অমর: সেই বাঁ পা এবং চুম্বকের মতো লেগে থাকা বল। ফাইল চিত্র
নৈশাহার শেষে বুধবার রাতে খবরের চ্যানেলে চোখ রেখেছিলাম। তখনই পেলাম দুঃসংবাদটা! বিশ্ব ফুটবলে আমার অন্যতম প্রিয় ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা আর নেই! শুনেই চমকে গিয়েছিলাম। অন্তত ১০ মিনিট সময় লেগেছে ধাতস্থ হতে!
এই লেখার সময়েও কানে বাজছে আমাকে বলা ওর সেই কথাটা, ‘‘কে জিতবে আজ?’’ আমার উত্তর ছিল, দেখা যাক। ফুটবলের রাজপুত্রের চটজলদি উত্তর, ‘‘আমিই জিতব। কারণ, আমিই সেরা।’’ বলেই হেসে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে।
বছর খানেক আগের কথা। মারাদোনা দ্বিতীয় বার কলকাতায়। একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলা হয়েছিল। দু’দলের অধিনায়ক আমি আর মারাদোনা। খেলা শুরুর আগেই হয়েছিল এই কথাগুলো। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে মারাদোনার এই কথাগুলো শুনে সে দিন মনে হয়নি, মানুষটা দাম্ভিক। বরং মনে হয়েছিল শিশুর সারল্য নিয়েই সব সময় থাকেন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
আরও পড়ুন: মারাদোনা নেই, দুর্দান্ত-বিতর্কিত-ঘটনাবহুল অধ্যায়ের শেষ
আমার বাড়িতে পেলের বিরুদ্ধে খেলার ছবি রয়েছে। মারাদোনার বিরুদ্ধেও শেষ বয়সে খেলেছি। দু’টি ছবিই বাড়িতে রয়েছে। রাতে মারাদোনার সঙ্গে করমর্দনের সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখে জল এসে যাচ্ছিল।
মনে পড়ছিল ফুটবলের রাজপুত্রের সঙ্গে আলাপচারিতার মুহূর্তগুলো। মারাদোনা যে কতটা সহজ-সরল ব্যক্তিত্ব তার আরও একটা উদাহরণ দিই। ওই ম্যাচ শুরু হওয়ার খানিক আগে ওঁকে দোভাষীর মাধ্যমে বলেছিলাম, ২০০৮ সালে যখন কলকাতায় এসেছিলে, তখন মোহনবাগান ক্লাবে গিয়েও তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য। শুনে প্রথমে হাসলেন। তারপরে হাতের ইশারায় কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘‘তা হলে কথা বলে আক্ষেপ মিটিয়ে নাও। তার পরে খেলব।’’
আরও পড়ুন: ‘ফুটবল দেখতাম তোমার জন্য’, মারাদোনার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সৌরভ-সচিনরা
ছিয়াশির মার্চ মাস পর্যন্ত আমি সে ভাবে মারাদোনার সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না। বিশ্বকাপ শুরুর আগে আনন্দবাজার পত্রিকা পড়েই প্রথম জেনেছিলাম আর্জেন্টিনার এই মহাতারকা ফুটবলারের কথা। মারাদোনা-মাহাত্ম্য ভাল ভাবে বুঝতে পারলাম সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক দ্বিতীয় গোলটার সময়। বল ধরা, কাটানো, গতি, শক্তি, বুদ্ধি, পাস দেওয়া, বল আড়াল করা সব কিছুই যেন চোখে লেগে থাকে। আর তার পর থেকে মারাদোনাও আমার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
ভাবতাম, কবে মারাদোনার খেলা মাঠে বসে দেখব। সেই সুযোগ এসে গিয়েছিল ১৯৯০ সালে ইটালিতে হওয়া বিশ্বকাপে। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি দলের হয়ে সে বার বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলাম। তুরিনের দেলা আলপি স্টেডিয়ামে ছিল প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচটা। ব্রাজিলের কারেকা-আলেমাওদের দুর্দান্ত সাম্বা ফুটবল সে দিন হেরে গিয়েছিল সেই মারাদোনার একটি পাসে ক্যানিজিয়ার করা গোলে। ম্যাচটা মাঠে গিয়ে দেখতে পারিনি। টিভিতে দেখেছিলাম। সুযোগ এল তার পরের ম্যাচে। আর্জেন্টিনা বনাম যুগোস্লাভিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে।
আরও পড়ুন: একই ম্যাচে নিন্দিত ও প্রশংসিত, ফুটবলার হিসাবে যতটা সফল কোচিংয়ে ততটাই ব্যর্থ রাজপুত্র
মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে ১২০ মিনিটেও কোনও গোল হয়নি। খেলা গড়াল টাইব্রেকারে। আমি, অরুণদা (অরুণ ঘোষ), প্রয়াত প্রদীপদা (প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়) চুনীদা (গোস্বামী) সবাই বসে রয়েছি। মারাদোনা ম্যাজিক মাঠে দেখে হৃদয়ের সব আকাঙ্ক্ষা সে দিন ১৪ আনা পূর্ণ। কেবল টাইব্রেকারে মারাদোনার জয় দেখলেই ১৬ আনা পূর্ণ হয়ে যাবে। পাশে একদল ইটালীয় যুবক খেলা দেখছে। আর্জেন্টিনা জিতলে ওদের দেশ ইটালির বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে খেলবে। তাই স্টেডিয়ামের একটা অংশ মারাদোনাকে বিদ্রুপ করছিল। মারাদোনা মারতে এলেন তৃতীয় শট। আর্জেন্টিনা ২-১ এগিয়ে। মারাদোনা পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ। আমরা সবাই হতাশ। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক গায়কোচিয়া পর পর দু’টো পেনাল্টি বাঁচিয়ে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ‘মারাদোনার দলের জয়’ স্বচক্ষে দেখার। ফাইনাল দেখার সুযোগ হয়নি। সেই খেলায় পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে হারের পরে ওঁর সেই কান্নাভেজা মুখটা দেখার পরে আমার চোখেও জল চলে এসেছিল কলকাতায় বসে।
আমার কাছে মারাদোনা যে কেবল ফুটবলের রাজপুত্র নন। একজন প্রতিবাদী নায়ক। যিনি স্রোতের বিরুদ্ধে মাথা তুলে এগিয়ে জয় তুলে আনতে জানেন। কখনও বার্সেলোনা থেকে ইটালির নিচের সারির দল নাপোলিতে খেলতে গিয়ে সেই দলকে ইটালি সেরা করেন। কখনও তারকাহীন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতান। এটা মারাদোনার পক্ষেই সম্ভব। ধূপ নিভে গেলে যেমন তার সুগন্ধ রয়ে যায়, মারাদোনার ‘সৌরভ’-ও সে রকম ১০০০ বছর পরেও অটুট থাকবে। গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে যাঁর সিংহাসন পাতা রয়েছে, তাঁকে মৃত্যু কখনই কাড়তে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy