রাতে বেস ক্যাম্পে ভাল করে ঘুমোতে পারেননি সুনীতা। সুনীতা হাজরা— এভারেস্ট অভিযাত্রী। মনে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর এক বছর আগের এই দিনটার কথা। দেখেছিলেন, বরফের স্রোত নামছে খুম্বু আইসফল বেয়ে। একটানা গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। কালান্তক সেই তুষারধসের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে একের পর এক শেরপার দেহ নামাতে শুরু করেছিল উদ্ধারকারী দল। সংখ্যাটা ষোলোয় এসে থামে। তবে আরও অনেককেই নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি বরফের স্তূপ থেকে। এই দুর্ঘটনার জেরে বাতিল হয়ে গিয়েছিল সব এভারেস্ট অভিযান। ২০১৪ সালকে আরোহণের কালো বছর হিসেবে চিহ্নিত করে নেপাল সরকার।
বছর ঘুরে আজ, শনিবার আরও একটা ১৮ এপ্রিল। দেশ-বিদেশের অভিযাত্রীর ভিড়ে আবার সরগরম এভারেস্ট বেসক্যাম্প। সংখ্যাটা গত বারের চেয়েও বেশি। বিপদের কালো ছায়া ভুলে ফের অভিযানে নামার অদম্য মনোবলকে কুর্নিশ জানাচ্ছে তামাম অভিযাত্রীমহল। তবে একটা প্রশ্নও রেখে দিচ্ছে। ষোলো প্রাণের বিনিময়ে দুর্ঘটনা সম্পর্কে যথেষ্ট শিক্ষা নেওয়া গিয়েছে তো? আবার বিপর্যয় নেমে এলে সামলানো যাবে তো?
পর্বতারোহী দুনিয়া জানে, তাদের ছায়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটে বিপদ। তবু কেন যাওয়া? কিংবদন্তি জর্জ ম্যালোরি বলেছিলেন, ‘‘ওটা যে ওখানেই রয়েছে।’’ কিন্তু আজকের অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরা সকলেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভয়কে জয় করে অভিযানে যাওয়াটা যেমন দুর্দম সাহসের পরিচয়, দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেওয়াটাও তেমনই বোকামি। তাই দুর্ঘটনায় পড়লে দ্রুততম উদ্ধার নিশ্চিত করার কাজটা সমতল থেকেই করে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু। বললেন, ‘‘সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বিমার বিষয়টি। পাহাড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য নিজেকেই তৈরি থাকতে হবে। যাতে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে নেতা-মন্ত্রীদের দোরে দোরে ঘুরতে না হয় পরিবারকে।’’
কিন্তু ভারতীয় অভিযাত্রীদের কাছে এই দুর্ঘটনা-বিমা করানোই এক সমস্যা— জানালেন নেপালের পর্বতারোহণ আয়োজক সংস্থার কর্ণধার লোবেন। বিদেশি বিমা সংস্থাগুলির কাছে মোটা অঙ্কের প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমা মেলে। শেরপাদের জন্যও নেপাল সরকারের তরফে বিমা করানো হয়। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কায় এত ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের জন্য চট করে বিমা তৈরি হয় না। লোবেনের কথায়, ‘‘দুর্ঘটনা ঘটলে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে উদ্ধারকাজ চালানোটা প্রায় ৩০-৪০ হাজার ডলারের ধাক্কা। তাই এই উদ্ধার-বিমার প্রিমিয়ামও হয় অনেক বেশি, যেটা ভারতীয় আরোহীদের পক্ষে দেওয়া খুবই মুশকিল।’’
হয়তো তাই দুর্ভাগ্যক্রমে কখনও কোনও ভারতীয় যখন চিরতরে হারিয়ে যান তুষারের রাজ্যে, এই প্রশ্নগুলো নিয়েই চর্চা চলতে থাকে প্রথম কয়েক দিন। গত বছরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে নিখোঁজ হন হাওড়ার এভারেস্টজয়ী ছন্দা গায়েন। খোঁজ মেলেনি তাঁর সঙ্গী দুই শেরপা দাওয়া আর তেমবারও। অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিংয়ে তুষারঝড়ে প্রাণ হারানো বাঙালি ট্রেকারদের স্মৃতিও দগদগে। জোংরি ট্রেকিংয়ে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া বিশ্বজিতের কথাও ভুলতে পারেনি আরোহী মহল। কিছু দিন আগেই আন্দিজ পাহাড়ের তুষারঝড় থামিয়ে দিয়েছে ৪০ বছরের দক্ষিণ ভারতীয় অভিযাত্রী মল্লি মস্তান বাবুর দৌড়।
লোবেন জানালেন, গত বারের বিপদের পর খুম্বু আইসফল পেরোনোর পথটা এ বছর বদলানো হয়েছে। আগে খুম্বুর বাঁ দিক ঘেঁষে ‘ওয়েস্ট শোল্ডার’ হয়ে আইসফলটি পেরোতেন অভিযাত্রীরা। মাঝখান দিয়ে গেলে ক্রিভাস বা ফাটলের সংখ্যা অনেক বেশি থাকত বলেই পথটি সরেছিল বাঁ পাশে। এ বার ফের মাঝখান দিয়েই খুম্বু পেরোতে হবে। ক্রিভাসের ভয় বেশি হলেও, শেরপারা তা দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু বাঁ দিক ঘেঁষে যেতে গিয়ে পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা তুষারধসের মুখে পড়লে তা সামলানোর উপায় থাকে না। তবে ভয়, আশঙ্কা, আতঙ্ক উড়িয়ে লোবেনের সাফ কথা, ‘‘ডরেগা তো চড়েগা ক্যায়সে!’’
একই মত প্রথম অসামরিক অভিযানে এভারেস্ট জয়ী বসন্ত সিংহরায়েরও। তাঁর কথায়, ‘‘ভয়টা জয় করা যায় বলেই তো পর্বতারোহণ আর পাঁচটা খেলার থেকে আলাদা। দুর্ঘটনা দুঃখের। কিন্তু আসলে সেটা নিজের ভুল শুধরে বিপদ এড়ানোর শিক্ষা।’’ বসন্তবাবু উদাহরণ দিলেন, ছন্দার দুর্ঘটনা শিখিয়েছে, পরপর দুটো কঠিন শৃঙ্গ চড়তে যাওয়ার ঝুঁকিটা হয়তো একটু বেশিই ছিল। তবে বিমা সংক্রান্ত অসুবিধের কথা স্বীকার করলেন বসন্তবাবুও। ২০১৩ সালে ধবলগিরি অভিযানে গিয়ে তুষারঝড়ের মুখে পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় দেখা করে এসেছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘প্রতিটা অভিযানের আগে নিশ্চিত করার চেষ্টা করি, দুর্ঘটনায় পড়লে উদ্ধারকাজ যাতে ঠিকমতো হয়। তবে সব সময় সেটা সহজ হয় না। পর্বতারোহণের জন্য আলাদা বিমার ব্যবস্থা নেই এ দেশে।’’
তাতে অবশ্য দমে যাননি বসন্তবাবুর উত্তরসূরিরা— বারাসতের সুনীতা, ব্যারাকপুরের গৌতম, বসিরহাটের লিপিকা, বেহালার দেবরাজ। গত বছরের অভিযান বাতিলের পর এ বার টাকার খোঁজে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু স্বপ্ন ছোঁয়ার জন্য সব কিছু বাজি রেখে ফের রুকস্যাক বেঁধেছেন তাঁরা। সুনীতা জানালেন, আবহাওয়া ভাল নয়। বরফ পড়ছে সমানে। রবিবার পুজো হবে বেস ক্যাম্পে।
তার আগে, আজ, শনিবার ‘কালা দিবস’ পালন করবেন শেরপারা। গত বছর এঁরা কেউ বাবাকে হারিয়েছেন, কেউ দাদাকে, কেউ বা ভাইকে। অনেকে ভেবেওছিলেন, জীবনে আর পাহাড়ে পা রাখবেন না। কিন্তু মরসুম শুরু হতেই যখন এজেন্সিগুলোর ডাক এল, আর ঘরে থাকতে পারলেন না। সারা বছরের রোজগারের বেশির ভাগটা তো এই সময়েই আসে। তাই পরিবারের শুকনো মুখকে পিছনে ফেলে ফের পা বাড়িয়েছেন ধস-ঝড়-ক্রিভাসের রাজত্বে।
পেশাদারের ছুটি নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy