রুট-মইনের সাফল্যে কেক কাটা হল ইংল্যান্ড হোটেলে। -টুইটার ও পিটিআই
হলুদ টি-শার্ট, গোলগাল, প্রায় টাকমাথা ইংরেজকে বুধবার বিকেলে বেশ প্রসন্নচিত্ত দেখাচ্ছিল। মাঠের দিকে তাকিয়ে মৃদু-মৃদু হাসছেন। আপনমনে হাতের খাতায় লিখছেন কী সব। বরাবরের চাঁচাছোলা হিসেবে প্রৌঢ়ের ‘বদনাম’ একটু-আধটু নয়, ঘোরতর। বেশি পিছোতে হবে না। বুধবার দুপুরেই ভারতীয় মিডিয়ার জনা কয়েককে এমন দাঁত খিঁচুনি দিয়েছিলেন যে, উর্ধ্বশ্বাসে সবাইকে পালাতে হয়েছে!
লাঞ্চ তখন। ইংল্যান্ড ১০২-৩। প্লেট হাতে প্রৌঢ়কে ডাইনিং ফ্লোরে ঘুরতে দেখে পিছু নিয়েছিল মিডিয়া। শুধু ভাবতে পারেনি, বেখাপ্পা ধমকটা এমন কপালে জুটবে। ম্যাচ কী মনে হচ্ছে, লাঞ্চের আগে শেষ বলে উইকেট সত্যি খারাপ হল, নানাবিধ গৌরচন্দ্রিকা দু’মিনিটও টিকল না। উল্টে কটমট চোখে সপাট উত্তর আছড়ে পড়ল, “ইংল্যান্ডের থেকে বেটার আশা করেছিলাম। বাট, আমাকে জ্বালিও না তো। অ্যান্ড্রু স্ট্রসের কাছে যাও। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সে ডিরেক্টর এখন। সব জেনে বসে আছে। আমার কী দায় এ সব নিয়ে মাথা ঘামাবার?” এর পর বললে কে বিশ্বাস করবে, একই লোক বিকেলে মৃদু-মৃদু হাসবেন? বাজখাঁই গলায় বন্ধুকে হাঁক মারবেন উপস্থিতদের চমকে দিয়ে?
প্রৌঢ় খুব চেনা। জেফ্রি বয়কট। যাঁর দুই সময়ের দুই মেজাজ দিয়ে স্বচ্ছন্দে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট যুদ্ধের প্রথম দিনে ঢুকে পড়া যায়। বয়কটের মেজাজ যেমন, ম্যাচটাও তো তাই। দু’ভাগে টুকরো।
প্রথমটা, প্রাক্ জো রুট পর্ব।
দ্বিতীয়টা, জো রুট পরবর্তী পর্ব।
গত দু’বছরে কম রথী-মহারথী ভারত সফরে আসেননি। হাসিম আমলা। এবি ডে’ভিলিয়ার্স। কেন উইলিয়ামসন। কিন্তু এঁরা কেউ যা পারেননি, টিম রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সামনে ইংরেজ ব্যাটিং-মহীরুহ ঠিক সেটাই করে গেলেন। অসাধারণ সেঞ্চুরি ক্রিকেটপ্রেমীদের উপহার দিয়ে। রুটের সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য বোঝাতে শুধু একটা ছোট্ট তথ্য যথেষ্ট। ভারত সফর থেকে শেষ টেস্ট সেঞ্চুরির তাজ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন শুধু মাইকেল ক্লার্ক। যিনি আজ আর ক্রিকেটটা খেলেন না। ছেড়ে দিয়েছেন। আর সেঞ্চুরিটাও এসেছিল যখন, ভারতের টেস্ট অধিনায়কের নাম বিরাট কোহালি নয়। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এবং তা এসেছিল আজ থেকে তিন বছর আগে।
স্বভাব-তিরিক্ষে বয়কটের মেজাজ এর পর আজ ঠিক হবে না তো কবে হবে? স্টিভ স্মিথ, বিরাট কোহালি, কেন উইলিয়ামসন আর জো রুটকে ক্রিকেট-পৃথিবী ‘বিগ ফোর’ নামে ডাকে। বুধবারের পর সেই বিগ ফোরের বন্ধুকে তো যুদ্ধের ময়দানে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে রাখলেন রুট। অদৃশ্য বার্তা দিয়ে রাখলেন— বিরাট, তোমার দেশে নেমেই সেঞ্চুরি করলাম। আমি ওয়ান সেট আপ। নাও, ইটস ইওর টার্ন!
প্রথমেই এখানে বলে রাখা ভাল যে, ভারত মোটেও ম্যাচ থেকে ছিটকে যায়নি। একটা দিন খারাপ গিয়েছে, চাপে পড়েছে, কিন্তু কুরুক্ষেত্র থেকে মুছে যায়নি। রবিচন্দ্রন অশ্বিন— তাঁরও একটা দিন খারাপ গেল মাত্র। স্কোরবোর্ড যতই দুঃসহ লাগুক, ইংল্যান্ড যতই প্রথম দিন শেষে ‘পাঁচশো তুলব’ গর্জন ছেড়ে যাক, ঘটনা হল এখনও চারটে দিন বাকি। যা কিছু যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে। রাজকোট বাইশ গজ এ দিন ভারতীয় স্পিনারদের সঙ্গে বৈমাত্রেয় আচরণ করেছে বলে আগামী চার দিনেও করবে, নিশ্চয়তা নেই। বরং তৃতীয় দিন থেকে ঘোরার সম্ভাবনা। ইংরেজ-দাপটের ছবিটা তখন কিন্তু এ রকম না-ও দাঁড়াতে পারে।
একটা বিষয় শুধু অনস্বীকার্য। জো রুটের সেঞ্চুরি এবং মইন আলির অপরাজিত ৯৯ বুঝিয়ে গেল, ইংল্যান্ড আর যা-ই হোক নিউজিল্যান্ড হবে না। চার দিনে এদের চূর্ণ করা যাবে না। তা সে যতই বাংলাদেশ-বিপর্যয় ক’দিন আগে ঘটে থাকুক। মইন আলি ভারতের শেষ ইংল্যান্ড সফরে বল হাতে ভুগিয়েছিলেন। এ বার ভারত সফরে এসে ব্যাট হাতে কোহালির টিমের সামনে প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর তুলে দিলেন। কিন্তু তবু তিনি নন। ইংল্যান্ড মিডিয়াকুল অপার শ্রদ্ধাশীল ডান হাতি রুট নিয়ে। বাঁ হাতি মইন নিয়ে নয়। এ দিনও এঁদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল, বছর পঁচিশের ইংরেজ প্রতিভার ক্ষমতা আছে, সর্বকালের অন্যতম সেরা ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিকেট কেরিয়ার শেষ করার। রুটের নাকি কোনও দেখনদারি নেই। নাইটপার্টির আকর্ষণের ধার ধারেন না। ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে ওই একবার যা লেগেছিল। কিন্তু তার পর থেকে আর নয়। বরং বিলেতের মিডিয়াকুল তাঁর মধ্যে সংকল্পের অমর মশাল দেখে। যে কি না প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিরিশ গড় নিয়ে শুরু করে আজ ভারতের বিরুদ্ধে একশোর উপর গড় রাখতে শিখেছে। যে মেহেদি হাসান মিরাজের বাংলাদেশের কাছে অপদস্থ হয়েও আতঙ্ক-অনিশ্চয়তায় ভোগেনি। বরং মুম্বইয়ে দিন দু’য়েকের প্র্যাকটিসে নিজেকে ঠেলে দিয়েছে স্পিনের সামনে নিজের রক্ষণ নিশ্ছিদ্র করার অসীম সাধনায়।
যার প্রামাণ্য নথি, বুধবারের ১৮০ বলে ১২৪। এ দিন একটা সময় দেখা গেল, রুটের বিরুদ্ধে কভার রেখে বল করতে যাচ্ছেন অশ্বিন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনটে টেস্টের একটাতেও যা দাঁড় করাতে হয়নি। উইলিয়ামসনদের বিরুদ্ধে অশ্বিন কখনও অফে তিন জন রাখতেন, কখনও বা দুই। প্রতিপক্ষের সাড়ে বারোটা তাতেই বেজে যেত। কিন্তু এ দিন অশ্বিন বাধ্য হলেন রুটের বিরুদ্ধে কভারের চ্যালেঞ্জ রেখে অফে চার জন ফিল্ডারে যেতে। মারতে হলে যাতে কভারের উপর দিয়ে মারতে হবে।
আসলে দুঁদে ব্যাটসম্যানও সময়-সময় মনঃসংযোগের অভাবে মুহূর্তের ভুল করে। ছুটকো ক্যাচ তোলে, হাফচান্স দেয়। রুটের বুধবারের ইনিংস সেখানে নিপাট, ভ্রান্তিহীন। অশ্বিনের কয়েকটা ডেলিভারি দুমদাম নিচু হল। কিন্তু ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানকে একবারও হারানো গেল না। ভারতের কাজটা আরও কঠিন করে দিয়ে গেলেন মইন আলি। ক্রিকেট-সৌন্দর্যের পূজারী তিনি নন। হাজার চেষ্টাতেও তাঁর ক্রিকেট নিয়ে রোম্যান্টিকতা আসবে না। কিন্তু একটা কেঠো কার্যকারিতা আছে। যা চাপের মধ্যে কাজে লাগে। একশো পেরোতে না পেরোতে কুক, ডাকেট এবং নবাগত হামিদ চলে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের যা প্রয়োজন ছিল।
এবং মো-জো জুটির চতুর্থ উইকেটে ১৭৯ রানের পার্টনারশিপ ভারতকে শুধু চাপে ফেলল না, আট বছর আগে চেন্নাইয়ের স্ট্রস-কলিংউড জুটিকেও পিছনে ফেলে গেল। ভারত কয়েকটা ভুলও করেছে। তৃতীয় স্পিনার হিসেবে নেওয়া হয়েছিল অমিত মিশ্রকে। তিনি গোটা দিনে পেলেন মোটে দশ ওভার। তাঁকে দিয়ে আরও কয়েকটা ওভার করানোই যেত। বিশেষ করে প্রতিপক্ষকে আতঙ্কিত করার মতো টার্ন যখন পিচ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। জাডেজাদের বল ফুল লেংথে পড়ল বড় বেশি। ভারতের ফিল্ডিংও আজ ভাল হয়নি। তিনটে ক্যাচ পড়েছে, সিঙ্গলস গলেছে। ওই ক্যাচগুলো শুরুতে তুলে নিলে কে বলতে পারে, ইংল্যান্ড ইনিংস দিনের শেষে চাপের মুখে পড়ে যেত না। ভাগ্যিস, শেষ লগ্নে প্রায় ফেলতে-ফেলতে রুটের ক্যাচটা উমেশ অদ্ভুত ভাবে ধরেছিলেন। নইলে প্রথম দিনের শেষে চাপ আরও বাড়ার কথা।
খুব সহজে, বুধবার হালফিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক ব্যতিক্রমী দিন হয়ে থাকল। যেখানে ভারতের মাঠে খেলা হল। কিন্তু বল ঘুরল না। বরং হাল্কা সবুজ আভা দেখা গেল প্রথম দিনে। নিজেরা শাসিত না হয়ে উল্টে দিনভর শাসন করে গেল বিদেশি টিম। প্রাক্-যুদ্ধ কল্পনাতে কেউ তো ভাবতেই পারেনি এ জিনিস। ভাবতে পারেনি ইংল্যান্ড ফিরতে পারে এ ভাবে, পারে সিরিজের প্রথম দিনে, মিরাজ-অধ্যায়কে লকার-বন্দি রেখে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন জয়ের মতো এটাও তো সমান অপ্রত্যাশিত। নয়?
ইংল্যান্ড (প্রথম ইনিংস):
কুক এলবিডব্লিউ জাডেজা ২১
হামিদ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৩১
রুট ক ও বো উমেশ ১২৪
ডাকেট ক রাহানে বো অশ্বিন ১৩
মইন নআ ৯৯
স্টোকস নআ ১৯
অতিরিক্ত ৪, মোট ৩১১-৪।
পতন- ৪৭, ৭৬, ১০২, ২৮১।
বোলিং-
শামি ১২.১-২-৩১-০ উমেশ ১৮.৫-১-৬৮-১
অশ্বিন ৩১-৩-১০৮-২ জাডেজা ২১-২-৫৯-১
মিশ্র ১০-১-৪২-০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy