালে দশম শ্রেণি উতরে এসেছি।
প্রশ্ন: বড় হয়ে কী হতে চাও?
প্রজ্ঞা: পেশাগত ভাবে কী হতে চাই, তা নিয়ে এখনও চিন্তাভাবনা করিনি কিছুই। তবে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াই আমার লক্ষ্য। তার জন্য সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি আমি।
প্রশ্ন: তোমার দাবায় হাতেখড়ি কত বছর বয়সে?
প্রজ্ঞা: তিন বছর বয়সে। আমার দিদি বৈশালী ভারতীয় দলের খেলোয়াড়। দাবায় আন্তর্জাতিক মাস্টার। ছোটবেলায় দিদি খুব টিভি দেখত। তাই বাবা ওকে দাবা খেলায় ভর্তি করে দেন। আমিও ছোটবেলায় ওর পাশে বসেই দাবা খেলা শিখেছি। তখন বয়স তিন। তার পরে পাঁচ বছর বয়সে প্রথম প্রতিযোগিতায় খেলে চ্যাম্পিয়ন হই।
প্রশ্ন: দিদির সঙ্গে এখনও খেলো?
প্রজ্ঞা: দিদির সঙ্গে আমার সব সময়েই দাবা নিয়ে আলোচনা হয়। অনেক ভুলভ্রান্তি বাড়িতে ও-ই শুধরে দেয়। কার্লসেনকে হারানোর পরে ওর সঙ্গেই প্রথম ম্যাচটা নিয়ে আলোচনা করি। পরদিন বাবা আমার প্রিয় চকোলেট এনে দেওয়ার পরে তার জন্য ভাগও দিতে হয়েছে।
প্রশ্ন: দাবা খেলার জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে নিজেকে পোক্ত রাখতে হয়। তার জন্য কী কর?
প্রজ্ঞা: আমার ব্যক্তিগত একজন মনোবিদ রয়েছেন। তিনি আমাকে যা করতে বলেন, তা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। বিস্তারিত ভাবে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। শারীরিক ভাবে পোক্ত থাকতে প্রত্যেকদিন আমি জগিং, জিম ও খালি হাতে ব্যায়াম করি।
প্রশ্ন: বছরের শুরুতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারানো। বছরের শেষে গিয়ে নিজেকে কোন জায়গায় দেখতে চাও?
প্রজ্ঞা: শনিবার ইটালি চলে যাচ্ছি। ১-১২ মার্চ সেখানে প্রতিযোগিতা। তার পরে আরও অনেক প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমার এলো রেটিং এখন ২৬১৮। বছরের শেষে আমার লক্ষ্য ২৭০০ ছাড়ানো। এলো রেটিংকে আমামী দিনে ২৯০০ পর্যন্ত নিয়ে যেতে নিরন্তর খাটতে হবে। তার জন্য অনেক পথ হাঁটা বাকি। কার্লসেনকে হারিয়ে আত্মতুষ্টি নয়। এখনও অনেক কিছু আনন্দ স্যরের থেকে শিখতে হবে। না হলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: কলকাতায় খেলতে এসেছিলে সম্প্রতি। কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি দই, রসগোল্লা, সন্দেশ চেখেছ?
প্রজ্ঞা: কলকাতায় গেলে অনেকই এই অভিজ্ঞতার কথা বলেন। কিন্তু আমার সুযোগ হয়নি। আমি দাবা খেলতে গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু নয়। তবে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও গঙ্গার ধার আমার খুব ভাল লেগেছে।
প্রশ্ন: অবসর কাটাও কী ভাবে?
প্রজ্ঞা: পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে। বাবা-মা-দিদির সঙ্গে থাকলেই আমি আনন্দে থাকি। মন ভাল থাকে। আমার খুব বেশি বন্ধু নেই পাড়ায়। সব বন্ধু দাবার বা স্কুলের। এর বাইরে তামিল সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করি। আর প্রিয় নায়ক রজনীকান্তের ছবি দেখা। কিন্তু সেই সুযোগ হয় খুব কম। আর সময় পেলে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, টেবল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলি। এতে শরীরটাও ফিট থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy